চিরায়ত সাম্প্রদায়িকতা ও সংঘাতমূলক সমাজবাস্তবতা

 প্রকাশিত: ২০১৬-১১-২৩ ০৩:০৫:৫৬

শামীম সাঈদ:

মানুষের সাম্প্রদায়িক চেতনার বয়স কতো?

তা সে তো মানব সভ্যতার সমানই বলা যায়! কেন না, মানুষ সামাজিক প্রাণী, তাকে শুরু থেকেই যূথবদ্ধতায় বাস করতে হয়েছে। সুতরাং সেই যূথবদ্ধতার কাল থেকেই, যূথবদ্ধতা থেকেই মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক চেতনা বিরাজ করছে। তবে সে সাম্প্রদায়িকতার স্বরূপ, বৈশিষ্ট্য কিংবা মিথষ্ক্রিয়া যে আজকের মতো ছিলো না তা বলাই বাহুল্য। তবু, হ্যাঁ, সাম্প্রদায়িকতা যূথগত, ক্ল্যানগত, এলাকাভিত্তিক (শিকার অঞ্চল, খাবার সংগ্রহের এলাকা, চাষের এলাকা, বাসের এলাকা ভিত্তিক), শিকার ও খাবার সংগ্রহেরে কলাকৌশল ভিত্তিকও ছিলো বটে, তৎকালে, যদিও বর্তমান সময়ের মতো জটির সমীকরণ সেখানে অনুসন্ধেয় নয়। দ্বন্দ্ব, সংঘাত তখনও ছিলো তা অনুমেয় নয় কেবল, প্রামাণ্যও।

এই সংঘাত ও দ্বন্দ্বের স্বরূপও আজকের মতো ছিলো না এবং আজকের মতো জটিল কার্য-কারণ সম্পর্ক-জালও ছিলো না তার পিছনে-এই বাহুল্য কথাটি আবার বলছি, তবে যতো সরলই হোক না কেন, কারণ বিদ্যমান ছিলো সমাজর বাস্তবতাতেই, তৎকালে। সামাজিক সংঘাত ও দ্বন্দ্বে যে অন্যান্য মাত্রা যুক্ত হয়েছে তা তো অনেক পরের কথা, তার পথ-পরিক্রমাও মানুষের অজানা নয়। প্রাথমিক ধরনের ধর্মবিশ্বাস মানুষের সাম্প্রদায়িকতাকে সেভাবে ধারণ করতে সক্ষম ছিলো না তখন, বিষয়টি তখন ছিলো না রাজনৈতিকও। জাতীয়তাবোধগত সাম্প্রদায়িকতারও তখন উন্মেষ ঘটেনি। ফলে তখন যে সাম্প্রদায়িকতা ছিলো তা জাতীয়তাবোধ ও ধর্মবোধকে পাশ কাটিয়ে জীবনের অন্যান্য প্রয়োজন ও গতিমুখের প্রেক্ষিতে সংগ্রামশীলতার নামান্তর ছিলো। যখন সমাজে প্রাথমিক ধরনের রাজনীতি ক্রিয়া করতে শুরু করে তখন থেকেই ধর্মবিশ্বাসকে শাসন ও শোষণের হাতিয়ার করা হয়েছে, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক চেতনা প্রবেশ করানো হয়েছে মানুষের সকল প্রকার সংগ্রাম ও যাপন প্রক্রিয়ার মাঝে, আর তখনই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা হয়েছে দোধারী (দুইদিকে যার ধারালো) অস্ত্র, শাঁখের করাত, মানুষের জন্য। সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের নানান রূপ নিয়ে আরো যে কথা বলার তা কিছু পরে বলি, আর এই অবসরে সাম্প্রদায়িকতার অস্তিত্বানুসন্ধানী কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয় আলোচ্য।

এখনও পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতাকে মানুষের সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশই বলা যায়। সমাজের প্রাথমিক ধরনের কাঠামোর সাথে এর অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক বিদ্যমান। কাঠামো বিহীন সমাজ কখনো রূপায়িত হয়নি, হতে পারে না। ফলত সামাজিক কাঠামোবদ্ধতার প্রাথমিক যে অবয়বটি রূপায়িত হয়েছিলো সেখানেই সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছিলো বলা যায়, কেন না, সমাজ কাঠামো রূপায়ণে সামাজিক সংহতি অনিবার্য ছিলো। সামাজিক সংহতির ধারণাকে সাম্প্রদায়িকতা থেকে আলাদা করে দেখা সম্ভবই নয়। যদিও এই প্রাথমিক ধরনের সাম্প্রদায়িক রূপকে সমাজস্থ মানুষের যান্ত্রিক সংহতি (Mechanical Solidarity) হিসেবে সমাজতত্ত্ব আলোচনা করলেও সেখানে মানুষদের মধ্যে কোনো না কোনা ধরনের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ছিলোই; ফলে সেই সংহতিরও বিশেষ মাত্রিক সাংগঠনিক ভিত্তিও ছিলো, ফলত তাও ছিলো কিছুমাত্রার সাংগঠনিক সংহতির ভিত্তিতেই গড়ে ওঠা সম্প্রদায় কিংবা সমাজ। সকল সমাজতাত্ত্বিকগণেরই স্বীকৃতি যে, সম্প্রদায় হলো সমাজব্যবস্থার ক্ষুদ্রাবয়ব। সুতরাং বর্তমান শিল্পায়িত, পুঁজিভিত্তিক, সাম্রাজ্য রূপক সমাজের সংহতিকেই কেবল সাংগঠনিক (Community) বলার যথেষ্ট কারণ নেই, কেন না, সেই সময়কালের মানুষের আচরণেরও যে সমরূপতা ছিলো তা অবিসংবাদিত রূপে প্রমাণ করা যায় না, বরং তাদের মনোভব তখন থেকেই বিসমরূপ হওয়া স্বাভাবিক ছিলো।

মানুষের প্রাচীনতম যাপনে যদিও জটিলতা তেমন ছিলো না, কিন্তু প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা মানুষকে তার সচেতনতার বাইরেই সংহত হতে বাধ্য করেছিলো বলা যায়। আর জৈবিক বৈশিষ্ট্যগত কারণেই তাদের মেধাশক্তিও যে ক্রিয়াশীল ছিলো তাও জোর দিয়ে বলা যায়, কেন না, তা না হালে মনোবিকাশ ও তার অভিমুখীনতায় মানুষের সাংস্কৃতিক বিকাশ হওয়া সম্ভব ছিলো না। আর তাদের মনো-প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন বিষয় ও বস্তুর প্রতি যে খুবই সরল, একমুখী ও এক রৈখিক ছিলো না তারও দাবি তোলা অবান্তর হবে না। আদিম যাপনে মানুষের তথাকথিত আদিম সংস্কৃতিও ততো সরল ছিলো না বলা যায়। ফলে সেখানে ভাষা, আন্তঃব্যক্তিক মিথস্ক্রিয়া, কোনো একব্যক্তির কোনো বিশেষ ব্যক্তির প্রতি বিশেষ ভালো লাগা বোধেরও অস্তিত্ব সেই সম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্যে ছিলো। এই সকল কারণেই প্রাচীন সমাজ, সম্প্রদায়সমূহের মধ্যে আত্মসম্প্রদায়গত চেতনার অস্তিত্ব অস্বীকার করা চলে না। আর সম্প্রদায়গত চেতনাই হলো আধুনিক জাতীয়তাবোধের বীজবোধ।

এবার প্রশ্নটা উত্থাপিত হওয়া প্রাসঙ্গিক যে- সাম্প্রদায়িকতার এতো এতো ইতিবাচক ইঙ্গিতসমূহ সত্ত্বেও কেন এই বিষয়টিকে এমন মঞ্চে আলোচিত হয়? সুতরাং সাম্প্রদায়িক চেতনায় ইতি ও নেতি দুটি মূল্যবোধজাত বোধস্বরূপ আছে ও তার কারণানুসন্ধানও আবশ্যক কাজ বিবেচনা করি। আর বর্তমানে নেতিবাচক স্বরূপটিই তো বেশি করে আলোচিত হয়, তার কারণও কি এই নয় যে- মানব সভ্যতার জন্য তা অতি নেতিবাচক ও হুমকি স্বরূপ বলেই? তবে, মানুষের সাম্প্রদায়িক চেতনার নেতিবোধ যে সর্বকালীন নয় তা বাজি ধরে বলা যায়। সাম্প্রদায়িক চেতনাকে এখন আর কোনো দেশ বা ভূখণ্ডের সীমায় সীমায়িত করা সহজ নয়। কিন্তু প্রাচীনে সংহতি ও সাম্প্রদায়িকতাকে কেবল আলাদা করা সম্ভব ছিলো কেবল স্থান বা গণ্ডির সীমায় সীমায়িত করেই। কেবল একটি নির্দিষ্ট স্থান বা এলাকা সীমার মধ্যেও মানুষই বিশেষ সম্প্রদায় বলে পরিচিত হতো। তদ্রূপ আরো আরো সম্প্রদায়। যেহেতু সেই সাম্প্রদায়িকতার সূত্রপাত প্রাকৃতিক বৈরিতার মোকাবিলা করতে, ফলত সেখানে মানুষে মানুষে কিংবা সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে সংঘাত প্রকট ছিলো না, তবে অবর্তমান ছিলো এই দাবিটাকেও অকাট্য করা যায় না, তবু সম্পত্তি ও ব্যক্তি মালিকানার ধারণা ব্যতিত সে সংঘাত যেমন হতে পারে, তাই। ঠিক এই কারণেই সেই কালের সাম্প্রদায়িকতাকে নীতিবোধে নেয়া বাঞ্ছনীয় নয়। আর সমাজতাত্ত্বিকভাবে সম্প্রদায়ের যে সংজ্ঞাসমূহ আছে সেখানে স্থানগণ্ডিকে অত্যাবশ্যক শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

তাহলে প্রাচীন ও বর্তমান সাম্প্রদায়িকতার তফাৎ কি এই? কেন না, বর্তমানে সাম্প্রদায়িকতাকে আর স্থানগণ্ডিতে বিভাজিত ও সীমায়িত করে দেখা মুশকিল। তবু, বর্তমানে সাম্প্রদায়িকতাকে খুব জোরালোভাবে আলোচনা করছি। কিন্তু, যেখানে স্থানগণ্ডিগত সীমা নেই, নেই ভাষা-সংস্কৃতিগত সমরূপতা, স্বার্থগত ঐক্য নেই, সেখানে সেই মানুষদের একই সম্প্রদায়ভুক্ত করে দেখা যায় কি? এই সাম্প্রদায়িকতা কেমন? এই প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া জরুরী বটে। প্রচলিত সমাজতাত্ত্বিক সংজ্ঞায় একটি জাতিকে, একটি রাষ্ট্রীয় গণ্ডির মানুষদের জাতীয়তাবোধের সমরূপতার কারণে একটি জাতি সম্প্রদায় হিসেবে দেখা হচ্ছে, একটি স্থানগণ্ডি আছে বটে, কিন্তু যখন বলা হয় হিন্দুসম্প্রদায়, মুসলিম সম্প্রদায়, খৃষ্টান সম্প্রদায় কিংবা বলা হয় শিক্ষকসম্প্রদায়, নারী সম্প্রদায় এবং এমনই আরো আরো মানবীয় ঐক্যচেতনাগত প্রত্যয়সমূহের ভিত্তিতে সম্প্রদায় চিহ্নিত করা হয় তখন তা আর মামুলী সম্প্রদায়গত চেতনার আলোচ্য থাকে না, তার ব্যাপ্তি হয় তখন ব্যাপকতর।

এটা স্পষ্ট যে বর্তমানে যে সম্প্রদায়সমূহের কথা উল্লেখ করা হয় তার নির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমা নির্ধারণ করা মোটেই কাজ সহজ নয়। সম্প্রদায়কে এখন চিন্তা করা হয় বৈশ্বিক ব্যাপ্তিতে। ফলে এই সাম্প্রদায়িক চেতনায় এক রাষ্ট্রের নাগরিক খুব সহজেই অন্য আরেকটি রাষ্ট্রের নাগরিকগণের সাথে সংহত হতে পারে বিশেষ ঐক্য চেতনা বোধে, যেমন বিশ্ব-মুসলিম, বিশ্ব-হিন্দু, বিশ্ব-খৃষ্টান চেতনায় রাষ্ট্রীয় সীমাও অগ্রাহ্য হতে পারে এবং হয়, এমন নজির অপ্রতুল নয়। ফলে নতুন নতুন ভূগোল বিনির্মিত হয়েছে, হচ্ছে। এখানে এসে আরেকটি প্রশ্ন খুব জোরালোভাবে উত্থাপিত হলো যে, সাম্প্রদায়িকতার যে বর্তমান বিশ্বব্যাপ্ত রূপ, ধারণা ও চর্চা তা কি সাম্রাজ্য বিস্তারের রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে চর্চিত হতে শুরু করেনি কি বিশ্বে?

হ্যাঁ, অবশ্যই, সম্প্রদায়গত সমষ্টি চেতনা থেকে যখনই স্থানিক সীমানা তুলে দেয়া হয়েছে, বলা যেতে পারে তা সাম্রাজ্যবিস্তারি হাতিয়ার হিসেবে এই চেতনাকে ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই তুলে দেয়া হয়েছে। কারণটি নিশ্চিতভাবেই আর্থ-রাজনৈতিক। আর তখন থেকেই এই ব্যাপক সম্প্রদায়গত ধারণার সাথে ব্যাপক মানব বিধ্বংসী তৎপরতা চর্চিত হয়ে আসছে। এই হলো সম্প্রদায়গত সামষ্টিক ও সংহতিব্যাঞ্জক চেতনার নেতিবাচকতা, ফলত বিষয়টিকে মানব সভ্যতার মাথা ব্যথার কারণ হিসেবে আলোচনায় আনতে হয়েছে।

যেমনটি উপরে আলোচিত হলো, এইরূপে বর্তমান বিশ্বে সম্প্রদায় চেতনার এমন এক ধরন দাঁড়িয়ে গিয়েছে যে, কেউ বলতেই পারেন যে, মানব সমাজে সাম্প্রদায়িকতা ও সংঘাত বিষয়টি সমাজতত্ত্বে যেভাবে সম্প্রদায়কে (Community) সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে ও এর উপাদান উল্লেখ করা হয়েছে এবং এর সদস্যদের সমষ্টিগত মনোভবজাত সংহতি রূপক আলোচিত হয়েছে, তেমন নয়। আসলে বিষয়টি তো এর থেকে ভিন্ন কিছুও নয়। কেবল এই ধারণাটি থেকে স্থানগণ্ডির সীমা তুলে দিয়ে ব্যাপক আর্থ-ভূ-রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। সম্প্রদায়ের ঐক্য ও সংহতি বোধ পূর্বের মতোই আছে বটে কিন্তু তাকে ব্যবহার করা হচ্ছে বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে প্রয়োজনীয় রঙ চড়িয়ে, এই তো তফাৎ। আর বিষয়টিকে সামাজিক স্তর বিন্যাস, ক্ষমতাকাঠামো, শ্রেণীদ্বন্দ্ব, স্বার্থ ও আর্থ-ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত করে না দেখার কোনো উপায়ই নেই, আদিম কিংবা আধুনিক, বর্তমান কিংবা অতীতের সমাজের প্রেক্ষিতে।

বর্তমানের মতো আদিম শ্রেণীবিহীন সমাজে, ব্যক্তি মালিকানার চেতনা মুক্ত সমাজে এই সকলের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না, ঠিক; কিন্তু সেখানে কোনো প্রকারের আর্থ-ব্যবস্থা ছিলো না এমন ভাবা অনুচিত হবে, কেন না, প্রাথমিক যে-যূথবদ্ধতা ও সমাজ সংহতি সেই কালে দৃষ্ট হয়েছিলো সেখানে মানুষের জৈবিক প্রয়োজন তীব্রতর ছিলো। জীবন ধারণের কৌশলগত অজ্ঞানতা সত্ত্বেও কেবল জৈবিকতাই তাদেরকে সংহত করেছিলো। এই তো প্রাথমিক সমাজ কিংবা সম্প্রদায়। আদিম ফলমূল সংগ্রহ, শিকার সমাজে সম্প্রদায় সমূহের মধ্যে স্বার্থগত দ্বন্দ্ব চিহ্নিত করা না গেলেও তাদের প্রতিপক্ষ তো ছিলো, প্রাকৃতিক বৈরিতা। ফলত, তারা নিরাপত্তাজনিত স্বার্থে সংহত হতে পেরেছিলো, সম্প্রদায় হিসেবে নিজেদেরকে একটি স্থানগণ্ডিতে, স্বতন্ত্র ভাষায়, সংগ্রহ কৌশলগত স্বতন্ত্রতায় প্রতিষ্ঠা করেছিলো। একটি সম্প্রদায়ের সদস্যগণ তাদের নিজস্ব ধরনের ভাষার মাধ্যমে পরস্পরের সাথে মিথস্ক্রিয়া চালাতো, যৌথভাবে লড়তো বন্য জানোয়ারের সাথে। সুতরাং তাদের মধ্যে আত্মবোধ ছিলো তখনই, দাবি করা যায়, যেই বোধে তারা অন্যান্য সম্প্রদায়গুলো থেকে আলাদা ভাবতে পারতো। স্থানগত দূরত্ব, যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্গতিসহ বিবিধ কারণে এই সম্প্রদায় সমূহ মুখোমুখি হতো কমই, ফলে তাদের মধ্যে স্বাতন্ত্র্য ছিলো স্বাভাবিক সামাজিক ও ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে। সেকালের মানুষের এই সমষ্টিগত আত্মবোধ তখনো সম্প্রদায় চেতনা হিসেবে মানুষ আবিষ্কার করেনি বটে, তার কোনো নাম দেয়া হয়নি তখনো বটে; কিন্তু তার অস্তিত্ব তো ছিলো।

এই সংহতির ভিত্তিকে বলা যেতে পারে সামাজিক চুক্তিগত ভিত্তি। সেই ছিলো সাম্প্রদায়িকতার ইতিবাচকতা। ইতিবাচক হোক আর নেতিবাচকই হোক, সম্প্রদায় ও সাম্প্রদায়িকতা মানব সমাজে সর্বকালীন ব্যাপার। যেমন ব্যক্তি বা বস্তুর ছায়া তার সাথে অবিচ্ছেদ্য, তেমনই সাম্প্রদায়িকতা মানব সভ্যতার ছায়ার মতো অবিচ্ছেদ্য। আর কীরূপে, কোন পর্যায়ে এসে এর সাথে নেতিবাচক মূল্যবোধ যুক্ত হলো তা অনুসন্ধেয়। এই নেতিবাচক সাম্প্রদায়িক ধারণাটিকে এই ক্ষণে অন্ধকারের সাথে তুলনা করি! অন্ধকারের অস্তিত্বে আলোছায়ার একটি স্বাভাবিক সম্পর্ক সূত্র বিদ্যমান।

হ্যাঁ, ছায়ার বিজ্ঞান তো আমরা জানিই। ছায়ার অস্তিত্বে আলো অনিবার্য। অতীতে আমরা সেটা না বুঝলেও এখন বুঝি যে, ছায়াকে আবিষ্কার করতে আলোকের সংবেদন দরকার পড়ে আমাদের চৈতন্যে। ফলত, যতক্ষণ আমরা মনে আলোকিত হইনি ততোক্ষণ এই সাম্প্রদায়িকতাকে ছায়ারূপে মানব সভ্যতায় আমরা আবিষ্কার করিনি, বিশেষত সাম্প্রদায়িকতার নেতিবাচক ছায়ারূপক কিংবা অন্ধকার। আমরা যদিও বা কোনো সময়কালে সাম্প্রদায়িকতাকে ইতিবাচক রূপে পেয়েছি, কিন্তু এই ধারণাটিকে অসদার্থে ব্যবহারের সম্ভাবনা, ইঙ্গিত- সম্প্রদায়ের সংহতিবোধে, আদিমতম আত্মচেতনার ভিতরেই ছিলো বলা যায়, নতুবা এটিকে সাম্রাজ্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের উপযোগ তৈরি হতো না। সাম্প্রদায়িকতা নামের মানব সভ্যতার ছায়াটি কালো ছায়া হয়ে উঠেছে, আর একে অপচ্ছায়া বলতেও কোনো দ্বিধা থাকার কথা নয়। সুতরাং সাম্প্রদায়িকতা আমাদের অস্তিত্বের অংশ হয়ে টিকে আছে। আমাদের অস্তিত্বের মতো সত্যি সে। এই কালো ছায়া এমনই যে, তা অন্যের অস্তিত্বকে এই কালো দিয়ে ঢেকে দিতে চায়, মুছে দিতে চায়, অস্বীকার করতে চায় এবং অবশ্যম্ভাবী এর বিপরীত প্রতিক্রিয়াও ঘটে, যাকে বলি মূলত, সামাজিক সংঘাত, সামাজিক দ্বন্দ্বের ঘটনাবর্ত। এরূপ নানাবিধ মানুষের সংঘাতমূলক আচরণ সমাজদ্বান্দ্বিকতাকে রূপায়িত করে চলেছে সুপ্রাচীনকাল থেকেই। দ্বান্দ্বিকতা মানব চরিত্রেরও অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানব চরিত্রের দ্বন্দ্ব হিসেবে সাধারণীকরণ না করে একে ব্যক্তির দ্বান্দ্বিকতাও বলা যায়।

সমাজ যতো সরল হোক, দ্বন্দ্বের অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিলো সবকালে, কেন না, দ্বন্দ্ব এই মহাবিশ্বের মৌলিক উপাদান কিংবা বিশ্ব-সমাজ রূপান্তরের উৎস-শক্তি ও কারণ। দ্বান্দ্বিকতা অনিবার্য, যা সামাজিক কিংবা সকল ধরনের পরিবর্তনশীলতার শর্ত। পরিবর্তনশীলতা ব্যতিত পৃথিবী, সমাজ ও সভ্যতা স্থির, স্থবির হতে বাধ্য। এখানেও প্রাচীনতম সাম্প্রদায়িক চেতনার স্বরূপ ও ব্যাপ্তবিশ্বের সাম্প্রদায়িক চেতনার স্বরূপও, এক ক্রম রূপান্তরের কাহিনীই বলে এবং দ্বান্দ্বিকতার সমারূঢ় তা। সুতরাং সমাজ রূপান্তরশীলতার পথরেখায় দ্বন্দ্ব মৌলিক অনুঘটক, ক্রিয়া-প্রক্রিয়াগত অবস্থা আর পরিবর্তনশীলতা বা পরিবর্তন প্রবণতা তার সংবেদিত রূপ। দ্বন্দ্ব ও সংঘাত উভয়ই ক্রিয়াশীল রূপান্তরশীলতার উপাদান। তবে, দ্বন্দ্বকে মৌলিকরূপে পেলে সংঘাতকে পাই উপজাত হিসেবে। মূলত সংঘাত হলো সমাজ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের নেতিবাচক উপজাত। প্রাচীনতম সাম্প্রদায়িক চেতনায় দ্বন্দ্ব অবশ্য সত্যি ছিলো কিন্তু আধুনিক বিকশিত সমাজবিশ্বে দ্বন্দ্বের উপজাত সংঘাতকে প্রধান, প্রকট করে তোলা হয়েছে।

ফলত, সংঘাতমূলক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কারণেই বর্তমান ধরনের সাম্প্রদায়িক চেতনাকে নেতিবাচক মূল্যবোধে বিচার করা হচ্ছে। সংঘাত হলো দ্বন্দ্বের ধ্বংসাত্মক উপজাত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। দ্বন্দ্ব, সামাজিক ও মহাবৈশ্বিক, বস্তু ও অবস্তুতেও সত্যি। যেমন সকল সামাজিক প্রেক্ষিতে দ্বন্দ্ব বিরাজমান, তেমনই মহাবিশ্বের স্বরূপে বস্তুর ও অবস্তুর অন্তর্গত সত্যি এই দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্ব ইতিবাচক যা বস্তুর আণবিক কিংবা পারমানবিক গঠন কাঠামোর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাপার, যা মহাবিশ্বের অস্তিত্বেরও শর্ত। ‘শূন্য’ অস্থিতিশীল, যা মহাবিশ্বের অস্তিত্বের সূত্র, তার সাথে প্রাকৃতিকতার সম্পর্ক। কিন্তু সংঘাত? এই বিষয়টিকে সংজ্ঞায়িত করতে চাই ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। বর্তমান সময়ে প্রচলিত সম্প্রদায়গত চেতনা ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সাথে সংঘাত প্রত্যয়টি ওতপ্রোত, বিষয়টি মানুষের চেতনাপ্রসূত, মানুষের স্বেচ্ছাধীন ক্রিয়া-প্রক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়াগত রূপ। মানুষের স্বেচ্ছাকৃত ঘাত, আঘাত, আত্মঘাত, প্রতিঘাত কিংবা ধ্বংসাত্মক কর্মটিকেই বলতে চাই সংঘাত। বিষয়টি দ্বান্দ্বিকতার মতো মৌলিক, প্রাকৃতিক ও ইতিবাচক মোটেই নয়। বিষয়টি অনিবার্য তো নয়-ই, বরং নিবার্য ও পরিত্যাজ্য। ফলে সাম্প্রদায়িকতার এই সংঘাত প্রতিরূপতার কারণেই সাম্প্রদায়িকতার ছায়া ও আলো-আঁধারির রহস্যানুসন্ধান। সাম্প্রদায়িকতা বোধটি এখন সংহতিকে ছাপিয়ে, মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতার যূথবদ্ধতাকে পদদলিত করে, কেবল একটি সংঘাতমূলক আচরণ। সাম্প্রদায়িক চেতনার মধ্যে এখন যে সংহতি ও পারস্পরিক সহযোগিতা নেই তা নিতান্তই বলা অনুচিত কিন্তু এই সকল সংহতি ও পারস্পরিকতা সমস্তরই অভিমুখ, লক্ষ্য সংঘাত, দখল, ধ্বংস। সমাজদ্বান্দ্বিকতার আত্মঘাতমূলক উপকরণসমূহ নিবার্য ও পরিত্যাজ্য, সংঘাতমূলক সাম্প্রদায়িকতা অবশ্য কাম্য নয় মানব সভ্যতার জন্য।

সাম্প্রদায়িকতা যদিও সভ্যতার ছায়ার মতো, সামাজিক বৈচিত্র্যের শর্তও এটি। বস্তু/ব্যক্তির ছায়া যেমন অবিচ্ছেদ্য, তেমনই সভ্যতার ছায়ারূপ সাম্প্রদায়িকতাও সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য, এখনো পর্যন্ত বটে, তবু, যেহেতু সংঘাতমূলক সাম্প্রদায়িক কোনো প্রকার কর্মকাণ্ডকেই মৌলিক দাবি করা যায় না, যা মানব সভ্যতার জন্য বিষস্বরূপ, সুতরাং এর তিরোধানের সম্ভাবনাও স্বীকার্য। এবং সে প্রক্রিয়াও সচল আছে মানবসমাজের কাঠামের ভিতরেই। তবে তার সক্রিয়তার মাত্রা কতোটুকু ও ধ্বংসাত্মক, সংঘাতমূলক সাম্প্রদায়িকতা ক্রিয়া করবার অনুঘটক, সহায়ক উপাদানগুলোর বিপরীতে কীভাবে তা ক্রিয়া করছে তার স্বরূপ নিরূপণ জরুরী। এটি প্রশ্ন হতে পারে না যে, তাহলে সাম্প্রদায়িকতার মতো সভ্যতার অপচ্ছায়া থেকে মানুষের মুক্তি আসবে কবে ও কিভাবে? প্রকৃত মুক্তি প্রয়োজন সংঘাতমূলক সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডের থেকে। আলো-ছায়ার বিজ্ঞান সূত্রেই আমরা জানি ছায়া দূরিভূত হয় আলোতে। সুতরাং আমাদের অন্তর-বাহিরে, পরিপার্শ্বে, অস্তিত্বে সকলমুখী আলোক প্রক্ষেপণে এই সংঘাতরূপক অপচ্ছায়া দূরীভূত হবে প্রত্যাশা। তবে এও সত্যি যে ছায়ার জন্য বস্তু/ব্যক্তি/সমাজই কেবল শর্ত নয়, এর জন্য অনিবার্য শর্ত হলো অন্ধকারের অস্তিত্ব। যদি আলোকের মুখে বস্তুর বিপরীতে অন্ধকার না থাকে তো ছায়া অস্তিত্বমান হওয়া শর্ত সাপেক্ষে অসম্ভব। ফলত, লক্ষ্য তবে ছায়াহনন নয়, তিমির হনন। আলোক প্রক্ষেপণে ছায়া দূর হয় না, দূর হয় অন্ধকার, ফলত ছায়া অস্তিত্বমান হবার সম্ভাবনাও মুছে যায় কিংবা তা আলোকের উজ্জ্বল অঙ্গ হয়ে ওঠে সেই ছায়া। এমন হলে সভ্যতার ছায়ারূপক সাম্প্রদায়িকতাকে তখন নেতি-দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার দরকার পড়ে না। এমনও ভাবা যায় যে, সম্প্রদায়বোধ তো সভ্যতা বিকাশের বীজবস্তু! এই বীজবস্তুকে অপচ্ছায়া ভাববার পিছনের কারণসমূহেই আলো ফেলা বাঞ্ছনীয়। আলো-আঁধারির সাপেক্ষ উপস্থিতি ও অনুপস্থিতিতে পরিস্থিতি দাঁড়ায় এমন যে, আলোর উপস্থিতিতে অন্ধকার তিরোহিত আর আলোর অনুপস্থিতিতে অন্ধকারের গ্রাস ও দুর্বল আলোর মুখে ছায়া হলো অন্ধকারের প্রতিক্রিয়া। সুতরাং বলা যেতে পারে অন্ধকারও আদি সত্য। মানুষের নানা রকম অজ্ঞানতা এর আধার। আর আলোকটুকু হলো মানুষের প্রয়োজনের নব আবিষ্কার, মানুষের অদম্য ইচ্ছের ঝলক। আর বিপরীতে অদৃশ্য, অজানা, অদেখাকেই অন্ধকার অভিধায় চিনতে পারা যায়, ফলত, অজানাকে আবিষ্কারে মানুষের আলোক প্রক্ষেপিত পদক্ষেপ, দ্বন্দ্বের পথে রূপান্তরশীলতায়, যেখানে সভ্যতার বীজবস্তু অন্ধকারের আধার হয়ে ওঠে। এই হলো সম্প্রদায়, সাম্প্রদায়িকবোধের কালিক পরিস্থিতি।

কালিক পরিস্থিতি বুঝতে অবশ্যই ইতিহাসের দিকে মানুষকে মুখ ফেরাতে হয়। বিষয়টি এমন নয় যে মানুষ তার পিছনে চোখ ফেরায় না। আবার এমনও নয় যে সে (মানুষেরা) একবার তার ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে আর সেখানে চোখ ফেরাতে চাইনি। মানব সৃষ্টির আদি থেকে বর্তমান পর্যন্ত একটি কাল পরিক্রমণ আছে। সে পরিক্রমণকে বিভাজিত করে দেখা হয়, সে যেমন বিভাজনই হোক না কেন, সেখানে মানুষের সংঘাতচর্চার বিবরণ রক্ষিত আছে কিংবা তা লিপিবদ্ধ না থাকলেও তার ইঙ্গিত সূত্র আছে কোনো না কোনো রূপে। প্রাকইতিহাস কিংবা ঐতিহাসিক পর্ব, বহু সভ্যতার উত্থান ও পতন, সবখানে সংঘাত সত্য। সংঘাত যে কেবল স্বার্থ চিন্তা থেকেই মানুষের মধ্যে ক্রিয়া করেছে, এই দাবিটির অকাট্যতা নাকচ করতে চাই।

পূর্বেই বলেছি সৃষ্টির আদিতেই মানুষের জন্য সামাজিক অবস্থান সত্য ছিলো, কেন না কখনোই মানুষ একাকী বাস করেনি। পৃথিবীর বিস্তৃত ভূমিতে বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিলো এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়ের সাথে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের সাক্ষাৎ না হয়ে থাকলেও তারা সকলেই বিচ্ছিন্ন ছিলো না। তাদের কারো কারো সাক্ষাৎ হয়েছিলো এবং কোথাও তাদের মধ্যে সংশ্লেষও হয়েছে আবার কোথাও হয়নি। এই সংশ্লেষ হওয়া বা না হওয়ার পিছনে যে নিরাপত্তাজনিত কারণ নিহিত ছিলো বলাই যায়, কেন না, তখন সচেতনভাবে না হলেও নিরাপত্তা বিধান করা একটি স্বার্থ ছিলো বটে। তখন তারা না বুঝুক, এই সময়ে এসে বলতে পারি তা স্বার্থ ছিলো অবশ্যই। ফলত, বলাই যায় যে সংঘাতের জন্য ব্যক্তি মালিকানার বোধ জন্মানো একমাত্র শর্ত ছিলো না সমাজের জন্য; ক্ষুদ্র সম্প্রদায়সমূহের আত্মবোধকেও এক ধরনের মালিকানাবোধের বীজসূত্র ভাবা যায়। আর এখন সম্প্রদায়গত সংঘাতের যে রূপ দেখি, যা আজ এতো ভাবিত করছে, সেখানে পৌঁছতে দীর্ঘ পরিবর্তনের পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।

পরিবর্তনের পথে আছে সংস্কৃতি নির্মাণ। এবং সংস্কৃতি ভেঙে আবার নতুন সংস্কৃতি নির্মাণ। এই কারণেই মানুষকুল পশুকুল থেকে অগ্রসর প্রাণী, প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আজ পর্যন্তও পশুর মতো মানুষেরও জৈবিকতা সত্য হওয়া সত্ত্বেও এবং জৈবিকতা মানুষের জন্য অনিবার্য। ফলত, মানুষের যূথবদ্ধতা বা সম্প্রদায় সংগঠনে তার জৈবিকতা কারণ বীজ ছিলো, এর সাথে ছিলো প্রকৃতি প্রদত্ত মেধা ও তার উন্মেষ। তবে কোথাও অতি-প্রাকৃতিক শক্তি মানুষের জন্য সত্যি হয়ে ধরা দেয়নি। যতবার মানুষ ঠেকে গিয়েছে ততোবার অতিপ্রাকৃতকে ডেকে তার ফল হয়নি, আর হয়নি বলেই মানুষকে আত্মনির্ভর হতে সংস্কৃতিবান হতে হয়েছে। মানুষের প্রয়োজনে অতিপ্রাকৃত ক্রিয়াশীল থাকলে মানুষের সংস্কৃতি নির্মাণের কৃতিত্ব সত্যি হতো না। ফলত, প্রাথমিক ধরনের সাম্প্রদায়িকতার ভিতর ধর্মবিশ্বাসগত সাম্প্রদায়িকতা চিহ্নিত হয় না।

এখন সবচেয়ে আলোচিত যে-ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার অস্তিত্বের কারণ আর্থ-রাজনৈতিক নিশ্চয়ই। কিন্তু, তা কিছু সত্ত্বেও কীভাবে মানুষের মনে অতিপ্রাকৃতিকতা বাসা বেঁধেছিলো? প্রশ্ন হতেই পারে। এর কারণটি ছিলো মহাবৈশ্বিক ও মহাকালিক মানুষের অনিশ্চয়তাবোধ। কেন না, সমাজ জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে, মানুষের সমস্যা বেড়েছে বৈ কমেনি। প্রাকৃতিক কম, বরং মানুষ স্বসৃষ্ট জটিল সম্পর্কজালে, বহুবিধ ঘটনা পরম্পরার কার্য-কারণ ও প্রতিক্রিয়ার অমোঘ এক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়; ফলে তার হতাশার শেষ আশ্রয় হয় আত্মকৃত বোকামি বা অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস। আত্মকৃত বিশ্বাসে মানুষ বাঁধা পড়ে আষ্টে-পৃষ্ঠে, ফলে এই বিশ্বাস ধরে টান দিলে মানুষ তখন পুতুলের মতো নড়ে ও নাচে। এবং ফলে এই প্রকারে তার বিশ্বাস ও ধর্মচেতনা, জন্ম দেয় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার, আর তা হতে পারে সাম্রাজ্য বিস্তারের হাতিয়ার। এটা কি মানুষের আত্মকৃত অন্ধকার নয়? কিন্তু এই সকল কিছুর মধ্যেই মানুষ জৈবিকতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। ফলত, মানুষের আত্মকৃত এই অন্ধকার তার জৈবিকতার সাথে একাকার হয়। ফলে সাম্প্রদায়িকতাকে মানুষ থেকে আলাদা করা সম্ভব হয়নি। তার দরকারও নেই, কেবল একে সদার্থকে প্রয়োগ করলেই মানব সভ্যতা বর্তে যেতে পারে।

মানুষের জৈবিকতা ভিন্ন তার আর্থ-রাজনৈতিক বাস্তবতার অস্তিত্ব কোথায়? সুতরাং মানুষের সভ্যতার দাবি করা হলেও মানুষ প্রকৃতই সভ্য হয়েছে এই দাবি এখনো পর্যন্ত জোর দিয়ে দাবি করা চলে না। মানুষের সভ্যতাকে কেবল কাঠামোগত রূপেই বেশি চিনেছে মানুষ, যা মানুষের বস্তুগত সংস্কৃতি বলে চিহ্নিত; কিন্তু মানুষের যে অবস্তুগত সংস্কৃতি তা মূলত মানুষের জৈবিকতার অবদমনের পদ্ধতিগত প্রচেষ্টার ফল, বলা যায়। এই পদ্ধতিগত প্রচেষ্টাতেই মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামাজিক সম্প্রদায় বা স্বল্পায়তনিক ভৌগলিক গোষ্ঠীসমূহ তাদের কলেবর বাড়িয়েছে; তৈরি হয়েছে ক্ল্যান, ট্রাইব, পাড়া, গ্রাম, নগর, নগর রাষ্ট্র, রাষ্ট্র, মহাদেশ কিংবা সাম্রাজ্য। এই সবগুলির সাথে ভৌগলিক সীমায় সীমায়িত, ভাষা-সংস্কৃতির সমরূপতা, অন্যদের থেকে স্বাতন্ত্র্য, স্বনির্ভরতার সাথে সাম্প্রদায়িকতা সত্যি হয়ে ছিলো এবং আছে।

এই বিকাশের পরিক্রমায় কোথায় এসে মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও মালিকানার ধারণা জন্মে তা আমরা চিহ্নিত করতে পারি এবং তা কীভাবে এই বিকাশে ক্রিয়াশীল ছিলো তারও বিবৃতি আমরা লিপিবদ্ধ করেছি আমাদের ইতিহাসে। এই বিকাশ ও বিস্তারের পেছনে মানুষের জৈবিকতা কাজ করেছে পুনঃ উল্লেখ্য, জৈবিকতার মধ্যে মানুষের খাবার-দাবার, নিরাপত্তা, যৌনতা, সামাজিক স্বীকৃতি পাবার আকাঙ্ক্ষা, কৃতিত্ব দেখানোর জন্য দক্ষতা অর্জন, ক্ষমতা অর্জন ও প্রয়োগও অন্তর্ভুক্ত হয়। এই জৈবিকতার স্বরূপটিকে ব্যক্তিস্বার্থ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি, কেন না, পরিবার নয় ব্যক্তিই সমাজের মৌল সংগঠন। ব্যক্তি তার ভূমিকা পালনের মাধ্যমে বহুজনের সাথে এক সম্পর্কজালে যুক্ত হয়, ফলত সে পরিবারের বাহিরেই এক সংগঠন কাঠামো তৈরি করে ভূমিকা কেন্দ্রে থেকে। অনুরূপ প্রত্যেক ব্যক্তিই করে থাকে। ফলে সাম্প্রদায়িকতার সূত্র ব্যক্তি স্বার্থের মধ্যেই যে বেশি নিহিত তা দাবি করতে চাই। এখানে প্রশ্ন হতে পারে, তবে, রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে কি গৌণ করে দেখা হচ্ছে? প্রকৃত পক্ষে রাষ্ট্রস্বার্থ বা গণমানুষের স্বার্থ বলে কোনো এখনও বিশ্বে কোনো কিছুকে চিহ্নিত করা যায় না, সব খানে ব্যক্তি স্বার্থই প্রধান। সে প্রাচীন সম্প্রদায় গঠনেও সত্যি। প্রাথমিক ধরনের ক্ষুদ্র সম্প্রদায়সমূহে ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিকতা ছিলো না। কিন্তু যখন থেকে ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দাঁড়িয়েছে, তখন থেকেই কোনো ব্যক্তি সেই প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা কাঠামোর কেন্দ্রে যেতে চেয়েছে, শাসক হতে চেয়েছে, তা গণমানুষের স্বার্থে নয় অবশ্যই, সেখানেও তার ব্যক্তি স্বার্থই প্রধান।

আদিম ক্ষুদ্রায়তনিক সম্প্রদায়ে প্রত্যেক ব্যক্তির আলাদাভাবে প্রাধান্য ছিলো, সমাজ ইতিহাস থেকে জানা যায়। কিন্তু এখন এই বিকশিত সমাজে তা থাকলেও অপর ক্ষমতাবান ব্যক্তি কর্তৃক অগ্রাহ্য হয় প্রতিনিয়ত। সকল সংগঠনেই তা এখন সত্যি। ফলে, রাষ্ট্র হলো এই প্রক্রিয়ায় জনগণ ও শাসকের মধ্যে প্রত্যাশা, অধিকার, দাবি ও তা অগ্রাহ্য করবার সংঘাতের নাম। এই সংঘাতে শাসক জিততে গিয়ে জনগণকে মেকি রাষ্ট্র স্বার্থ বা অন্য কোনো স্বার্থের নামে সংহত করে ও তার শাসন টিকিয়ে রাখতে চায়। এইরূপেই জাতীয়তাবোধ শেষে রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতার রূপই পরিগ্রহ করে। রাষ্ট্র ও জাতিগত সম্প্রদায়ের মধ্যে সমষ্টিগত চেতনা যদিও তীব্র, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিকে উপেক্ষিত হতে দেখা যায়। আর ক্ষমতার কেন্দ্রে যিনি যান, তিনি তার ব্যক্তি স্বার্থই চরিতার্থ করেন। ক্ষমতা প্রদর্শন, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা কিংবা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য, ক্ষমতার অহং রক্ষার জন্য সাম্রাজ্য বিস্তারের মতো মহা যজ্ঞে শাসকদের লিপ্ত হতে দেখা যায়, এতে ধর্মীয় বিশ্বাসকেই সব চেয়ে বেশি সহায়ক হতে দেখা যায়। কেবল ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাই নয়; আরো আছে বর্ণবাদী সাম্প্রদায়িকতা, শ্রেণীগত সাম্প্রদায়িকতা যা খুব সহজেই সংঘাতকে উস্কে দিতে পারে। কিন্তু, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাই বিস্ফোরক হিসেবে চিহ্নিত।

সাম্রাজ্য বিস্তারের শর্ত ছিলো মানুষের চেতনায় বস্তুগত ভৌগলিক সীমার ধারণাকে ভেঙে দেয়া ও একটি অবস্তুগত, চৈতন্যগত অধরা সীমার অস্তিত্বকে মানুষের ধারণায় আনা। এই ধারণাবশত সকল মুসলিম এক সম্প্রদায় ভুক্ত হতে পারে, সকল কালো মানুষগুলো এক সম্প্রদায়ের, সকল সাদাগণ এক সম্প্রদায়ের কিংবা সকল হিন্দু ও খৃষ্টানগণ একেকটি সম্প্রদায় ভুক্ত ভাবতে পারেন কিংবা আরো বাড়িয়ে এটিকে শ্রেণীগত সম্প্রদায়ে বিবেচনা করা যায়; এখানে শ্রমিক শ্রেণী একটি সম্প্রদায় ও পুঁজিপতি শাসক-শ্রেণী আরেক সম্প্রদায় ভুক্ত। এই ধারণাগুলোর কোনো একটিকে প্রকট করে যুদ্ধকে উস্কে দিয়ে রাষ্ট্রসীমা ভেঙে বৃহত্তর সীমা বা সাম্রাজ্যের দিকে যাওয়া শাসকদের কৌশল। এই সাম্রাজ্যও ছিলো এক ভৌগলিক সীমা ভেঙে আরেক ভৌগলিক সীমার নির্ধারণ করা। কিন্তু, সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট কাল সীমা পর্যন্ত এই কৌশলটি কার্যকর ছিলো, কেন না, তার পরে তো সাম্রাজ্যের ধারণাই বদলে যায়, বদলে ফেলা হয়। এর পরে সাম্রাজ্য চিহ্নিত হয় অর্থনৈতিক সীমায় চিহ্নিত করে। এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য, পুঁজি দখলই সাম্রাজ্য দখলের নামান্তর হয়ে ওঠে। তবে এই ক্ষেত্রেও সাম্প্রদায়িক সংঘাত সমান কার্যকর থাকে।

ফলত, সম্প্রদায় চেতনায় এখন আর অতীতের মতো সংহতির অস্তিত্ব সামান্যই। সম্প্রদায় আর সংহতি নয়, হাজারো নামের, নানারূপক ও মাত্রিক বিভাজনের নাম হলো সম্প্রদায়। সংঘবদ্ধতার আবরণে সংঘাত ও বিভাজন টিকে থাকে, আর ব্যক্তি উপেক্ষিত হতে থাকে ক্ষমতা কেন্দ্রিক ব্যক্তি স্বার্থের কাছে। চরমতম কল্যাণ রাষ্ট্রেও নাগরিক পায় ন্যুনতম সুবিধা। আর আধুনিক রাষ্ট্রসমূহে জাতীয়তাবোধ, জাতিগত (Nationality) সাম্প্রদায়িকতাও সংহতির ভান মাত্র, বহু বিভাজনের আবরণ মাত্র সাম্প্রদায়িকতা।

উপসংহারে বলি, রচনাটিকে সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ে বিস্তৃত অধ্যয়নের জন্য প্রস্তাবনামূলক প্রচেষ্টা হিসেবেই আমার তরফ থেকে দেখা। এখানে সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ে বেশ কিছু হাইপোথিসিস সন্নিবেশিত হয়েছে যা সাম্প্রদায়িকতা প্রত্যয়টির ক্রমপরিবর্তশীলতার সাপেক্ষে উল্লেখিত হয়েছে, কেন না, বিষয়টি যদিও সর্বকালীন কিন্তু এর স্বরূপ চিরকাল একই রকম থাকেনি, থাকছে না এবং বলাই যায় যে একই রকম থাকবেও না। সমাজ একটি সামষ্টিক ব্যবস্থার নাম, কিন্তু সমাজ ব্যবস্থাটিও বহু বহু পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্কিত সামাজিক অঙ্গ-ব্যবস্থাসমূহের সমষ্টিই। আর এই অঙ্গ-ব্যবস্থাসমূহের অন্তর্দ্বন্দ্বসমূহ যা সামাজিক ক্রমরূপান্তরশীলতাকে সচল রাখে সম্প্রদায় বা সাম্প্রদায়িকতাও তার থেকে বিচ্ছিন্ন কিছুতেই নয়। এর সম্যক স্বরূপ বুঝতে সমগ্র সমাজব্যবস্থাকেই পাঠের আওতায় এনে দেখা বাঞ্ছনীয়।

আপনার মন্তব্য