শিক্ষকরা যতটা স্বাধীন হবেন, সমাজ ততটাই অগ্রসর হবে : জফির সেতু

 প্রকাশিত: ২০১৬-১২-২১ ১৪:৫৮:৫৭

 আপডেট: ২০১৬-১২-২১ ২৩:১৫:২২

সাক্ষাৎকার গ্রহণে নেসার শহিদ:

ডক্টর জফির সেতুর জন্ম ১৯৭১ সালের ২১ ডিসেম্বর হাওর-নদীবেষ্টিত কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ফেদার গাঁও গ্রামে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি যথাক্রমে ১৯৯২ ও ১৯৯৩ সালে। ২০০৯ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজভাষাবিজ্ঞানের ওপর অভিসন্দর্ভ লিখে লাভ করেন পিএইচ.ডি.ডিগ্রি।

পেশাগত জীবনের প্রথম দিকে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস ক্যাডারভুক্ত হলেও ২০১১ সালে তিনি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে ভারতের ‘ভাষা আকাদেমি বক্তৃতা’, ‘পরেশচন্দ্র স্মারক-বক্তৃতা’ ও বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজ-এর সাউথ এশিয়ান ভাষা ও সাহিত্য বক্তৃতামালায় অংশ নেন।

এছাড়া আসাম বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিভিন্ন সময়। শিক্ষক হিসেবে জফির খুবই প্রভাবশালী এবং সুখ্যাতি অধিকারী। শিক্ষা ও গবেষণায় অসামান্য অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক এ-বছর ডক্টর জফির সেতুকে ‘শিক্ষা অগ্রদূত’ হিসেবে স্বীকৃতি ও সম্মাননা প্রদান করেছে।

কবি ও লেখক হিসেবেও জফির সেতু দুই বাংলায় খ্যাতিমান। কাব্য, গল্পগ্রন্থ, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও সম্পাদনা মিলিয়ে তাঁর সর্বমোট বইয়ের সংখ্যা ২০টি। আমন্ত্রিত কবি হিসেবে তিনি কবিতা পাঠ করেছেন ও আন্তর্জাতিক সাহিত্যসম্মেলনে যোগদান করেছেন দেশ-বিদেশের নানা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে।

জফির সেতুর ৪৫তম জন্মতারিখকে কেন্দ্র করে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন তরুণ প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক নেসার শহিদ

নেসার শহিদ : আমরা জানি, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আপনি শিক্ষক হবার জন্য ক্যাডার সার্ভিসের অন্যপদে পা মাড়াননি। এমনকি পেশাগত জীবনে স্বাধীনতা ভোগ করতে ক্যাডার সার্ভিস ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছেন। আপনার শিক্ষক হবার এই দুর্দমনীয় আকাক্সক্ষার উৎস কী?

জফির সেতু : প্রশ্নের শেষ অংশ দিয়েই শুরু করি। সহজ উত্তর হচ্ছে, আমার শিক্ষকেরা আমার ভেতরে এই আকাক্সক্ষার বীজ রোপণ করে দিয়েছিলেন। সেই শৈশবে শিক্ষকদের আমি নায়ক ভাবতাম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বশির স্যার যখন আমায় পড়াতেন, আমি স্বপ্ন দেখতাম আমি বশির স্যারের মতো মানুষ হব। কেন হব, এটা না-ভেবেই স্বপ্ন তৈরি হয়েছিল। বশির স্যার আমাদের বাড়িতে থাকতেন; গরীব ছিলেন এটাও আমি বুঝতাম। কিন্তু স্বপ্নটা ছিল তাঁকে ঘিরেই। তিনি যখন পড়াতেন আমি মুগ্ধ হয়ে তাঁর দিকে তাকাতাম।

একদিন হলো কী, আমি চেয়ারে পা তুলে পড়ছিলাম, তিনি পা নামাতে বললেন। আরো বললেন, যে-দিন আমার মতো হবে সেদিন পা তুলে বসবে। ব্যস, বশির স্যার হতে হবে আমাকে। এছাড়া আমি খুব ভাগ্যবান বলতে হবে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি এমন কিছু শিক্ষক পেয়েছিলাম, যারা শুধু ভালো শিক্ষকই ছিলেন না, বড়ো মাপের মানুষও ছিলেন। এদের নানারকম প্রভাব আমার জীবনের ভিত তৈরি করেছে। স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক ইতিহাস পড়াতে গিয়ে বারবার সভ্যতার কথা বলতেন। মানবসভ্যতার কথা। বলতেন সভ্যতানির্মাণে শিক্ষকদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। বলতেন শিক্ষরাই জাতিগঠনে বড়ো ভূমিকা পালন করেন। সবসময় আলেকজান্ডারের কথা বলতেন তিনি। বলতেন, অ্যারিস্টটলের মতো শিক্ষক না-পেলে আলেকজান্ডার ‘মহামতি’ হতে পারতেন না। কথাটা আমার মনে ধরেছিল।

পরে যখনই আমি পেশাজীবনের কথা ভেবেছি, যখন শিক্ষক হওয়া ছাড়া আর কোনো স্বপ্ন দেখিনি। একজন মানুষের জীবনে পেশানির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এটা নির্ভর করে মানুষ হিসেবে এই জীবনে আমি আসলে কী চাই? ব্যক্তিমানুষ হিসেবে আমি অনেক কিছুই চাইতে পারি। আমি কাড়ি কাড়ি টাকা চাইতে পারি, সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী হতে চাইতে পারি। আমি প্রধানমন্ত্রীও হতে চাইতে পারি। কিন্তু এসবের আগে জীবনকেও জানতে চাইতে হবে।

জীবন একটাই। জীবন মানে বেঁচে থাকা নয়, বেঁচে থাকতে চায় পশু। মানুষের জীবনকে উদ্যাপন করতে হয়, উপভোগ করতে হয়। অর্থপূর্ণ করে তুলতে হয়। তাই আমার শিক্ষকদের কাছে যেটা জেনেছি আমি, যেখানে জীবনকে মানুষের কাজে লাগানোইটা মহত্বের। সেখানে সভ্যতায় নিজের ন্যূনতম অংশগ্রহণটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। মানুষ হিসেবে আমি ছোটো, মেধাও মাঝারি গোছের তাই ভাবলাম, শিক্ষকতাই আমার জন্য মোক্ষম পেশা হতে পারে। হয়ত এ-ছাড়া আমি আর কোনো যোগ্যতাও অর্জন করিনি।

হ্যাঁ, শিক্ষকরা সকল সভ্যতায় পরম সম্মানীয়-এটা মিথ ছাড়া কিছুই নয়। সম্মান কোনো ভূঁইফোড় জিনিস নয়। এর সঙ্গে আরও অনেক জিনিস জড়িত। মনে রাখতে হবে সভ্যতার আদি শিক্ষক সক্রেটিস মৃত্যুর পূর্বে একটা সামান্য মোরগের ঋণ-পরিশোধের কথা বলেছিলেন। এই স্বীকারোক্তির মাধ্যমে আমরা দুটো ম্যাসেজ নিতে পারি। একটি হলো, কতটা দরিদ্র ছিলেন সক্রেটিস তার উন্মোচন। আর অপরটি হচ্ছে, একজন শিক্ষককে কতটা সৎ হতে হয় তার শিক্ষা। মৃত্যুর পূর্বে যেখানে কিনা তিনি আত্মরক্ষায় তৎপর হবেন, সেখানে কার কাছ থেকে কবে সামান্য একটি মোরগ ধার করে স্ত্রীকে দিয়েছিলেন, তা পরিশোধের জন্য অন্যকে অনুরোধ করছেন!

শিক্ষক সক্রেটিসকে রাষ্ট্র পদাঘাত করেছিল, মর্যাদা দেয়নি। সমাজ করুণা করেছিল দূর থেকে। আজও রাষ্ট্রপক্ষ শিক্ষককে পিটিয়ে মারে। সমাজ দূর থেকে দেখে, আর করুণা নিষিক্ত করে। অবশ্য শিক্ষকরা এতে মরেন বটে, তবে সভ্যতা রক্ষা করে তবে অক্কা পান। এক-দুজন শিক্ষককে নিয়ে সম্মানের মিথ চালু আছে বটে, কিন্তু বাদবাকি ইতিহাসের অন্তরালে, এটা বড়ো বেদনাদায়ক। শিক্ষকরা সকল সময়ই মানবেতর জীবনযাপন করেছেন।

আমাদের দেশে এখনও একজন শিক্ষকের বেতন একজন ড্রাইভারের বেতনের চেয়েও কম। ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সে শিক্ষকের স্থান অনেক নিচে।

চাকরির ক্ষেত্রে আমার হয়ত অন্যখানে যাবার সুযোগ ছিল। চেষ্টা তদবির করলে ‘ভালো পদ’-এ যেতে পারতাম বইকি। শিক্ষকতার পেশা আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রে যে-খুব মর্যাদার তা কিন্তু না। ক্যাডার সার্ভিসে সাধারণ যাদের অন্যপদে হয়না তারা এটা পান। কেউ স্বেচ্ছায় নিয়ে থাকেন। আমি অধিকাংশের কথাই বলছি। এটা কেন? মর্যাদার প্রশ্নে। আমাদের সমাজে শিক্ষক মানে ‘লেম্যান’-গোবেচারা।

এটা কেন হলো, আমাদের ভেবে দেখতে হবে। মানুষ মুখে বলছে শিক্ষক মর্যাদাবান-কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। এটা সামাজিক প্রতারণা। রাষ্ট্র শিক্ষকদের আলাদা বেতনভাতা দেওয়ার সাহস পায়না। রাষ্ট্রের যেমন এতে মনের জোর নেই, তেমনি পেশির শক্তিও নেই। কেননা, ঔপনিবেশিক কালে ভারতবর্ষে রাষ্ট্রব্যবস্থাটাও তৈরি হয়েছে প্রতারণার ভেতর দিয়ে। এই প্রতারণার মোকাবেলা প্রায় অসম্ভব। তো রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক মর্যাদার যেহেতু প্রেজুডিস আমার নেই ভাবলাম শিক্ষক হতে আপত্তি কী?

আমার বাবাও বললেন, গোলায় ধান আছে, পুকুরে মাছ আছে-ভয় নেই। বাবা চান আমি ‘মানুষ’ হিসেবে বাঁচি, মেরুদণ্ড সোজা করেই বাঁচি। অন্যদিকে যে-‘স্বাধীনতা’র কথা বলা হলো, সেইটে আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ হিসেবে অপার স্বাধীনতা আমার দরকার। চিন্তার স্বাধীনতা, কথাবলার স্বাধীনতা ও কর্মের স্বাধীনতা। সরকারি চাকরিতে এসবে কিছু সীমাবদ্ধতা তো আছেই।

তাছাড়া, মানুষ হিসেবে আমি প্রতিনিয়ত যা ভাবি তা অন্যের মনে সঞ্চার করাটাও জরুরি। চিন্তার সূত্রই সভ্যতার সূত্র। শিক্ষকতা পেশায় চিন্তার প্রতিফলনটা খুব সহজ। আমার শিক্ষক হবার দুর্দমনীয় আকাক্সক্ষার মূলেও এই কারণ নিহিত আছে। আমি একজন স্বাধীন মানুষ হিসেবে বাঁচতে চেয়েছি। শিক্ষার্থীদের কাছেও বলতে চেয়েছি, স্বাধীনতাই মানুষের মৌল প্রবৃত্তি। জন্মগতভাবেই মানুষ স্বাধীন। আর মানুষকে বাঁচতে হবে স্বাধীনভাবেই।

নেসার শহিদ : সন্দেহ নেই, আজও যখন শিক্ষকদের নৈতিকতা নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে তখনও শিক্ষকদের প্রতিই আমাদের ভরসা করতে হবে। কেননা শিক্ষকরাই প্রজন্মের পরিচর্যার মাধ্যমে একটি জাতির ভিত্তি গড়ে দেন এবং নতুন দিনের পথে জাতির পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষক হিসেবে আপনার পেশাটা কি আপনি উপভোগ করতে পারছেন?

জফির সেতু : তোমার কথার ভেতরে অনেক কথা আছে, যা নিয়ে অনেক কথা বলা সম্ভব। সংক্ষেপে বলি, শিক্ষকরাও মানুষ; তাদেরও নৈতিক স্খলন হতে পারে। এটা হতে পারে একটি আত্মপক্ষ সমর্থন বা সামাজিক বাস্তবতা। শিক্ষকের নৈতিক স্খলনের পক্ষে ওকালতি নয় মোটেও। কিন্তু তার আগে একটা কথা পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো। শিক্ষক বলতে আমরা কাকে বুঝব? এমন অনেক তো আছেন যারা শিক্ষকতায় আসেননি, তারা এসেছেন নিছক চাকরি করতে? এদের একটা চাকরির দরকার ছিল, চেষ্টা তদবির করে পেয়ে গেছেন ব্যস। এদের তো আর কিছুর দরকার নাই। এরা তো আর কোনো কমিটম্যান্ট নিয়ে আসেননি। আমি এদেরকে কখনোই শিক্ষক মনে করিনা। এমনকি এদের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাও নেই। এদের মতো লোক প্রতিদিনই আমি অনেক দেখি। এই শ্রেণির মানুষ শিক্ষকতা পেশাটাকে কলঙ্কিত করেছেন।

এখন কথা হলো, মানুষ তো ভুল করতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো স্খলনের মাত্রাটা নিয়ে। নৈতিকতার মানদণ্ড আছে, আবার আছে এর সামজিক ভিত্তিও। নৈতিক স্খলন নির্ভর করে গোটা রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার ওপর। সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি অধঃপতিত হয় তাহলে শিক্ষক কীসের ভিত্তিতে নৈতিক থাকতে পারেন? আদৌ এটা সম্ভব? শিক্ষক শুধু ব্যক্তির নয়, গোটা জাতিরও শিক্ষক। তাঁকে ভুখা-নাঙা রেখে সমাজ-রাষ্ট্রে নৈতিকতার সৌধ নির্মিত হতে পারেনা। যে-সমাজ বা রাষ্ট্র যতবেশি অধঃপতিত সে-সমাজের শিক্ষক ততটাই অধঃপতিত। কেননা ব্যক্তিমানুষ সমাজ বা রাষ্ট্রনিরপেক্ষ নন মোটেই।

এখন দেখতে হবে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা কেমন? সাধারণ চোখে তাকালেও দেখা যাবে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ সাধারণের কাছে। এর পেছনে অনেক দিক রয়েছে। কটির কথা আমি উল্লেখ করতে পারি, এগুলো হচ্ছে-ঔপনিবেশিক, শৈক্ষিক, অর্থনৈতিক ও সমাজতাত্ত্বিক দিক। সুদীর্ঘ দুইশ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ আমাদের রাষ্ট্রীকাঠামোর ভিত্তি; শিক্ষাক্ষেত্রে মানুষ হওয়ার পরিবর্তে কেরানিতৈরির কারখানা হচ্ছে শিক্ষালয়গুলো, অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটা লুটপাটের ব্যবস্থা-এবং সমাজতাত্ত্বিক ক্ষেত্রে এ-তিনের মিথষ্ক্রিয়া। মাঝখানের পাকিস্তানি জঙ্গিশাসন, মুক্তিযুদ্ধের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড, সত্তর ও আশির দশকের সামরিক শাসন প্রভৃতি আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হলে মানুষের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এমনকি নব্বইয়ের দশক থেকে বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতি মানুষের নীতিনৈতিকতার দুর্গে শেষ আঘাত হানে। ফলে অন্যপেশার মানুষের মতো দুর্বলচেতা শিক্ষকের নৈতিকতাও মুখ থুবড়ে পড়ে।

এখন বাস্তবতা হচ্ছে, স্বাধীনতার ৪৫বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও রাষ্ট্রে আইনের শাসন ততটা সংহত হয়নি, বিচারবিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ, বাক্স্বাধীনতাও সীমায়িত হয়েছে, গলতন্ত্র প্রাতিষ্ঠিানিক রূপ পায়নি, সমাজে ন্যায়-অন্যায় ভেদাভেদ নেই, যোগ্যতার মূল্য নেই, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সর্বত্র লুটপাট চলছে-বাড়ছে ধনি-গরিবের বৈষম্য, পুলিশি নির্যাতন বাড়ছে, সঙ্গে সহিংসতাও। একইভাবে লিঙ্গবৈষম্য ক্রমাগত বাড়ছে, বাড়ছে যৌননিপীড়নও-বাড়ছে ধর্মান্ধতা ও উগ্রতা। চারদিকে যেন ঘোর তমসা। এমন যদি প্রতিবেশ হয়, সে-সমাজের শিক্ষক ফেরেশতাদের মতো হবেন-এমনটা আশা করা অন্যায়। এছাড়া সমাজে বেড়েই চলছে জীবনের নানান অনুষঙ্গ, লাগামহীনভাবে বাড়ছে মানুষের চাহিদা। এ-সব মানুষের জীবনে নিয়ে আসছে অমঙ্গল ও অনৈতিকতা।

শিক্ষকদের ক্ষেত্রে যেটা হচ্ছে, অনেক শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে না-পড়িয়ে প্রাইভেট টিউশনি করছেন। শ্রেণিকক্ষের যারা তার কাছে যাচ্ছেনা, তাকে কম নাম্বার দিচ্ছেন-প্রশ্ন বলে দিচ্ছেন, প্রশ্ন ফাঁস করছেন ও নাম্বার ম্যানুপুলেট করছেন। দলীয় রাজনীতিতে নাম লেখাচ্ছেন; ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ক্লাস ইস্তেফা দিচ্ছেন; বদলিবাণিজ্য করছেন। আরও নানা নৈতিক স্খলনে তলিয়ে যাচ্ছেন। আমি বলতে চাই এটা গোটা সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থারই একটা ফল।

যে-সমাজে রাজনীতিবিদরা অসৎ, আমলারা অসৎ, পুলিশ অসৎ, ব্যবসায়ী অসৎ সে-সমাজে ভালো শিক্ষক আশা করা যায়না। কেননা, এর সঙ্গে শিক্ষকের একটা যোগসূত্র আছেই। কীভাবে বলি-যেমন, সরকারি কলেজে যে-শিক্ষক সারাজীবন নিষ্ঠার সঙ্গে শিক্ষকতা করলেন, হঠাৎ একদিন দেখতে পেলেন তাঁর মাথার ওপর অধ্যক্ষ হিসেবে বসানো হয়েছে এমন একজনকে যিনি গোটা চাকরিজীবনেই ছিলেন একজন ফাঁকিবাজ ও অসৎ শিক্ষক-এমনকি তিনি ইতোপূর্বে ছিলেন তাঁরই অধঃস্তন। এতে গোটা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। এসব কে করেন? দেখা যায় যোগ্যতা ও সততাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে এটা করেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ-অসৎ রাজনীতিবিদ ও অসৎ আমলারা মিলে। সৎ ও দায়িত্বশীল মানুষের পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। কেননা সৎ মানুষ বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগও যোগ্যতার মাপকাঠিতে হয়না আর, হয় দলবাজিতে ও তৈলবাজিতে। ফলে পুরো ব্যবস্থা ব্যহত হয় বলে শিক্ষকসমাজে নৈতিক অধঃপতন ঘটে। তখন মানুষ যোগ্যতার ধার না-ধেরে দলীয় লেজুড়ভিত্তিতে তৎপর হয় অনেকেই। এটা একটা কারণ। এতে কী হয়? এত গোটা ব্যবস্থা নাচাল হয়, ক্ষতি হয় জাতির।

এখন কথা হলো, সকল শিক্ষক তো আর এমন নন। ভাগ্য ভালো যে, ভালো শিক্ষকের সংখ্যা আমাদের সমাজে বেশি। হতাশার অন্ধতিমিরে কিংবা নৈতিক স্খলনে সবাই তো আর তলিয়ে যাননি। সমাজ যতটাই পঁচে যাক, রাষ্ট্রব্যবস্থা যতই অসংহত হোক না-কেন বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষকসমাজ অত্যন্ত ধৈর্যশীল, বিনয়ী, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও নীতিবান বলেই আমি মনে করি। এটাই আমাদের সাহস ও আশার জায়গা।

একটা দিনমজুরের চেয়েও কম বেতনে চাকরি করেন অনেক শিক্ষক কিন্তু তাঁরা এই মহান ব্রত থেকে বিচ্যুত হননা। আমি এও জানি একজন শিক্ষক ২৭ বছর ধরে শিক্ষকতা করেছেন অথচ বেতন পাননি একদিনেরও। তবু তিনি চালিয়ে গেছেন তাঁর পেশা। আমি ওই শিক্ষকের নৈতিক ভিত্তি দেখে অবাক হয়েছি। আসলে প্রকৃত শিক্ষক দায় থেকেই শিক্ষকতায় আসেন, খরপোষের জন্য নয়। এই দায় মানবতার মহানব্রতের দায়। এটা আসে তাঁর ভেতর থেকেই। এমন শিক্ষকই জাতির চালিকা শক্তি। এরাই জাতীয় ভিত্তি নির্মাণ করেন প্রজন্মের পরিচর্যার মাধ্যমে, জ্ঞান অনুশীলন ও জ্ঞানবিতরণের মাধ্যমে। জাতির মানদণ্ড এঁরাই, এঁদের ওপরই জাতিকে ভরসা করতে হয়। এঁরাই মূলত জাতির পথপ্রদর্শক। শত মারি-মন্বন্তরেও এঁদের বিনাশ হয়না।

কথা হচ্ছে তেমন শিক্ষক নিজের সঙ্গে প্রতারণা করেন না কখনো, অন্যের সঙ্গে তো নয়ই-আত্মপ্রতারক হচ্ছেন শিক্ষক পেশাধারী যত অশিক্ষকরা। ওরা মতলব নিয়েই শিক্ষকতায় আসে।

প্রশ্নের শেষ অংশের উত্তরে যদি বলি, তাহলে বলতে হয়, আমার আশপাশ যেমনটাই থাক, ব্যক্তিগতভাবে আমি শিক্ষকতাকে বেশ উপভোগই করি।

নেসার শহিদ : পেশাগত দায়িত্ব পালনে আপনি কি কোনো সমস্যা বোধ করেন? সেগুলো কেমন?

জফির সেতু : আসলে শিক্ষকতার পেশা সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং পেশা, যেহেতু এই পেশার মটোটা হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করা; মানবসন্তানকে ‘মানুষ’ করে তোলা। এরচেয়ে যুদ্ধক্ষেত্র পরিচালনা বরং সহজ কাজ। ওখানে জয়-পরাজয়ের খেলা শুধু-‘মারিব কিংবা মরিব’, কিন্তু শিক্ষকতায় থাকে ভবিষ্যৎপৃথিবী গড়ার মন্ত্র। যে-সব (অ)শিক্ষক দায় নিতে চান না তাদের কথা ভিন্ন, কিন্তু যারা সত্যিকার অর্থে মানুষ হওয়ার মন্ত্র দেন তেমন শিক্ষকের জন্য এটা চ্যালেঞ্জিং বটে। শিক্ষকতা পেশায় জীবনসংহারের ঝুঁকি থাকে যুগে যুগে। কেননা শিক্ষকরা সকল অর্থেই বুদ্ধিজীবী। তাঁরা জগৎ ও জীবন সম্পর্কে নতুন নতুন চিন্তা করেন, পুরাতনের স্তূপকে ভেস্তে দেন, নির্মাণ করেন নতুন সৌধ।

শিক্ষকদের যুক্তিবাদী হতে হয়, সত্যকে তুলে ধরতে হয়-অন্তত তাঁর কাছে যেটা সত্য বলে প্রতিভাত হয়। পৃথিবীর জঞ্জাল আস্তাকুঁড়ে ফেলতে হয় তাঁকেই। কাজটা এত সহজ নয়। শিক্ষক মেরুদণ্ডহীন হতে পারেন না; মোসাহেব ও তোষামোদকারী হতে পারেননা; রাষ্ট্রপক্ষের দালালও হতে পারেনা। ফলে দেখা গেছে যুগে যুগে ন্যায়নিষ্ঠ বুদ্ধিজীবী শিক্ষকের ঘাড়ের ওপর রাষ্ট্রপক্ষের খড়্গ যেমন উঁচিয়ে থাকে, তেমনি থাকে প্রতিক্রিয়াশীলদের ওৎ পাতা বল্লমও। প্রকৃত শিক্ষক এতে ভাবিত হননা। তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করে যান শুধু নতুন চিন্তা ও শাণিত ভাষ্য দ্বারা।

আমাদের মতো দেশে শিক্ষকতার মতো পেশা সত্যিকার অর্থে চ্যালেঞ্জিংই। আমাদের সমাজরাষ্ট্রে উদারনৈতিকতা ও যুক্তিবাদ অতোটা জায়গা করে নিতে পারেনি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ঔপনিবেশিক আদলে সাজানো। মানুষ বানানোর চেয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের কলকব্জা বানানোর দিকেই ঝোঁক বেশি। মনে রাখতে হবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কেরানি-বানানোর মানসে। শাসকরা সফলও হয়েছিল। সেই ধারা চলছে আজও।

আমাদের পাঠ্যবিষয় নানা বৈপরীত্বে ভরা। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে পূর্বের ক্লাসে যা বলা হয়েছে, পরের ক্লাসে বলা হয় ঠিক তার উলটো। ওইদিন শুনলাম সেরা একটা কলেজের শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে বিবর্তনের ভেতর দিয়ে মানুষের উদ্ভব ও বিকাশের চ্যাপ্টার পড়ানোর শেষে শিক্ষার্থীদের বলছেন ‘ওটা বিশ্বাস করার কিছু নাই। তবে পরীক্ষার জন্য এভাবে পড়তে হবে।’ তো, বারো ক্লাস সম্পন্ন করে যে-সব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে, সত্যিকার অর্থে তাদের অধিকাংশেরই জ্ঞান ও চিন্তার জগৎ বিপর্যস্ত থাকে। আত্মপরিচয়, ধর্ম, লিঙ্গ, রং, সমাজস্তর সহ নানা ধারণা তারা পেয়ে গেছে পরিবার, সমাজ ও ধর্ম থেকে। ধরো, ধর্ম সম্বন্ধে সে যতটা জানতে পেরেছে তা কার কাছ থেকে জেনেছে? একইভাবে লিঙ্গ কিংবা গায়ের রং সম্বন্ধে? প্রত্যেকেই ততদিনে একটা শক্ত অবস্থানে পৌঁছে গেছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন বিশেষজ্ঞ শিক্ষক যখন আধুনিক ও যুক্তিবাদী মন নিয়ে বিজ্ঞান ও দর্শনের আলোয় যুক্তিতর্ক তুলে ধরেন তখন শিক্ষার্থীদের পুরোনো ধারণার সঙ্গে তা সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। ফলে অনেকে হতাশ হয়ে পড়ে, আবার অনেকে প্রতিক্রিয়াশীল আচরণও শুরু করে। সবাই নিতে পারেনা নতুনসব চিন্তা। দেখা গেল সে শিক্ষককেই ভুল বুঝতে শুরু করছে।

একটা উদাহরণ দিই। একবার ইংরেজি বিভাগের এক ছাত্র আমার সঙ্গে দেখা করে বলল, ‘স্যার, আমি আর পারছিনা। এতদিন যা জানতাম এখন তাতে সংশয় দেখা দিচ্ছে। আমি এসব নিতে পারছিনা। আই ওয়ান্ট টু গো ব্যাক। আমার আগেরটাই ভালো।’ সে হারিয়ে গেল। এইজন্য কে দায়ী? একবার আমার বিভাগের একছাত্র বলল, স্যার, ৭১-এ তিন লক্ষ লোক মরেটরে নাই। ওটা বানানো কথা। আমি বললাম, ‘তুমি এটা কোথায় পেয়েছ?’ সে বলে, আমি বইয়ে পড়েছি, কয়েকজন শিক্ষকও বলেছেন আমাকে।’ আমি তখন কী বলতে পারি?

সমস্যা এখানেও। সব জায়গায়ই কিছু প্রতিক্রিয়াশীল মানুষ থাকেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও আছেন। এঁরাও শিক্ষক। এঁরা শুধু শিক্ষার্থীদের মানুষ হয়ে ওঠার পথে বাধাই না, ভালো শিক্ষকের পথে কাঁটাও। কেননা এরা অনেকে শিক্ষকের অগোচরে খারাপ কথা বলে শিক্ষার্থীদের মোটিবেশন করেন। এঁরা বরং প্রতিপদে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন। এঁরা অদৃষ্টবাদী। যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানের নৈতিক ধারণার পরিবর্তে আবেগী কথাবার্তা বলে প্রজন্মের মধ্যে একটা কুসংস্কারের বাতাবরণ তৈরি করে রাখেন। মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাণী হলেও অন্ধতায় বিচরণ তার উপাদেয়। অনেকে তা গ্রহণও করে থাকে।

আরও ব্যাপার আছে। আমরা স্বাধীন দেশে বসবাস করলেও আমাদের মন ঔপনিবেশিক। এদেশে নারী-পুরুষের সম্পর্ক যেমন সামন্ততান্ত্রিক, ছাত্রশিক্ষকের সম্পর্কও তেমন। প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্য এমন ছিলনা। প্রাচ্যের তো নয়ই। এটা এসেছে ঔপনিবেশিক শাসন-সূত্র থেকেই। শিক্ষকদের মধ্যে একটা দমননীতিসুলভ আচরণ লক্ষ করেছি আমি যখন ছাত্র ছিলাম তখন, এখনও দেখছি-যখন আমি নিজে শিক্ষক। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের ভয় পাবে কেন আমি বুঝিনা। এটা একটা মধুর সম্পর্ক। শিক্ষক সম্পর্কে বলা হয়-‘ফ্রেন্ড, গাইড অ্যান্ড ফিলোজফার।’ তো এই তিনজনকেই তো ভয় পাওয়া চলেনা। ‘ভক্তি’ ও ‘ভয়’ এক জিনিস নয়। ‘ভক্তি’ আসে প্রণয় থেকে, ‘ভয়’ রিপু থেকে। প্রথমটি মানবিক, দ্বিতীয়টি পাশবিক। অনেক শিক্ষককে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করার সাহসও পায়না। দিনের পর দিন প্রশ্নরা বুকের ভেতর গুমরে কাঁদে, মারা যায়। এটা আমাকে খুব আহত করে। আমরা যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই, আমাদের বেতন দেয় সাধারণ মানুষ। কিন্তু এঁদের সন্তানরা যখন পড়তে আসে তাদের প্রতি আমরা কতটা দায়বদ্ধ ও অনুভূতিশীল তা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। এটা খুব জরুরি।

নেসার শহিদ : এই সমস্যাগুলো আপনি কীভাবে মোকাবেলা করেন? এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ কি কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে?

জফির সেতু : সমস্যা তো থাকবেই। সকল যুগেই ছিল। সব যুগে শিক্ষকরা যেভাবে মোকাবেলা করেন আমিও সেভাবে করে থাকি। আমি যতটুকু জানি (আদৌ কি কিছু জানি?) তার প্রতি আমার আস্থা রয়েছে। শিক্ষার্থীদের প্রতি আমার প্রাণের একটা দরদ আছে, সম্ভবত ওরা ওটা টের পায়। আমার দায় যতটা মানুষের প্রতি, ততটাই নিজের প্রতিও। সত্যের মাঝামাঝি কোনো পথ থাকে না। সত্য সত্যই। সত্য প্রকাশ না-করাও অন্যায়। শিক্ষার্থীকে বিভ্রান্ত করা অপরাধ। রাষ্ট্র শিক্ষার বন্দোবস্ত করেছে, শিক্ষকদের বেতনভাতাও দিচ্ছে। কিন্তু এরচেয়েও বড়ো ব্যাপার আছে, যে-কারণে এই শিক্ষাব্যাবস্থা তার পথকেও সুগম করে তুলতে হবে।

অনেক শিক্ষক ক্লাসে নতুন কিছু বলতে ভয় পান। অনেক তথ্য দিতে ভয় পান। নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবেন। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে সত্যের প্রতি অবিচল থাকায় সাহস দেওয়া। আমাদের দেশে সরকার পরিবর্তন হলে অনেক সত্যও পালটে যায়। নয়া ইতিহাস রচনায় প্রবৃত্ত হয় রাষ্ট্রপক্ষ। এটা ঠিক নয়। ইতিহাসকে ইতিহাসের আলোয়ই দেখতে হবে। বেশ কয়েকবছর আগে দেওয়াল লিখনে দেখলাম ওতে লেখা আছে ‘তারেক রহমান আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার।’ পাঠ্যবইয়েও লেখা ছিল ‘স্বাধীনতার ঘোষক মেজর জিয়াউর রহমান।’ এসব মিথ্যাচারের মানে কী? আমি বুঝিনা। তখন আমার মনে হয়, রাষ্ট্র তাহলে অ্যাবসার্ড ড্রামার অংশ!

আমি মনে করি মানুষের নতুন চিন্তা সহজাত। মানুষ যখন চিন্তা করে তখন আইনের কথা ভাবেনা। একসময় রাষ্ট্র শাসিত হতো গির্জা থেকে। আজকের দিনে রাষ্ট্রের সঙ্গে গির্জার বিচ্ছেদ ঘটেছে বটে, তবে যাজকরা রয়ে গেছেন বিচিত্রভাবে। সমস্যা এখানেই। আসলে রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। আমার কথা হচ্ছে রাষ্ট্র যেন যাজকের কথায় আইনপ্রণয়ন না-করে; যাজকের উদ্দেশ্য যেন আইনে প্রণীত না-হয়। রাষ্ট্র মানুষের স্বাধীনসত্তারই বহিঃপ্রকাশ।

একটা রাষ্ট্রে শিক্ষকরা চিন্তা ও চেতনাপ্রকাশে যতটা স্বাধীন হবেন, ওই সমাজ-রাষ্ট্র ততটাই অগ্রসর ও কল্যাণব্রতী হতে বাধ্য। অন্যদিকে রাষ্ট্র নিজে যেন মৌলবাদী না-হয়, নিজেই যেন সাম্প্রদায়িক হয়ে না-ওঠে। নিজে যেন কম্প্রোমাইজ না-করে মিথ্যার সঙ্গে। ইউরোপীয় রাষ্ট্র ও সভ্যতা বিকশিত হয়েছে শিক্ষক-নির্দেশিত সত্য ও যুক্তিবাদের পথ ধরে। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে।

নেসার শহিদ : ক্ষমা চেয়ে নিয়ে কৌতূহল নিবারণ করার জন্য একটি প্রশ্ন করতে চাই, পেশাগত দায়িত্বপালনে নিজের কোনো সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করেন কি?

জফির সেতু : সব সময়ই করে থাকি। আমার প্রায় সময় মনে হয় আমি বিশেষ কিছু জানিনা। এটা বিনয় নয়, সত্য। আসলেই আমি বিশেষ কিছু জানিনা। তাই প্রায় সময় আমি অসহায় বোধ করি, বিষণœ থাকি। তখনই পড়ালেখায় অধিক মনোযোগী হই। পড়ার চেষ্টা করি, জানার চেষ্টা করি। কিন্তু জ্ঞানের সাম্্রাজ্যে মানুষ বড়োই অসহায় প্রাণী। মাঝে মাঝে মনে হয় এই সীমাহীন মূর্খতা নিয়ে শিক্ষকতা করা অন্যায়।

নেসার শহিদ : শিক্ষকতায় আপনি কি কাউকে অনুসরণ বা অনুকরণ করেন? পেশাগত দায়িত্বপালনে এ-প্রসঙ্গে আপনার মতামত জানতে চাই।

জফির সেতু : অনুকরণ করি কিনা জানিনা, তবে অনুসরণ করি। একজন শিক্ষকের দায়িত্ব অনেক। এই দায়িত্বশীলতার ব্যাপারগুলো শিখেছি আমি কিছু ‘মহমতি’ শিক্ষকের কাছ থেকে। শ্রেণিকক্ষে ও শ্রেণিকক্ষের বাইরে শিক্ষকের দায়িত্ব অনেক। আমি মনে করিনা একজন শিক্ষক শুধু শ্রেণিকক্ষে বক্তৃতা করবেন, খাতা দেখবেন, রেজাল্ট দেবেন। শিক্ষকের দায়িত্ব সর্বত্র হতে পারে। শিক্ষকতা পেশা নয়, একটি ব্রত। এটা একটা মানবিক দায়িত্বও। আমাকে এক শিক্ষক একবার একটি বই নিজের টাকায় ফটোকপি করে দিয়েছিলেন, তখন বইটি কেনার সামর্থ্য আমার ছিল না। একবার একজন আমাকে ১৬ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে নিয়ে গিয়েছিলেন বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য। পড়ার আগ্রহ দেখে আরেক শিক্ষক আমাকে তাঁর ডেরায় নিয়ে এসেছিলেন তিনমাসের জন্য, গণিত শেখাবেন বলে। তিনি অত্যন্ত গরিব ছিলেন। এগুলো তো তাঁদের চাকরির আওতায় পড়েনা।

আমি ভাগ্যবান যে অনেক ভালো শিক্ষকের ছাত্র আমি ছিলাম। তাঁদের ভালোবাসাও আমি পেয়েছি। আমিও অনেকটা শিক্ষকভক্ত ছিলাম। আমি এটা পেয়েছি আমার মায়ের কাছ থেকে। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান একদিন বলেছিলেন, তোমার কোনো জিজ্ঞাসা থাকলে যে-কোনো জায়গায় জিজ্ঞেস করবে। এটা আমার একটা আদর্শ হয়ে যায় একসময়।

অধ্যাপক আলাউদ্দিন আল আজাদ বলতেন, তুমি যে-কোনো প্রশ্ন আমায় করতে পারো। আমার স্কুলের এক শিক্ষক বলেছিলেন, আমিও অনেক কিছু জানিনা। আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম। কেননা, আমার মনে হতো পৃথিবীতে এমনকিছু নাই তিনি জানেননা। এঁরাই আমার আদর্শ, প্রেরণা।

কর্মক্ষত্রে আসীন হওয়ার পর অনেক শিক্ষকতুল্য শিক্ষকেরও সাক্ষাৎ পেয়েছি তাঁরাও আমার প্রেরণা। অধ্যাপক জাফর ইকবাল তাঁদের একজন। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত মুখ ও কর্মস্পৃহা আমাকে প্রেরণা ও আনন্দ দেয়। পিএইচ.ডি. গবেষণাকালে আমি তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে অধ্যাপক দানীউল হককে পেয়েছি। শিক্ষকের আদর্শ কী হতে পারে আমি তাঁর কাছ থেকে এটা শিখেছি। শুধু তাই নয়, শিক্ষক হিসেবে আমি সক্রেটিস, প্লেটো ও অ্যারিস্টটলপন্থী। এদের সবার কাছে আমার ঋণ অপার।

নেসার শহিদ : শিক্ষার্থীরা আপনার ক্লাস দারুন উপভোগ করে, এ-বিষয়ে কিছু বলুন।

জফির সেতু : এ-বিষয়ে শিক্ষার্থীরাই ভালো বলতে পারবে। তবে, উপভোগের কারণ আমার মনে হয় একারণে হতে পারে যে, আমি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর সঙ্গে মিশে যেতে চাই। আমার ক্লাস খুব কম্যুনিকেটিভ হয়। আমি বিষয়টা আগে নির্বাচন করে নিই। কিন্তু কী বলব, কীভাবে বলব তা ক্লাসেই নির্ধারণ করি। আমি শিক্ষার্থীদের প্রতি সকর্তদৃষ্টি রাখি। আমাকে তারা বুঝতে পারছে কিনা এটা বুঝতে চাই। আমি সব উদাহরণ নিই চারপাশের জীবন ও সত্য থেকে। ক্লাসের সবচেয়ে অমেধাবী ও অমনোযোগী শিক্ষার্থীও আমার লক্ষ্য বস্তু থাকে। কেননা আমি জানি সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তোলাই শিক্ষকের কাজ। আমি নিজেও শ্রেণিকক্ষ খুব উপভোগ করি।

নেসার শহিদ : দেশের সার্বিক শিক্ষা-পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

জফির সেতু : আমার কাছে একটা বড়ো প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন ভালো মানুষ তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে? আমি মনে করি একজন বড়ো আমলা বা তুখুড় রাজনীতিবিদ হওয়ার চাইতে একটা ভালো মানুষ হওয়াটা অনেক জরুরি। একজন বিরাট বিজ্ঞানী বা ডাক্তার হওয়ার চাইতে একজন ভালো মানুষ হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যর্থ হচ্ছে কেন ভালো মানুষ তৈরিতে? আমার মনে হয় আমাদের উদ্দেশ্যও খুব সৎ নয়।

আমরা আমাদের সন্তানদের ভালো ডাক্তার, আমলা, পুলিশ অফিসার, ইঞ্জিনিয়ার, সামরিক অফিসার, ব্যবসায়ী বা রাজনীতিবিদ করে তুলতে চাই-ভালো মানুষ করে তোলার স্বপ্ন আমাদের ভেতরে থাকেনা। এর একটা নেতিবাচক প্রতিফলন সমাজরাষ্ট্রে ঘটছে। দেখা যাচ্ছে দেশের সবচেয়ে মেধাবী সন্তানরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা, শিক্ষক প্রভৃতি পদস্থ কর্মকর্তা হয়ে পাবলিকের সঙ্গে বিট্টে করছে-অন্যায় করছে, অবজ্ঞা-অবহেলা করছে, ঘুষ খাচ্ছে। রাষ্ট্রের তহবিল তছরূপ করছে। অথচ এরা পড়াশোনা করেছে গরিবসব মানুষের টাকায়। এদের অনেক আবার গরিব মানুষেরও সন্তান। একটা সাধারণ ন্যায়-অন্যায়বোধ তাদের ভেতরে কেন জাগ্রত হয়না আমি বুঝিনা। যেমন করেই হোক, আমাদের প্রত্যেককে যেন বাড়ি-গাড়ির মালিক হতে হবে। এই দায় আমিও এড়াতে পারিনা নিশ্চয়। শিক্ষক হিসেবে তার ভেতরে এই চেতনা আমি জাগাতে ব্যর্থ হয়েছি। এটা গেল একটা দিক, এর অপর দিকও আছে।

ব্রিটিশ ভারতে ম্যাকলে সাহেব যে-ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতি চালু করে গিয়েছিলেন, তার চিন্তা ছিল অসৎ। তারা চেয়েইছিলেন তৈরি করবেন এমনসব নিম্নমানের মানুষ যারা শোষণযন্ত্র হিসেবে কাজ করবে। ম্যাকলের শিক্ষানীতির ফাঁপড় থেকে আমরা এখনও বের হতে পারিনি। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাও এমন উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয়েছিল ব্রিটিশভারতে, কলোনিয়াল প্রশাসনের যাঁতকলে পিষ্ট গোটা ব্যবস্থা। ফলে রাষ্ট্রব্যবস্থার ভীতও তত শক্ত নয়।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার পর পাকিস্তানি জান্তাশাসনে তছনছ হয় আমাদের জনপ্রশাসন, রাষ্ট্র নিজে সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে একসময়। ফলে দেখা গেল, ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা যে-সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপণ করেছিল শিক্ষাব্যবস্থায়, পরে পাকিস্তান আমল তা পাকাপোক্ত করেছিল বীরবিক্রমে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বারবার বিনাশের পাঁয়তারা করেছে অনেক সরকার, রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠান-তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠেছে সাম্প্রদায়িক শিক্ষাব্যবস্থাও। এই সমস্যার সমধান করতে পারেনি কোনো সরকারই।

বাংলাদেশে শিক্ষাপরিস্থিতি খুবই গোলমেলে। একমুখী না-হয়ে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নানামুখী। শিক্ষা এখন একটা বাণিজ্যও। পণ্য। এমন অনেক শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেশে প্রচলিত রয়েছে যে তার সঙ্গে বাস্তবজীবনের কোনো সম্পর্কই নেই। মাদরাসা শিক্ষাকে বিজ্ঞান ও কর্মমুখী করে তোলার কোনো প্রয়াসও নেই কোথাও। এর সঙ্গে ভোটের রাজনীতি জড়িত। আমার মনে হয় এ-ব্যাপারে রাষ্ট্রকে একটা নীতি গ্রহণ করে সুদৃঢ় জায়গায় দাঁড়াতে হবে। কঠোরহস্ত হতে হবে। আধুনিক তুরস্কে যে-ধরনের শিক্ষানীতি চালু হয়েছিল তা থেকে দৃষ্টান্ত নেওয়া যেতে পারে।

এভাবে সময়ক্ষেপণ করলে ভবিষ্যতে এ-সমস্যা সমাধানের পথও খুঁজে পাওয়া যাবেনা। উচ্চশিক্ষার অবস্থা আরও খারাপ। যেভাবে মার্কেটের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হচ্ছে তাতে উচ্চশিক্ষা দিনকে দিন হাস্যকর হতে বাধ্য। প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা ভেস্তে গেছে, তা পুনরুদ্ধার করা দরকার। সরকারি কলেজের অবস্থা বেহাল। দুপুরের পর কোনো কোনো কলেজে ক্লাসই হয়না। শিক্ষকরা বাসায় পড়ানো নিয়ে ব্যস্ত। একদিন হয়ত এদের অবস্থা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতেই হবে; কোনো ভদ্রলোকের সন্তানকে ওখানে পাঠানো হবেনা-যারা পড়বে, বাধ্য হয়েই পড়বে।

আরও ব্যাপার আছে, তা হচ্ছে শিক্ষকের বেতনকাঠামো ও বেতনবৈষম্য। এটা শিক্ষকদের গোটা জীবনপ্রণালীকেই নিয়ন্ত্রণ করছে। শিক্ষকরা হীনম্মন্য হয়ে পড়েছেন। এটা মোটেও সার্বিক সমাজব্যবস্থার জন্য ভালো নয়। শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতনকাঠামোও করা হয়নি এখনো, পাশের দেশ ভারতের দিকে তাকালেই এর উদাহরণ নেওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকনিয়োগে যেমন স্বজনপ্রীতি রয়েছে, তেমনি প্রমোশনের ব্যাপারে রয়েছে ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের শিক্ষকদের হয়রানিও। দেশের শিক্ষাপরিস্থিতি যে খুব সুখকর এটা বলা যাচ্ছেনা।

নেসার শহিদ : শিক্ষকসত্তার পাশাপাশি আপনার আরও একটি সত্তার কথা সবাই জানেন, সেটা শিল্পীসত্তা। আপনি একজন স্বনামধন্য কবি ও লেখক। আমার প্রশ্ন হচ্ছে দুটি পৃথক সত্তা হিসেবে এগুলো সাংর্ঘষিক কিনা?

জফির সেতু : এটা খুব ভালো প্রশ্ন। রবীন্দ্রনাথের মতো করে বলি, একজন মানুষের ভেতরে অনেক মানুষ বাস করে। অনেক পরিচয়েই সে পরিচিত। আমার একটি লেখক বা কবি সত্তা আছে। এটা ঠিক, কিন্তু দুটোকে আমি কখনোই গুলিয়ে ফেলিনা। এ-দুই সত্তা পরস্পরবিরোধী কিনা আমি জানিনা।

তবে দুটোর মধ্যে আমি অন্তত দ্বন্দ্ব অনুভব করিনা। বরং আমি দেখি এ-বিষয়ে পাঠক বা অন্যজনের প্রশ্ন অনেক। যেমন, আমার কবিতা যারা পড়েন তারা জানেন জীবন ও শিল্পের প্রয়োজনে ভাষার স্বতঃসিদ্ধ নিয়মে অনেক শব্দই আমি ব্যবহার করি। অনেকের কাছে এগুলো ট্যাবু শব্দ হলেও আমার কাছে স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। কিংবা গল্পে কাহিনী বা ঘটনার প্রয়োজনে এমন বিষয় আসে অনেকে দেখেছি এতে দ্বিধান্বিত হন। এই সমস্যা তার বা তাদের, আমার নয়।

জীবনে যৌনতা আছে, নর-নারীর আন্তঃসম্পর্ক আছে, আছে নিবিড় সম্পর্ক কিংবা ভয়ানক অন্য কোনো ঘটনা। শিল্পীর কাজ হচ্ছে তা শিল্পিত উপায়ে উপস্থাপন করা, সর্বজনীন করে তোলা। সমাজকে স্বাক্ষী রেখে শিল্পকর্ম হতে পারেনা। শিল্পীর কাজ কারো মনোরঞ্জন নয়, জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থাপন। আমার কবিতা পড়ে এক অধ্যাপক বললেন, সবই ভালো, তবে আপনার কিছু শব্দ আমি মেনে নিতে পারিনা।

আমি বললাম, আমার কবিতা ধর্মীয় বাণী নয়, জীবনের স্বতোচ্ছ্বল উচ্চারণ; জীবনে যেসব শব্দ আনুষঙ্গিক আমি প্রয়োজনে তা প্রয়োগ করতে পারি। তিনি বললেন, আপনি ভুলে যাবেন না আপনি একজন শিক্ষক। আমি বললাম, আমি যখন লিখি তখন আমি কবি বা লেখক-শিক্ষক নই। আসলে এটাই আমার কথা। হ্যাঁ, আমি যখন বাজার করি তখন কি আমি কবি? কিংবা যখন গোসল করি তখন কি শিক্ষক? সহজ জিনিশ মানুষ জটিল করে তোলে কেন বুঝিনা। যখন আমি কবি তখন সমাজশর্ত মানতে আমি বাধ্য নই। কারণ সমাজের অনেক বিষয় ভণ্ডামোতে ভরা।

সমাজ অনেক কিছু মানুষের ওপর আরোপ করে, এটা সমাজের মন্দ ব্যাপার। শিক্ষক ও কবি-দুজনই সমাজসংস্কারক-দুজনই সভ্যতার পথপ্রদর্শক; কিন্তু দুজনের পথ ভিন্ন, উপায়ও।

নেসার শহিদ : একজন শিক্ষক হিসেবে পেশাগত জীবনে নিজেকে কীভাবে সফল মনে করবেন?

জফির সেতু : এটা কঠিন প্রশ্ন। আমি এতকিছু ভাবিনি। আমার মনে হয়েছে মানুষ হিসেবে আমার কিছু দায়িত্ব আছে। এ-দায়িত্বগুলো আমাকে পালন করতেই হবে। সুতরাং, এ-ভিন্ন আমার আর কোনো উপায়ও দেখছি না।

আমি কখনোই রুটিরুজির জন্য চাকরি করিনা। আমি শিক্ষক না-হলে ঠিক ঠিকই কৃষক হতাম। আমি চেয়েছি একটি সৃষ্টিশীল জীবন। শিক্ষকতা পেশা হিসেবে সৃষ্টিশীল ও আনন্দের। আমি যদি এই চাকরি না-করতাম, আর শিক্ষকতা আমাকে করতেই হতো, তাহলে আমি আমার গ্রামে ফিরে যেতাম। সেখানে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে প্রত্যন্ত জনপদের মানুষের সন্তানদের পড়িয়ে জীবন কাটিয়ে দিতাম। আমার এ-স্বপ্ন এখনো তিরোহিত হয়নি। পেশাগত জীবনে যে-সফলতার কথা বলা হলো, সেটা আমার ছাত্রছাত্রীদের কেন্দ্র করেই আবর্তিত।

আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের প্রথম যে-কথাটি বলি তা হলো তোমাকে একজন ভালো মানুষ হতে হবে, বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক মানুষ। মানুষ হিসেবে মানুষের দায়টা তোমাকে নিতে হবে। সভ্যতার আলো পৌঁছে দিতে হবে, অনাগত দিনের কাছে। আমি মানুষের সম্ভাবনার কথা বলি, জীবনের গভীর অর্থের কথা বলি। ওরা এটা মন দিয়ে শোনে। অনুধাবন করতে চায়। আমি বই হাতে তুলে দেই। আমি বলি, জ্ঞানই আলো। আমি মানুষ হয়ে ওঠার কথাই বলি। আমি যখন দেখি এতে ছাত্রছাত্রী গভীরভাবে আলোড়িত হচ্ছে, চিন্তাচেতনা পরিবর্তিত হচ্ছে-তখন আমার ভালো লাগে। এটা একধরনের সফলতা বইকি।

নেসার শহিদ : আপনার অনেক ছাত্রছাত্রীই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে; তাদের উদ্দেশ্যে এবং যারা ভবিষ্যতে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিতে চায়, তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন..

জফির সেতু : পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকেই বেছে নিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আসলে যে-কোনো অবস্থান থেকেই মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালন করা সম্ভব। কিন্তু কারো যদি স্বপ্ন থাকে শিক্ষকতার, আমি বলি তাহলেই শিক্ষক হও। কেননা, পেশাটা চ্যালেঞ্জিং। জ্ঞানার্জন করতে হয়, প্রবল সাহসীও হতে হয়। একজন কাপুরুষের পক্ষে শিক্ষক না-হওয়াটা উত্তম। এছাড়া এ-পেশায় তোমাকে দরিদ্র হয়েই সারাজীবন কাটাতে হবে। আমি অবশ্যই আর্থিক দারিদ্র্যের কথা বলছি। কারণ দারিদ্র্য জিনিশটা খুব খারাপ। দারিদ্র্য মানুষকে ছোটো করে ফেলে। বিকাশের পথকে রুদ্ধ করে দেয়, প্রবল মনের জোর না-থাকলে এ-পেশায় নিজেকে বের করে আনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তবে, পেশা হিসেবে এটি অনন্য। এর তুলনা নেই।

আবার বলছি, মেরুদণ্ড বাঁকা থাকলে শিক্ষক হওয়ার দরকার নেই। কেননা, শিক্ষার্থীদের জীবনের প্রথম মডেল থাকেন শিক্ষকরাই।

নেসার শহিদ : আপনার কর্মময় জীবনে নতুন একটি বছর শুরু হতে যাচ্ছে, নতুন জন্মবার্ষিকের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি। আপনার জন্মদিনকে কেন্দ্র করে আমাদের এই নিবেদন শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কউন্নয়নে অনুপ্রেরণা হিসেবে উপস্থাপিত হবে-এটা আমাদের বিশ্বাস। আপনার মূল্যবান সময়ে আমাদের সঙ্গ দেওয়ায় ধন্যবাদ জানাই।

জফির সেতু : তোমাদেরও ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য