যুদ্ধাপরাধী মুজাহিদের রায় এবং আমাদের অনুবাদ

 প্রকাশিত: ২০১৬-১১-২৩ ১৭:১৯:২৮

দেব প্রসাদ দেবু:

“তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা
সকিনা বিবির কপাল ভাঙল
সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর”।

কিন্তু হায়েনাদের কে চেনালো লোকালয়ের সকিনা বিবি, হরিদাসীদের? কে বলেছিলো-

‘এ আন্দোলন মুক্তির নয়, হিন্দুদের গোলাম বানাবার আন্দোলন এবং এখান থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের খতম করে এটাকে স্পেন বানাবার আন্দোলন’। [সূত্র: দৈনিক সংগ্রাম, ১০.০৯.৭১, উপসম্পাদকীয়, অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র, যুক্তি নয়’- মুজাহিদ]

কিংবা ১৯৭১ সালে বদর দিবসের র‍্যালিতে কে বলেছিলো-

‘আজ থেকে কোন পাঠাগারে হিন্দু লেখকদের বা প্রো-হিন্দু মুসলিম লেখকদের লেখা কোন বই থাকতে পারবে না। এই ধরণের বই পেলে জ্বালিয়ে দেয়া হবে’। [সূত্র: দ্যা অবজারভার, ০৮.১১.৭১]।

বলেছিলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী এবং তৎকালীন বদর বাহিনী প্রধান কুখ্যাত আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ। পাকিস্তানের প্রেতাত্মা বয়ে চলা এই নর পশুরা রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন সুযোগে পাকিস্তানের আদলে প্যান ইসলামিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করার স্বপ্ন দেখেছিলো ৩০ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে। যারা আঘাত করার উদ্ধত দেখিয়েছিলো বাঙালি জাতিসত্তার ভিত্তিমূলে।

কিন্তু ইতিহাস কোন ফিনিক্স পাখির ডাক নয়। বাংলাদেশে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই বললেই ইতিহাসের পাতা ফাঁকা হয়ে যায় না। বরং ক্র্যাক প্লাটুনের মতো গেরিলা-যোদ্ধাদের উত্তরসূরি প্রজন্ম কখনো ভুলতে পারবে না ২৫ মার্চের বর্বরতা। ভুলতে পারবে না জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের উপর চালানো পাশবিকতা, ভুলতে পারবে না গেরিলা সহ অগণিত মুক্তিকামী মানুষের উপর চালানো নারকীয় নির্যাতনের কাহিনী; আমরা ভুলি নি কিছুই, ভুলবো না কিছুই।

সেই না ভোলার ইতিহাসের পাতায় অবহেলায় জমে বসা পলেস্তারা খসাতে আমাদের আপিল বিভাগ অত্যন্ত প্রজ্ঞা এবং বিচক্ষণতার সাথে সেই সব ঘটনা প্রবাহকে প্রাসঙ্গিক ভাবে তুলে এনেছেন মানবতা বিরোধী নর ঘাতক মুজাহিদের রায়ে। জানা ইতিহাসই আপিল বিভাগ উল্লেখ করেছেন ঘটনার ভয়াবহতা এবং ফ্যাক্টগুলোকে আরো একবার মনে করিয়ে দিতে, যাতে করে টুলি পড়া চোখে ইতিহাস পড়ুয়ারা যাতে বুঝতে পারে স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরেও কেন এই গণহত্যার চুলচেরা বিচারের প্রয়োজন পড়লো; কেন আমরা পারি না শহীদের রক্তের সাথে বেইমানি করে ‘মিলেমিশে’ থেকে দুঃসহ পরিবেশে বুক ভরে নিশ্বাস নিতে।

আমরা আম্মা জাহানারা ইমামের কথা ভুলি নি, ভুলিনি আম্মা সাফিয়া বেগমের কথাও। যেই সাফিয়া বেগম স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কখনো বিছানায় ঘুমান নি, ঘুমিয়েছেন মাটির উপর শতরঞ্জি পেতে। কী শীত, কী গ্রীষ্ম, কী বর্ষা। মুখে দেন নি এক মুঠো ভাতও। কারণটা আমাদের অজানা নয়। কারণ নিজ হাতে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন আমাদের প্রিয় অগ্রজ ক্র্যাক প্লাটুনের দুর্ধর্ষ সদস্য আজাদ, সাফিয়া বেগমের বুকের ধন বদর বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর নৃশংস নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত প্রায় অবস্থায় মা’য়ের কাছে ভাত খেতে চেয়েছিলেন। আম্মা ভাত নিয়েও গিয়েছিলেন প্রিয় সন্তানের জন্য, কিন্তু আজাদের দেখা আর পান নি। দেখে এসেছেন তাঁর বুকের ধনকে পিটিয়ে ফেলে রাখা হতো মাটিতে। আম্মা কী করে মাটিতে শোবেন? আজাদকে না খাইয়ে কিভাবে খাবেন ভাত?

শুধু আজাদ নয়, একাত্তর সালের ২৯শে আগস্ট রাতে এক যোগে অভিযান চালিয়ে ক্র্যাক প্লাটুনের বেশ কিছু গেরিলা যোদ্ধাকে ঢাকা শহরের নানা জায়গা থেকে গ্রেফতার করে ফেলে পাকিস্তান আর্মি। যেই দুর্ধর্ষ গেরিলাদের নিয়ে কবি শামসুর রহমান লিখেছিলেন “তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছ হাত ধরে পরস্পর”। এদের মধ্যে ছিলো বদি, রুমি, আজাদ, জুয়েল, সামাদ, মাসুদ সাদেকসহ ক্র্যাক প্লাটুনের অনেক গেরিলা। কিন্তু, কে ধরিয়ে দিয়েছিলো এঁদের? ইতিহাস ভিত্তিক ফিকশন আনিসুল হকের মা’তে আজাদের গ্রেফতার নিয়ে উল্লেখ আছে কামারুজ্জামান নজর রাখতো আজাদদের বাড়ির উপর এবং সে ছিলো তখন পাকিস্তান বাহিনীর ইনফরমার। এবং সে-ই ধরিয়ে দিয়েছিলো আজাদকে।

ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য ছিলেন জহিরুদ্দিন জালাল। বিচ্ছু জালাল হিসেবে যিনি বেশি পরিচিত ছিলেন। নিউ ইস্কাটনের এক বাসায় আর্মি এবং রাজাকারদের মিটিং হবার কথা ছিলো। ৩০শে আগস্ট তাঁর কমান্ডার সেই বাসাতে আক্রমণ করার জন্য রেকি করতে পাঠানো। দুর্ভাগ্য বিচ্ছু জালালের। আর্মির হাতে ধরা পড়ে যান তিনি। তাঁকে নিয়ে আসা হয় নাখালপাড়ার এক বাড়িতে নির্যাতনের উদ্দেশ্যে। এখানে এসে তিনি আগের রাতে গ্রেফতার হওয়া ক্র্যাক প্লাটুনের অনেক সদস্যকে দেখতে পান। অমানবিক নির্যাতন করে আটকে রাখা হয়েছে তাঁদের।

বিচ্ছু জালালের ভাষ্য থেকেই দেখি কী হয়েছিল সেখানে,

“আর্মিরা জিপে চড়ে বাংলা মোটর মোড় দিয়ে ডানে সোজা তেজগাঁ এম,পি, হোস্টেল গলি দিয়ে কিছুটা সামনে গিয়ে হাতের ডানে একটি গলির ভিতর দেড় তলা একটি দালানে আমাকে ঢুকাল। পরে জেনেছি এই বাড়ীটি পশ্চিম নাখাল পাড়ার ১১২ নম্বর বাড়ী ছিল। সন্ধ্যা ৭টায় একটি বাসের শব্দ কানে ভেসে এলো। আর্মির জুতার খট খট শব্দে আমার রুমের সামনে কিছু আর্মি এলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার বন্দী রুমে আট দশ জন লোককে কুঁজো বাঁকা অবস্থায় ঢুকাল। তাদের দিকে চোখ ফেরাতেই আমি চমকে উঠলাম। আমি বোবার মত হয়ে গেলাম। দেখলাম ঐ ৮/১০ জন লোক সবাই মুক্তিযোদ্ধা, যাদের সাথে আমি মতিনগর ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। তাদের মধ্যে বদি, জুয়েল, আজাদ, রুমি ভাইকে দেখতে পেলাম। পাশে আরেক জন ছিল যার নাম আলতাফ মাহমুদ যিনি একুশে ফেব্রুয়ারির গানের সুরকার। সবার চেহারা ছিল বীভৎস, ক্ষত-বিক্ষত। বদি ভাইকে দেখলাম তার দুহাতের আঙুল কেটে দিয়েছে এবং তার পুরো চেহারায় আঘাতের চিহ্ন ফুলে উঠেছে। কোন ভাবেই সে মাজা সোজা করতে পারছিল না। আজাদ ভাইয়েরও আঙুল কেটে নিয়েছিল এবং তার বাম কানে তখনও রক্ত জমে ছিল। দেখলাম বদি ভাইয়ের ডান চোখ কমলার মত ফুলে উঠেছে, চোখের মনি দেখা যাচ্ছিল না, তার বাম চোখ ক্ষত-বিক্ষত ফুলানো ছিল, তার আঙুলও কেটে ডান হাত বাঁকা করে দিয়েছিল। আলতাফ মাহমুদের ঠোট দুটো পুরো শশার মত ফুলানো ছিল। তারো ডান হাত বাঁকা করে দিয়েছিল। জুয়েল ভাইয়ের কাছে কথা বলার সময় দেখলাম তার দুহাতের আঙুল নেই। তারও বাম দিকের কানের নিচে রক্তের জমাট ছিল”।

এখানেই বিচ্ছু জালাল এই সব অত্যাচারের নেপথ্য ব্যক্তিদের দেখতে পান। ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদের এরকম পৈশাচিক নির্যাতন, এমন ছিন্ন-ভিন্ন অবস্থার পিছনে দুইজন ব্যক্তি ছিলো। এরা জন্মসূত্রে বাঙালি, কিন্তু মানসিকতায় পাকিস্তানি। আলবদর বাহিনী গঠন করে বাঙালিদের স্বাধীনতার স্পৃহাকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল তারা। এরা হচ্ছে মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ। বিচ্ছু জালাল এ বিষয়ে আরো বলেন:

“ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের সাথে মতিউর রহমান নিজামী ও মুজাহিদ সহ ৩/৪ জন লোক অস্ত্র হাতে আমার রুমের সামনে দিয়ে ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের রুমে গেল। জুয়েল ভাই মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে দেখিয়ে বললো এরাই এবং আরো কয়েকজন তাদেরকে এইভাবে টর্চার করেছে। আরো বললো যে কোন সময় মুজাহিদ, নিজামী তাদের মেরে ফেলতে পারে। ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের কাছে তখন দুজন সৈনিক এসে কিছু কথা বলতে চাচ্ছিল। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম আমাকে রুম থেকে বের করে নিয়ে আসার জন্য হাবিলদার গুলকে পাঠাল। হাবিলদার গুল আমাকে নিয়ে ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের সামনে দাড় করাতেই সাদা কাগজে নাম লিখে দস্তখত নিলো এবং মাদারচোৎ বাইনচোৎ বলে গালি দিয়ে সত্য কথা বলার জন্য চাপ দিতে থাকল। তখন নিজামী তার কোমরে রাখা ফাইভ স্টার পিস্তল হাতে নিয়ে মাদারচোৎ গালি দিয়ে জিজ্ঞাসা করল ভিতরে থাকা বন্দীদের সাথে কি কথা বলেছিস, তুই কিভাবে ওদের জিনিস, কতদিন যাবত ওদের সাথে পরিচয় জানতে চেয়ে পিস্তল দিয়ে আমার দুহাতের কব্জির উপর জোরে একের পর এক আঘাত করতে থাকল। পিস্তলের আঘাতে আমার দুহাতের আঙ্গুল চামড়া ছিঁড়ে রক্ত বের হতে থাকল। তারপরও আমি মুখ না খুল্লে আমাকে হুমকি দিল বাসা থেকে আমার মাকে, বোনকে তুলে আনবে। তখনই পাশে দাড়িয়ে থাকা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ওই সময় মইনউদ্দিন নামে একজনকে ডাকলে অস্ত্র হাতে সে ঘরে ঢুকল। মুজাহিদ তখন মইন উদ্দিনের হাত থেকে স্টেনগান টেনে নিয়ে আমাকে মাদারচোৎ গালি দিয়ে আমার মাথার পিছনে বাট দিয়ে আঘাত করল। সাথে সাথে ফিনকি দিয়ে মাথা রক্ত ঝরছিল। তারপর প্রচণ্ড জোরে লাথি মেরে আমাকে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে মারতে থাকল। আমাকে মাটি থেকে নিজামী, মুজাহিদ দুজনে গর্দান টেনে তুলে বন্দীদের রুমে নিয়ে গেল। মুজাহিদ বন্দীদের হাল দেখিয়ে আমাকে বলল যে- সত্য কথা না বললে তোকেও এই হাল করব। মুজাহিদ জিজ্ঞাসা করছিল ২৫ আগস্ট ধানমণ্ডি আর্মিদের বিরুদ্ধে যে অপারেশন করেছিল সেই অপারেশনে তোর সাথে কে কে ছিল এবং তোদের হাতে কি কি অস্ত্র ছিল। আমি কথার জবাব না দিলে আবার আমাকে লাথি, গুঁতা মেরে ফ্লোরে ফেলে দেয়। তখন মুজাহিদ রুম থেকে বের হয়ে ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের রুমে গিয়ে নিজামী ও মুজাহিদ দুজনেই বলতে থাকে ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে সেই সাধারণ ক্ষমার আগেই ২/৩ দিনের মধ্যেই ঐ হারামজাদা, গাদ্দার বদি, রুমি, জুয়েল, আজাদ, আলতাফদের সাথে এই পিচ্চিকেও (আমাকে) গুলি করে লাশ গুম করে দিতে হবে”।

এসবের পাশাপাশি মাননীয় বিচারপতিগণ রায়ে ২৫ মার্চের ভয়াবহতাকে তুলে এনেছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম সহ গ্রহণযোগ্য বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে। যেটা নতুন প্রজন্মকে বিশ্বাসযোগ্য একটি ইতিহাসে চোখ বুলাতে সাহায্য করবে। আগ্রহী করবে এই ইতিহাসকে বিস্তারিত জানতে।

উল্লেখিত আন্তর্জাতিক সংবাদ গুলোতে আমরা দেখতে পাই, বাঙালী নিধনের ‘বিনোদন’ দেখার জন্য রাও ফরমান আলীরা ইজি চেয়ার, সোফা পেতে, চা-কফির আয়োজন করে রাত দশটা থেকে কর্ডিনেট করছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাসাকার। যেই ম্যাসাকারে মেশিনগান, কামানের গোলায় জাস্ট উড়ে গিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, ইকবাল হলের শত শত ছাত্র। আবার কোন ক্রমে মৃত্যু এড়িয়ে যারা বেঁচে ছিলো সেই রাতে তাঁদেরকেই সকালে লাগানো হয়েছে লাশ টানার কাজে। লাশ টানতে টানতে ক্লান্ত ছাত্ররা একটু ধীর লয়ে হয়ে আসলে তাঁদের সারি বদ্ধ ভাবে দাঁড় করিয়ে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে তাঁদেরই টেনে আনা লাশের স্তূপের সঙ্গে। হাজারো লাশের সাথে পড়ে ছিলো আমাদের গর্ব প্রফেসর জি সি দেবের দেহ। আমরা ভুলে যাবো এসব? মিলেমিশে থাকার নামে বিস্মৃতির উপরই দাঁড়িয়ে থাকবে আমাদের ইতিহাস? আমরা মাথা নত করে মেনে নেবো নিজামী, মুজাহিদের মন্ত্রিত্বের দম্ভ? এই সমাজ বিরোধীরা পদাসীন হবে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে? এতোটা অকৃতজ্ঞ বোধকরি এই প্রজন্ম না।

মুজাহিদ গংদের আইনজীবীর মতো অনেককেই এখন বলতে শোনা যায় ‘মুজাহিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোন হত্যাকাণ্ডের/নৃশংসতার অভিযোগ পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণ সহ আনা যায় নি। যা আইসিটি আইনের ১৬ ধারায় বলা আছে’।

বিবাদী পক্ষের এই অজুহাতের বিপরীতে বিচ্ছু জালাল সহ অন্যান্যদের সাক্ষ্যের বাইরেও মাননীয় বিচারপতিগণ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আদালতের পর্যবেক্ষণ দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন কেন, কখন, কিভাবে সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির দায় বর্তায়। যেমন একটা যায়গায় আদালত প্রসিকিউটর বনাম রুটাগান্ডা, মামলা নং ICTR-96-3 (ট্রায়াল চেম্বার) মামলায় চেম্বারের রেফারেন্স দিয়ে বলেছেন, অন্যের করা অপরাধের দায়ভারও আসামীর উপরে এসে পড়তে পারে, যদি আসামী সেই অপরাধের পরিকল্পনা করে থাকে, যদি অন্য কাউকে প্ররোচিত করে থাকে অপরাধ সংঘটনের জন্য, যদি নির্দেশ দেয় তা সংঘটনের জন্য কিংবা যদি সেই কাজে সহযোগিতা করে অথবা পৃষ্ঠপোষকতা দেয়।

সেমাঞ্জা এবং প্রসিকিউটর, কেস নং ICTR-97-20A(আপীল চেম্বার), মামলার রেফারেন্স দিয়ে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে “ একজন অভিযুক্তকে গণহত্যার সংঘটক বা সহ-সংঘটক হিসেবে সাজা দিতে গেলে এটা জরুরী নয় যে তাকে ‘মূল সমন্বয়কের’ ভূমিকায় থাকতে হবে বা সেই ‘গণহত্যার মূল পরিকল্পনার’ সাথে যুক্ত হতে হবে, এমন কি সেই গণহত্যার জন্য সুনির্দিষ্ট একটি পরিকল্পনার অস্তিত্ব প্রমাণ প্রয়োজনীয় হলেও।

কোর্ডি এবং সারকোজের মামলায় ICTY আপিল চেম্বারের রেফারেন্স দিয়ে বলা হয়েছে, ‘নির্দেশ’ দেওয়াটা হচ্ছে একজন ব্যক্তির কর্তৃত্ব স্থানীয় অবস্থান (position of authority) থেকে অন্য কাউকে অপরাধ সংঘটনের জন্য নির্দেশনা দেওয়া। এর জন্য অভিযুক্ত এবং অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তিদ্বয়ের মধ্যে কোনো আনুষ্ঠানিক ঊর্ধ্বতন এবং অধস্তন সম্পর্ক থাকার প্রয়োজন নেই। অভিযুক্ত যে কর্তৃত্ব স্থানীয় অবস্থানে আছে এবং সেই অবস্থানের কারণে অন্য কেউ বাধ্য হচ্ছে তার নির্দেশনা শুনে অপরাধ সংঘটিত করতে, এটুকুই যথেষ্ট।

আমরা এগুলো পড়ার সময় অনুভব করেছি আপামর জনগণের এই বিষয়গুলো জানা উচিৎ, জানা উচিৎ ইতিহাসের সেই সাক্ষীগুলোর কথাও। যেগুলো খুব গোছানো ভাবে উল্লেখ আছে এই রায়ে। যা একজন সাধারণ পাঠককেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে আগ্রহী করে তুলতে পারে। সেই চিন্তা মাথায় রেখেই আমরা ফরিদ আহমেদ, সাব্বির হোসাইন এবং আমি মিলে চেষ্টা করেছি রায়টাকে সাধারণ পাঠকের পাঠ উপযোগী করে বাংলায় তুলে আনতে।

অনুবাদ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে পাললিক সৌরভ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে আগ্রহীদের কাছে অনুবাদটি নিঃসন্দেহে সমাদর পাবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

আপনার মন্তব্য