দ্য গ্রেটকোট-৪

নিকোলাই ভাসিলিয়েভিচ গোগোল রবার্ট শ্যান্ডলারের ইংরেজি অনুবাদ থেকে কাজী মাহবুব হাসান

 প্রকাশিত: ২০১৭-০২-০৪ ২১:৪০:০০

কাজী মাহবুব হাসান:

চতুর্থ পর্ব
আর কোনো পথ খোলা নেই, আকাকি আকাকিয়েভিচ সিদ্ধান্ত নেন তিনি এই বিশেষ ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটির’ কাছেই যাবেন। ঠিক কোন দপ্তরের দায়িত্বে ছিলেন এই ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি’ আর তার কাজটাই বা কি ছিল সেটি আজ অবধি সবার অজানা। আরো লক্ষ্য করা প্রয়োজন যে এই ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি’ শুধুমাত্র সাম্প্রতিক কোনো এক সময়ে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়েছিলেন, এর আগে তিনি একজন অগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। এমনকি তার এই অগ্রগতির পরেও, তার পদমর্যাদাটি অন্য আরো ‘গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের’ সাথে তুলনামূলকভাবে তেমন বেশী ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হিসাবে বিবেচিত হয়নি। তারপরও, যে কেউ সেই মানুষদের একটি বলয় সবসময়ই কিন্তু খুঁজে পান, যাদের জন্য সেটি ‘গুরুত্বপূর্ণ’, যা কিনা অন্যদের চোখে ‘অগুরুত্বপূর্ণ’। উপরন্তু, তিনি চেষ্টা করেছিলেন তার গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে : যখন তিনি কাজে আসতেন, তখন তার অধস্তন কর্মচারীদের উপর নির্দেশ ছিল সিঁড়িতে দাড়িয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য, সরাসরি তার সামনে হাজির হওয়ার জন্য কারোরই অনুমতি ছিল না, বরং সবকিছুর অনুসরণ করা হতো কঠোর দাপ্তরিক বিধি অনুযায়ী।

একজন কলেজিয়েট রেজিস্ট্রার রিপোর্ট করবেন প্রভিন্সিয়াল সেক্রেটারির কাছে, প্রভিন্সিয়াল সেক্রেটারী করবেন একজন টিট্যুলার কাউন্সিলরের কাছে অথবা যিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষ সেই ক্ষেত্রে তার কাছে। অন্য কোনোভাবেই যেন আর কিছু তার নজরে আনা না হয়। এভাবেই পবিত্র রাশিয়া পুরোটাই দুষিত হয়েছে অনুকরণের দ্বারা, প্রত্যেকে তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নকল আর অনুকরণ করে থাকেন।

এমনকি বলা হয়ে থাকে যে কিছু টিটুলার কাউন্সিলর, পৃথক, ছোট চ্যান্সেলারীর দায়িত্ব পাবার সাথে সাথে নিজের জন্য একটি বিশেষ রুম আলাদা করে নেন, যাকে তিনি বলেন দর্শনার্থীদের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে দেখার করার জন্য নির্মিত দরবার কক্ষ, এবং এই কক্ষের বাইর তিনি সোনালী সুতার নকশা করা আর লাল কলারের ইউনিফর্ম পরা দ্বাররক্ষীদের নিয়োগ দেন বসে থাকা জন্য, যার প্রতি নির্দেশ থাকে প্রতিটি দর্শনার্থীর জন্য দরজা খুলে দেয়ার জন্য – এমনকি যখন তার এই দরবার কক্ষে সাধারণ একটি লেখার ডেস্ক রাখার মত যথেষ্ট পরিমাণ জায়গা নেই। ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটির’ আচরণ ও অভ্যাস খুবই অভিজাত ও রাজকীয়, কিন্তু কোনো বিশেষ জটিলতা সেখানে নেই। তার পদ্ধতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা। কঠোর নিয়মানুবর্তিতা, ‘শৃঙ্খলা আর আনুগত্য’ - তিনি মাঝে মাঝে বলেন, এবং শেষ শব্দটি বলার সময় তিনি যে মানুষটির সাথে কথা বলছেন তার মুখের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব সহকারে তাকিয়ে সেটি বলেন।

যদিও তার এই সব কিছু করার কোনো বিশেষ কারণ নেই, যাই হোক না কেন যে দশজন কর্মচারী যারা তার অফিসের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন, তারা প্রত্যেকেই এমনিতে যথেষ্ট পরিমাণ আতঙ্কিত আর সদাসন্ত্রস্ত কম্পমান থাকতেন তার উপস্থিতিতে। দূর থেকে তাকে দেখলে সাথে সাথেই তারা যা করছিলেন তা বন্ধ করে দিতেন আর স্থির আর সতর্ক হয়ে দাঁড়াতেন সবাই, যতক্ষণ না তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সেই কক্ষের ভিতর দিয়ে অতিক্রম না করেন। অধস্তন কর্মচারীদের সাথে তার সাধারণ কথোপকথন যতটা কঠোর হতে পারে ততটাই কঠোর ছিল, সাধারণত সেগুলো মোট তিনটি বাক্য দিয়ে মূলত গঠিত: কত বড় সাহস আপনার? আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনি কার সাথে কথা বলছেন? আপনি কি জানেন আপনার সামনে কে দাড়িয়ে আছে? তবে হৃদয়ে তিনি একজন ভালো মানুষ ছিলেন, তার বন্ধুদের প্রতি অনুগত ছিলেন, তাদের সাহায্য করতে সদাপ্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু জেনারেল পদবীটি তাকে আমূল পরিবর্তন করেছিল।

তার পদোন্নতি কোনো না কোনোভাবে তাকে বেশ হতভম্ব করে দিয়েছিল, আর তিনি ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিভাবে তার আচরণ করা উচিৎ সে বিষয়ে আসলেই কোনো ধারণা ছিল না তার। যখন তিনি তার সমকক্ষদের মধ্যে থাকতেন, তখন তিনি খুবই ভদ্র মানুষ, আচরণে নম্র ও বাস্তবিকভাবে ভদ্র এবং বহু ক্ষেত্রেই এমনকি বেশ বুদ্ধিমানও। কিন্তু যখন তিনি সুযোগ পান সেই সব মানুষদের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করতে, এমনকি যারা পদবীতে তার চেয়ে মাত্র এক ধাপ নীচে, তিনি পুরোপুরিভাবে দিশেহারা একজন মানুষ : একটি শব্দও তিনি বলতে পারেন না এবং মানুষ তার জন্য করুণা অনুভব করতো। আরো বেশী কারণ, এমনকি তিনিও অনুভব করেছেন যে তার সময় তিনি অতুলনীয়ভাবে ভালো কাটাতে পারতেন। কখনো তার চোখ বিশ্বাসঘাতকতা করে কোনো মজার গ্রুপ অথবা কথোপকথনে জড়াতে তার তীব্র ইচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়ে, কিন্তু সবসময় তিনি নিজেকে সংযত করতেন এমন কিছু করতে, এই ভেবে যে বিষয়টি অনেক দূর গড়াতে পারে, আর এইসব বেশী বন্ধুভাবাপন্নতা তার গুরুত্ব হ্রাস করবে। এবং এইসব বিবেচনার কারণে, তিনি চিরকালই নীরবতার একই ধরনের একটি পরিস্থিতিতে থাকেন, শুধুমাত্র একাক্ষরিক শব্দ উচ্চারণ করে, আর এভাবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন আসাধারণভাবে ক্লান্তিকর, বিরক্তিকর একজন মানুষ হিসাবে। ইনি হচ্ছেন সেই ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তি, যার কাছে আমাদের আকাকি আকাকিয়েভিচ আবেদন করেছিলেন, আর তিনি আবেদন করেছিলেন খুব দুর্ভাগ্যজনক একটি মুহূর্তে, যে মুহূর্তটি ছিল তার জন্যে খুবই অনুপযুক্ত। যদিও, অন্যদিকে, সেটি ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটির’ জন্য বেশ উপযুক্ত মুহূর্ত। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি তখন ছিলেন তার অফিসে, পূর্বপরিচিত একজনের সাথে খুব ভালো মেজাজে গল্প করছিলেন। অতিথি তার শৈশবের একজন বন্ধু, যিনি সম্প্রতি রাজধানীতে এসেছেন. যার সাথে তার দেখা হয়নি বেশ কয়েক বছর। ঠিক তখনই তাকে অবহিত করা হয় জনৈক বাশমাচকিন তার সাথে দেখা করার আর্জি পেশ করেছেন। ‘কে তিনি?’ তিনি বেশ বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করেন। ‘কোনো একজন কেরানি অথবা তেমন কিছু’, উত্তর আসে। ‘ওহ, সে অপেক্ষা করতে পারবে, এটা ঠিক সময় না’, বলেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি।

এখানে আমাকে অবশ্যই পর্যবেক্ষণ করতে হবে যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি নির্লজ্জভাবে মিথ্যাচার করেছেন: ঠিক এটাই ছিল সঠিক মুহূর্ত। তিনি ও তার বন্ধুর পরস্পরকে যা বলার ছিল তা বলা শেষ হয়ে গেছে বহুক্ষণ আগে, এখন তারা তাদের কথোপকথনকে বাধাগ্রস্ত করছেন অতিমাত্রায় দীর্ঘ নীরবতার বিরতি দ্বারা, যে সময়টিতে তার একে অপরের উরুতে হালকা চাপড় মেরে পুনরাবৃত্তি করছিলেন, ‘বেশ, বেশ, ইভান আব্রামোভিচ’ আর ‘তাহলে এই হলো অবস্থা স্টেপান ভারলামোভিচ!’ যাই হোক তিনি কেরানিকে অপেক্ষায় বসিয়ে রাখেন, যেন তিনি তার বন্ধুটিকে বিষয়টি স্পষ্ট করে দেখাতে পারেন, যিনি কিছু দিন আগে সরকারী চাকরী ছেড়েছেন তার গ্রামের জমিদারীতে থিতু হয়ে বসার জন্য, যে কতক্ষণ কেরানিরা তার সামনের কক্ষে অপেক্ষা করে। পরিশেষে আরো কথা বলে, এবং আরো বেশী নীরব থেকে – মনের সাধ মিটিয়ে এবং হেলান পেছনসহ একটি অত্যন্ত আরামদায়ক আর্ম চেয়ারে সিগার ধূমপান করে তার যেন হঠাৎ করেই মনে হয়, এবং তিনি তার একজন সহকারীকে বলেন, যে দরজার কাছে কিছু কাগজ নিয়ে দাড়িয়ে ছিল, রিপোর্ট করার জন্য। ‘আহ, হ্যাঁ, আমার মনে হয় একজন কেরানি অপেক্ষা করছেন আমার সাথে দেখার করার জন্য। তাকে ভিতরে আসতে বলুন’।

আকাকি আকাকিয়েভিচের সাদামাটা উপস্থিতি আর বহু পুরোনো ইউনিফর্মটি লক্ষ্য করেন তিনি প্রথমে, তারপর হঠাৎ করে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনার জন্য আমি কি করতে পারি?’ তার কণ্ঠ শুনতে রূঢ়, শীতল আর কঠোর শোনায়, জেনারেল র‍্যাঙ্কে পদোন্নতি ও তার বর্তমান পদে আসীন হবার আগে যা তিনি বিশেষভাবে অনুশীলন করেছিলেন একাকী আয়নার সামনে দাড়িয়ে পুরো এক সপ্তাহ ধরে। আকাকি আকাকিয়েভিচের, যিনি উপযুক্তভাবেই লাজুক ও অন্তর্মুখী ছিলেন বেশ কিছুটা সময় ধরে, খানিকটা অস্থির হয়ে উঠলেন এবং তার পক্ষে যতটা ভালোভাবে সম্ভব, তার লাজুক চরিত্র তাকে যতটা অনুমতি দিয়েছিল, এমনকি সাধারণ সময়ের তুলনায় অনেক বেশী মাত্রায় তার ইতস্ততমূলক অপ্রধান শব্দ ‘ইয়ে’ ব্যবহার করে, ‍তিনি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন তার গ্রেটকোটটা পুরোপুরি নতুন এবং খুবই অমানবিকভাবে সেটি ছিনতাই করে নেয় হয়েছে তার কাছ থেকে, এবং তিনি এখন তার কাছে প্রার্থনা করছেন, তিনি যেন, ইয়ে, বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেন এবং সম্মানিত পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট অথবা অন্য কারো কাছে একটি চিঠি লিখে দেন এবং তার গ্রেটকোটটি কোথায় আছে সেই বিষয়ে যেন তারা তথ্য উদ্ধার করতে তৎপর হয়।

তবে জেনারেল, অজানা কোনো একটি কারণে ভেবেছিলেন, তাকে যেন খুব বেশী পরিচিত এমন কেউ হিসাবে সম্বোধন করা হচ্ছে, ‘এটা কি, ‘আমার প্রিয় মহোদয়’? রূঢ় ভাবে তিনি বলেন, ‘আপনি কি সঠিক পদ্ধতি জানেন না? কেন আমার কাছে এসেছেন আপনি? আপনি জানেন না এই বিষয়ে সঠিকভাবে কিভাবে অগ্রসর হতে হয়? আপনার উচিৎ ছিল প্রথমে অফিসে একটি দরখাস্ত দাখিল করা, সেই দরখাস্ত প্রধান কেরানির কাছে যেত, তারপর সেটি আসতো শাখা প্রধানের কাছে, তারপর সেটি পাঠানো হতো সহকারীকে এবং সহকারী বিষয়টি আমার কাছে উপস্থাপন করতেন।’

আকাকি আকাকিয়েভিচ, তার শান্ত স্থির মেজাজের সবটুকু বিনম্রতা জড়ো করে এবং একই সাথে তিনি যে ভীষণভাবে ঘেমে উঠছেন বিষয়টি লক্ষ্য করেই বলেন, ‘কিন্তু মাননীয় জেনারেল, আপনার মত অতি মহামান্য ব্যক্তিকে আমি বিরক্ত করার সাহস করেছি, কারণ, ইয়ে, সহকারীরা খুব একটা নির্ভরযোগ্য মানুষ না…।’

‘কি, কি, কি?’ বললেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি, ‘কে আপনাকে এত ধৃষ্টতা শিখিয়েছে? এই সব ধারণা আপনি পেলেন কোথা থেকে? ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আর প্রধানদের বিরুদ্ধে তরুণদের সংক্রমণ করা এই বিদ্রোহ করার এই ইচ্ছা আসলে কি?’ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি স্পষ্টতই লক্ষ্য করার চেষ্টা করেননি যে, আকাকি আকাকিয়েভিচের বয়স ইতিমধ্যে পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। সেকারণে, আসলে কি সম্ভব তাকে তরুণ বলে তথ্য নির্দেশ করা, এটি হয়তো তুলনামূলকভাবে কিছু বলা হতে পারে, মানে, এমন কারো সাপেক্ষে যিনি কিনা অন্ততপক্ষে সত্তর। ‘আপনি জানেন কার সাথে কথা বলছেন? আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনার সামনে কে দাড়িয়ে আছেন? আপনি বিষয়টি বুঝতে পারছেন, আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি, আপনি এই বিষয়টি কি বুঝতে পারছেন?’ এই পর্যায়ে তিনি বেশ জোরে তা পা দিয়ে মাটিতে লাথি মারতে শুরু করেন, আর তার গলার স্বর এত তীব্র উচ্চতায় তুলে হুঙ্কার করেন যে আকাকি আকাকিয়েভিচের চেয়ে অনেক শক্ত মানুষও তা শুনে আতঙ্কিত হতেন। আকাকি আকাকিয়েভিচ ভয়ে অসাড় হয়ে যান তাৎক্ষনিকভাবে। তিনি এলোমেলোভাবে টলতে থাকেন, তার শরীর কাপতে শুরু করেছিল, সোজা হয়ে দাড়িয়ে থাকার আর কোনো ক্ষমতাই তার থাকে না, যদি দরজায় দাঁড়ানো দ্বাররক্ষীটি দৌড়ে এসে তাকে না ধরতো, তাহলে তিনি মেঝেতেই ধপাস করে পড়ে যেতেন। তার প্রায় অসাড় শরীরটাকে বাইরে বের করে আনা হয়। আর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি বেশ সন্তুষ্ট হয়েছিলেন , কারণ তিনি যা আশা করেছিলেন তার চেয়ে বেশী প্রভাব তিনি সৃষ্টি করতে পেরেছেন, এবং তিনি পুরোপুরি মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিলেন সেই ভাবনায় যে, তার উচ্চারিত শব্দ কোনো মানুষকে অজ্ঞান করে ফেলতে পারে। এবং তিনি তার বন্ধুটির দিকে আড়চোখে তাকান এসব দেখে তার প্রতিক্রিয়াটি কি দেখতে, এবং খানিকটা অসন্তুষ্ট হয়েই তিনি লক্ষ্য করেন যে তার পরিচিত মানুষটি খুবই অনিশ্চয়তাপূর্ণ অস্থির একটি একটি মানসিক অবস্থার মধ্যে আছে, এবং এমন কি তিনি নিজেও ভয় পেতে শুরু করেছেন।

কিভাবে তিনি সিঁড়ি দিয়ে নেমেছিলেন, আর কিভাবে তিনি রাস্তায় আসলেন, আকাকি আকাকিয়েভিচের পক্ষে কিছু মনে করা সম্ভব ছিল না। তার হাত অথবা পায়ে কোনো অনুভূতিও ছিল না, তার জীবনে কখনো কোনো জেনারেল তাকে এত তীব্র তিরস্কার করেননি, এমনকি অন্য কোনো বিভাগের কেউ তো বহু দূরের কথা। বারবার ফুটপাথের প্রান্ত থেকে হোঁচট খেয়ে তিনি পড়ে যাচ্ছিলেন, তার মুখ ছিল হা করা, রাস্তার দৈর্ঘ্য বরাবর শিস তুলে প্রবাহিত তুষার-ঝড়ের মধ্যে দিয়ে তিনি হাটছিলেন, বাতাস, পিটার্সবুর্গের যেমন রীতি, কম্পাসের চার দিকেরই সব দিক থেকে তার প্রতি ধেয়ে আসছিল, প্রতিটি পার্শ্ব রাস্তা থেকে। শুধুমাত্র এক মুহূর্তের মধ্যে এই বাতাস তার গলায় একটি প্রদাহ প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিল এবং যখন তিনি বাসায় পৌঁছান তিনি একটি শব্দও আর উচ্চারণ করতে পারছিলেন না। তার টনসিল তখন ফুলে গেছে, তিনি বিছানায় শুয়ে পড়েন। মাঝে মাঝে বড় আর সঠিক ধরনের তিরস্কারের প্রভাব এত শক্তিশালী হতে পারে। পরের দিন তিনি টের পান যে তার গায়ে তীব্র জ্বর। পিটার্সবুর্গের জলবায়ুর অশেষ দয়া ও সহযোগিতায়, যা প্রত্যাশা করা যেতে পারে তার চেয়েও দ্রুত তার অসুস্থতা অগ্রসর হয়েছিল, আর যখন ডাক্তার এসে তার নাড়ী পরীক্ষা করে দেখেছিলেন, তিনি যা করার জন্য অনুভব করতে পেরেছিলেন তা হলো, পুলটিস দেবার একটি ব্যবস্থা পত্র দেয়া, শুধুমাত্র অসুস্থ মানুষটি যেন অনুভব না করেন যে তিনি পুরোপুরিভাবে চিকিৎসা সাহায্যের কোনো উপযোগিতা ছাড়া আছেন। তবে এই সাথে তিনি ঘোষণা করেন যে দেড় দিনের মধ্যে অবশ্যই আকাকি আকাকিয়েভিচের সব কিছু শেষ হয়ে যাবে। এরপর তিনি বাড়িওয়ালীর দিকে ফিরে বলেন, ‘আর আপনি, ভদ্র মহোদয়া, ভালো হয় যদি সময় নষ্ট না করেন। আপনি তার জন্য বরং একটি পাইন কাঠের কফিনের অর্ডার দেন এখুনি। কারণ ওক কাঠের কফিন তার জন্য বেশী দামী হয়ে যাবে’।

আকাকি আকাকিয়েভিচ এই ভয়ঙ্কর নিয়তি নির্দিষ্ট উচ্চারণ আদৌ শুনেছিলেন কিনা বা শোনেননি সেটি নিশ্চিত নয়, যদি তিনি শুনতেন, তার উপর এটি সর্বনাশা একটি প্রভাব ফেলতো নিশ্চয়ই। হয়তো বা হয়তো না, তিনি তার করুণ জীবন নিয়ে কোনো আক্ষেপ করেছিলেন কিনা – এসবের কোনো কিছুই জানা নেই ,কারণ তিনি একটি ঘোর আর জ্বরের মধ্যে ছিলেন। অশরীরী আত্মারা,একটার চেয়ে আরেকটি যা আরো অদ্ভুত, ক্রমাগত তাদের নিজেদের তার সামনে উপস্থাপন করছিল। একটি মুহূর্তে তিনি পেত্রোভিচকে দেখতে পাচ্ছিলেন, এবং তাকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন তাকে একটা গ্রেটকোট বানিয়ে দেবার জন্য যার মধ্যে এমন ফাঁদ থাকবে যা চোরদের ধরতে সাহায্য করবে, যাদের তিনি তার বিছানার নীচে লুকিয়ে আছে বলে কল্পনাও করছিলেন, এবং তিনি অবিরামভাবে তার বাড়িওয়ালীর কাছে অনুনয় করছিলেন, তার কম্বলের নীচে লুকিয়ে থাকা চোরটিকে যেন তিনি টান দিয়ে বের করে আনেন। পরে তিনি জিজ্ঞাসা করছিলেন কেন পুরোনো ড্রেসিং গাউনটা এখনও সেখানে ঝোলানো আছে, যখন কিনা তার এখন একটি নতুন গ্রেটকোট আছে। এরপর তিনি কল্পনা করেন তিনি জেনারেলের সামনে দাড়িয়ে আছেন, খুব ভালোভাবে তার তিরস্কার শোনার পর তিনি বারবার বলছেন, ‘আমি দুঃখিত মাননীয় জেনারেল’ এবং সবশেষে তিনি এমনকি ঈশ্বর নিন্দা ও ভয়ঙ্কর সব শব্দ উচ্চারণ করতে লাগলেন প্রলাপ হিসাবে, এবং সে কারণে তার বৃদ্ধ বাড়িওয়ালী, সারাজীবনে তার কাছ থেকে এমন কিছু কোনোদিনও শোনার অভিজ্ঞতা না থাকায় বারবার নিজের বুকে ক্রুশ চিহ্ন আঁকছিলেন। আরো বেশী কারণ এই সব সবচেয়ে ভয়ানক শব্দগুলো সবসময় ‘মহামান্য মহোদয়!’ শব্দটির পর পরই উচ্চারিত হয়ে আসছিল। এরপর তিনি পুরোপুরি আবোল তাবোল কিছু বলতে শুরু করেন, কোনো কিছু বোঝা সেখানে পুরোপুরি ছিল অসম্ভব।

তবে শুধুমাত্র যে বিষয়টি স্পষ্ট তাহলো তার অসংলগ্ন শব্দ আর চিন্তাগুলো সবকিছু একটি ও একই গ্রেটকোটকে নিয়ে আবর্তিত। অবশেষে, দুর্ভাগা আকাকি আকাকিয়েভিচ তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার ঘর কিংবা তার যা কিছু ছিল তার কোনোটাই তালাবন্ধ করে রাখা হয়নি, প্রথমত, তার কোনো উত্তরাধিকার নেই, দ্বিতীয়ত, খুব সামান্য জিনিসই তিনি রেখে গিয়েছিলেন: হাসের পালক দিয়ে বানানো কম্বলের একটি বান্ডিল, একগুচ্ছ সাদা দাপ্তরিক কাগজ, তিন জোড়া মোজা, দুই অথবা তিনটি বোতাম যা এসেছে তার প্যান্ট থেকে, আর তার ‘ড্রেসিং গাউন’, যার সাথে পাঠকরা ইতিমধ্যে পরিচিত। উত্তরাধিকার সূত্রে এই সবকিছু কে পেয়েছিল ঈশ্বরই জানেন। স্বীকার করতে হবে যিনি এই কাহিনীটি বলছেন, তিনি খোজ-খবর করার কোনো ঝামেলায় নিজেকে জড়াননি। আকাকি আকাকিয়েভিচকে তার বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া হয় ও তাকে সমাহিত করা হয়, আর পিটার্সবুর্গ আগের মতই অপরিবর্তিত থাকে আকাকি আকাকিয়েভিচ ছাড়া, যেন তিনি আদৌ কখনই সেখানে ছিলেন না। মৃত আর চিরকালের মত অপসৃত হয়েছেন সেই মানুষটি, যাকে কেউ কখনো সমর্থন করেনি, যাকে কেউ প্রিয় কিংবা আপন বলে ভাবেনি, এবং কেউই, এমনকি একজন প্রকৃতিবিজ্ঞানী, যিনি কিনা সাধারণ একটি মাছিকেও সুন্দর করে সাজিয়ে রাখেন আলপিনের সাথে গেঁথে আর অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে তা পরীক্ষা করে দেখেন, তার প্রতি কোনো আগ্রহ প্রদর্শন করেননি।

একটি মানুষ যিনি ধৈর্য ধরে তার অফিসের সহকর্মীদের উপহাস সহ্য করেছিলেন, এবং যিনি খুব বেশী কোনো সমস্যা সৃষ্টি না করে তার কবরেও প্রস্থান করেছিলেন। কিন্তু তার সামনে, যদিও, শুধুমাত্র তার জীবনের একেবারে শেষে, সাময়িকভাবে তার করুণ জীবনকে উজ্জীবিত করতে উপস্থিত হয়েছিল গ্রেটকোট রূপে এক প্রাণবন্ত অতিথি। এবং যার উপর পতিত হয়েছিল ভয়ঙ্কর সেই বিপর্যয়, ঠিক যতটা নিষ্ঠুর হয়ে পড়েছিল পৃথিবীর বহু রাজা আর জারদের উপর। তার মৃত্যুর কিছুদিন পর, তার প্রাক্তন বাসস্থানে অফিসের একজন পিয়ন এসে হাজির হয়েছিলেন নির্দেশ নিয়ে যে, আকাকি আকাকিয়েভিচকে অবশ্যই এখনই তার বিভাগীয় দপ্তরে যেতে হবে, অফিস প্রধান তাকে খুঁজছেন। কিন্তু পিয়ন বাধ্য হয় একা ফিরে গিয়ে রিপোর্ট করতে যে কেরানি আর কখনোই তার কাজে আসতে পারবেন না। ‘কেন?’ এমন প্রশ্নের উত্তরে সেই পিয়ন বলেছিলেন, ‘বেশ, কারণ হচ্ছে তিনি মারা গেছেন। তিন দিন হলো তাকে কবর দেয়া হয়েছে।’ এভাবে তার মৃত্যু সংবাদ পৌঁছেছিল তার কর্মস্থলে। আর পরের দিন তার জায়গা নিয়েছিল একজন নতুন কেরানি, যে কিনা বেশ দীর্ঘ দেহী, যার হাতে লেখা ততটা গোছানো আর সোজা নয় বরং উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অপরিষ্কার ও তির্যক।

কিন্তু কে কল্পনা করতে পেরেছিল আকাকি আকাকিয়েভিচের জন্য এটাই শেষ নয়, এবং মৃত্যুর পর বেশ কিছুটা সময় ধরে তিনি আরো সমস্যা তৈরি করার জন্য নিয়তি দ্বারা নির্ধারিত হয়েছিলেন, যেন, যে জীবন কেউ লক্ষ্য করেনি, তারই ক্ষতিপূরণ হিসাবে? কিন্তু এটাই ঘটেছিল, আর আমাদের এই করুণ কাহিনীটি অপ্রত্যাশিতভাবে বিস্ময়কর একটি উপসংহার অর্জন করতে পেরেছে সে কারণে।

সেইন্ট পিটার্সবুর্গে হঠাৎ করে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে কালিনকিন সেতুর আশে পাশে, এবং সেখান থেকে আরো দূরে বেশ কিছু জায়গা জুড়ে রাতের বেলায় সরকারী কেরানির ছদ্মবেশে একটি লাশ আবির্ভূত হয়েছে, যিনি তার হারিয়ে যাওয়া গ্রেটকোটটি পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করছেন। এবং তার হারানো গ্রেটকোটটি পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় এই মরা লাশটি প্রত্যেকের গা থেকেই তাদের গ্রেটকোট খুলে নিচ্ছেন, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদার কোনো তোয়াক্কা না করে, যে কোনো ধরনের গ্রেটকোট হোক না কেন: বিড়ালের লোম বা বিভারের লোম দিয়ে লাইন করা কোট, সুতি কাপড়ের লাইনিং করা কোট আর চামড়া, যা বহু মানুষ তাদের নিজেদের শীত থেকে রক্ষা করার জন্য বানিয়েছেন। বিভাগের একজন কেরানি দাবী করেন যে তার নিজের চোখে এই মৃত লাশটিকে দেখেছে এবং সাথে সাথেই তিনি তাকে আকাকি আকাকিয়েভিচ হিসাবে শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। তবে তিনি দুর থেকে সেই মৃত লাশটির ভীতিকর একটি আঙ্গুল নাড়ানো দেখে এতটাই ভয় পেয়েছিলেন যে, তার পা যতটা পারে ততটা দ্রুত তিনি সেখান থেকে পালিয়েছিলেন, সুতরাং খুব ভালো করে মৃত লাশটিকে তিনি পরীক্ষা করে দেখতে পারেননি। চারদিক থেকেই নানা ধরনের অভিযোগ আসতে শুরু করে, শুধুমাত্র টিটুলার কাউন্সিলরদের পিঠ আর কাঁধ নয়, প্রিভি কাউন্সিলররাও ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডার শিকার হয়েছেন তাদের গ্রেটকোটগুলোর রাত্রিকালীন ছিনতাই হবার ঘট।

পুলিশের প্রতি কড়া নির্দেশ জারি করা হয় যেভাবেই হোক এই সমস্যাটির কারণ জীবিত অথবা মৃত সেই মৃত লাশটাকে গ্রেফতার করতে হবে, এবং অন্যদের প্রতি উদাহরণ সরূপ তার কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে - এবং এই কাজটি করতে এমনকি তারা প্রায় সফলও হয়েছিলেন। মানে, কিরুশকিন লেনের কোথাও একজন পুলিশ সদস্য একটি মৃত লাশকে আসলেই কলার ধরে পাকড়াও করেছিলেন অপরাধ ঘটানোর সময়, যখন এক অবসরপ্রাপ্ত সঙ্গীতজ্ঞের কাছ থেকে একটি সৌখিন গ্রেটকোট ছিনতাই করার চেষ্টা করেছিল লাশটি, যিনি একসময় বাঁশী বাজাতেন। মৃত লাশটির কলার দুই হাতে ভালো করে ধরে পুলিশ তার দুই অন্য সহকর্মীকে চিৎকার করে ডেকেছিলেন, তারপর তিনি তাদের নির্দেশ দেন ভালো করে তাকে ধরে রাখতে কিছু মুহূর্তের জন্য, যখন তিনি খুব দ্রুত তার বুটের মধ্যে রাখা নস্যির কৌটাটা বের করতে নিচু হয়েছিলেন, কারণ তার নাক ততক্ষণে তীব্র শীতের আক্রমণের শিকার হয়েছে ছয়বার, তার দরকার ছিল সেটিকে খানিকটা জীবন্ত করে তোলা, কিন্তু তার নস্যি স্পষ্টতই খুব কড়া ছিল, এমনকি একটি মৃত লাশও সেটি সহ্য করতে পারেনি। যখনই পুলিশটি তার ডান নাকের ছিদ্রটি বন্ধ করেছিলেন একটি আঙ্গুল দিয়ে, বা নাকের ছিদ্র আধামুঠ নস্যি টেনে নেবার জন্য, মৃত লাশটি এত জোরে হাঁচি দিয়েছিলেন যে তাদের তিনজনের চোখই পুরোপুরিভাবে ভিজে যায়। কিন্তু যখনই তারা তাদের চোখ পরিষ্কার করার জন্য হাত উঠিয়েছিল, সেই মৃত লাশটিও তখন শূন্যে মিলিয়ে যায়, সুতরাং তারা এখনও এমনকি নিশ্চিত নন যে, তারা আসলেই তাদের হাতে লাশটিকে পাকড়াও করেছিল।
এরপর সেই পুলিশগুলো মৃত লাশ এত বেশী ভয় পেতেন যে তারা এমনকি জীবন্ত কাউকে পাকড়াও করতে গেলে সতর্ক হয়ে পড়তেন। বরং তারা দুর থেকে চিৎকার করে তাদের নির্দেশ দিতেন, ‘এই যে ওখানে, এখন সোজা সামনে এগুতে থাকো।’ এবং সেই কেরানি যিনি নিজে মৃত আরো বেশী বেশী করে কালিনকিন ব্রিজের ভুল দিকে আবির্ভূত হতে শুরু করেন, সব ভীরু মানুষের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক সৃষ্টি করে।

আমরা কিন্তু পুরোপুরি ভুলে গেছি সেই বিশেষ ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটির’ কথা, যিনি নিজেই, বাস্তবিকভাবে, প্রায় সম্পূর্ণভাবেই দায়ী এই অদ্ভুত কল্পনাপূর্ণ ঘটনা প্রবাহটির, যা ঘটনাচক্রে পুরোপুরিভাবে এই সত্য ঘটনায় মোড় নিয়েছিল। প্রথমত, ন্যায়বিচার করার মানসিকতাই আমাকে বাধ্য করেছে ঘটনাটি লিপিবদ্ধ করতে, আসলেই খুব জোরালোভাবে তিরস্কৃত সেই অসহায়, করুণ আকাকি আকাকিয়েভিচ তার দপ্তর থেকে চলে যাবার পর, সেই বিশেষ ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ মানুষটি খানিকটা অনুশোচনার মত কিছু অনুভব করেছিলেন। সমবেদনা তার চরিত্রে নতুন কিছু নয়। তার হৃদয় উন্মুক্ত নানা দয়াপূর্ণ তাড়নায়, যদিও, সেই বাস্তবতাটি সত্ত্বেও, তার পদমর্যাদা প্রায়শই সেই অনুভূতিগুলো প্রকাশ করার মতো পরিস্থিতি থেকে তাকে সুরক্ষা করতো। সেদিন যখনই তার গ্রামের বন্ধুটি তার দপ্তর ত্যাগ করেছিলেন, তিনি এমনকি কিছুটা সময় আকাকি আকাকিয়েভিচকে নিয়ে ভেবেছিলেনও। এবং তখন থেকে প্রায় প্রতিদিনই তিনি ফ্যাকাসে এক কেরানির মুখ দেখতেন, যিনি কিনা একটি দাপ্তরিক তিরস্কার সহ্য করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

আকাকি আকাকিয়েভিচের ভাবনা তাকে এতটাই অস্থির করেছিল যে, এমনকি এক সপ্তাহ পর তিনি তার দপ্তরের এক কেরানিকে পাঠিয়েছিলেন তার এখন কি অবস্থা সেই বিষয়ে খোঁজ নিতে, এবং আসলেই কি কোনো উপায় আছে কিনা এই মুহূর্তে সাহায্য করার জন্য। আর যখন তাকে জানানো হয়েছিল আকাকি আকাকিয়েভিচ হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, তিনি এমনকি বড় একটি ধাক্কাও অনুভব করেছিলেন। তিনি শুনতে পেরেছিলেন তার বিবেক তাকে বিড়বিড় করে কিছু বলছে, সারাদিনই তিনি বেশ বিষণ্ণতা অনুভব করেছিলেন। নিজের মনটাকে কিছুটা উৎফুল্ল করতে আর অস্বস্তিটাকে মন থেকে তাড়ানোর জন্য তিনি তার পরিচিত একজনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। যেখানে তার সঙ্গ ছিল সম্মানজনক, সবচেয়ে বড় ব্যাপার, তিনি নিজেকে সব বন্ধনমুক্ত মানুষ হিসাবে অনুভব করেছিলেন, কারণ সেখানে কম বেশী সবাই ছিল তার মত, একই পদমর্যাদা সম্পন্ন। তার মানসিক অবস্থার উপর এটি বিস্ময়কর একটি প্রভাব ফেলেছিল। তিনি কিছুটা শিথিল হয়েছিলেন, অমায়িক এবং চমৎকারভাবে কথোপকথনও করেছিলেন। সংক্ষেপে, তিনি সেই সন্ধ্যাটা বিশেষভাবে উপভোগ করেছিলেন। দুই গ্লাস শ্যাম্পেনও পান করেছিলেন রাতের খাবারের সাথে, আমরা সবাই জানি যা সুখানুভূতি সৃষ্টির জন্য এটি খুবই কার্যকরী একটি উপায়। এছাড়াও শ্যাম্পেন কিছু সুনির্দিষ্ট কাজ করার জন্য উপযুক্ত একটি মেজাজও সৃষ্টি করেছিল তার মধ্যে, তিনি সিদ্ধান্ত নেন তখনই বাসায় না যাবার জন্য, বরং একজন বিশেষ ভদ্রমহিলার সাথে দেখা করতে বের হয়েছিলেন, ক্যারোলিনা ইভানোভনা, যিনি স্পষ্টতই জার্মান বংশোদ্ভূত এবং যার সাথে তার সম্পর্ক ছিল খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ।

উল্লেখ করতে হবে যে, ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটির’, বয়স অবশ্যই কম ছিল না, তিনি খুবই ভালো স্বামী ও সম্মানিত পারিবারিক মানুষ ছিলেন। দুটি পুত্র, যাদের একজন ইতিমধ্যে সরকারী চাকরীতে, এবং দেখতে খারাপ নয় মোটেও এমন একটি ষোল বছরের মেয়ে ছিল তার। যদিও তার নাকটি খানিকটা বোচা, তবে একই সাথে খুব সুন্দর, যে প্রতিদিন তার হাতে চুমু খেতে আসতো, ‘শুভদিন বাবা’ বলে। তার স্ত্রী যিনি এখনও বিকশিত হচ্ছেন, এবং অবশ্যই কোনোভাবে যিনি অনাকর্ষণীয় নয়, যিনি প্রথমে তার নিজের হাত এগিয়ে দেন তাকে চুমু খাবার জন্য, পরে তার হাতে চুমু খান, হাতটিকে উল্টো করে ধরে। কিন্তু ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি’, যদিও তিনি প্রসঙ্গক্রমে, পুরোপুরিভাবে সন্তুষ্ট তার গৃহস্থালি স্নেহপরায়ণতায়, তারপরও যথাযথ মনে করেছিলেন শহরের অন্য অংশে বসবাসরত এক মহিলার সাথে বিশেষ বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য। তার এই নারী সঙ্গিনী কোনোভাবেই সুন্দরী বা বয়সে তো অবশ্যই কম নয় তার স্ত্রীর কাছ থেকে। কিন্তু পৃথিবীতে বহু এমন ধাঁধা আছে, আর সেগুলো সমাধান করাও আমাদের কাজ নয়। সুতরাং সেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি নীচে নেমে আসেন, তার শ্লেড গাড়ীতে উঠে বসেন ও চালককে বলেন, ‘ক্যারোলিনা ইভানোভনার ওখানে চলো’।

খুব বিলাসী উষ্ণ গ্রেটকোটে আবৃত হয়ে তিনি চমৎকার একটি পরিস্থিতিতে প্রবেশ করেন, যার চেয়ে আর উত্তম কিছু রুশদের পক্ষে অকল্পনীয়: যে পরিস্থিতিতে আপনি নিজে কোনো কিছু আদৌ চিন্তা করেন না কিন্তু তারপরও চিন্তাগুলো, প্রতিটি এর আগেরটির চেয়ে সুখকর, তাদের নিজেদের মর্জি মাফিক আপনার মাথার মধ্যে প্রবেশ করে, সেই সব চিন্তাগুলোকে খোঁজার জন্য তাদের পেছনে দৌড়ানোর মত অহেতুক কোনো সমস্যায় আপনাকে না ফেলে।

পূর্ণ সন্তোষসহ, তিনি কোনো পরিশ্রম ছাড়াই সেই সন্ধ্যার সব আনন্দময় মুহূর্তগুলো স্মরণ করতে পারলেন, সব শব্দগুলো যা তার ক্ষুদ্র চক্রের উচ্চকণ্ঠের হাসির আওয়াজ সৃষ্টি করেছিল। তিনি এমনকি তাদের অনেকগুলোই পুনরাবৃত্তি করেন আপন মনে, আগের মতই সেগুলো তাকে আনন্দ দেয়। খুব অবাক হবার মত কোনো বিষয় না, এই সবই তার মুখে আনন্দের হাসি এনেছিল। বারবার, তবে, তিনি বিঘ্নিত হচ্ছিলেন হঠাৎ করে ভেসে আসা দমকা বাতাসে, কোথা থেকে যে সেই বাতাসের উৎপত্তি হচ্ছিল তা ঈশ্বরই জানেন এবং স্পষ্টত কোনো কারণ ছাড়াই, তীব্র ঠাণ্ডার সেই বাতাসে তিনি মুখের চামড়ায় বেশ যন্ত্রণাও অনুভব করছিলেন, চোখের মধ্যে বরফ কুচি ছুড়ে দিয়ে সেই দমকা ঠাণ্ডা বাতাস নৌকার পালের মত করেই তার কোর্টের কলারগুলো বারবার ফুলিয়ে তুলেছিল, হঠাৎ করেই যেন অতিপ্রাকৃত কোনো শক্তি বারবার সেগুলো উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তার মাথার ওপরে। আর সেই জ্বালাতন থেকে মুক্তি পেতে তার প্রচেষ্টায় অবিরাম বিঘ্নতা সৃষ্টি করে সেই দমকা বাতাস তাকে বেশ বিরক্ত করছিল। হঠাৎ করেই সেই ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি’ অনুভব করেছিলেন, কেউ যেন অত্যন্ত শক্তভাবে তার কলার চেপে ধরে আছে। পিছনে তাকাতেই, তিনি জীর্ণ পুরোনো ইউনিফর্ম একটি খাটো মানুষকে দেখেন, এবং অবশ্যই আতঙ্কের সাথে, আকাকি আকাকিয়েভিচ হিসাবে তিনি তাকে শনাক্ত করেছিলেন। কেরানির মুখ ছিল বরফের মত ফ্যাকাসে, মৃত লাশের মতই ঠিক দেখতে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ মানুষটির চরম আতঙ্ক সব পরিমাপই ছাড়িয়ে গিয়েছিল যখন তিনি মৃত মানুষটির মুখ খানিকটা বাঁকা হতে লক্ষ্য করেন, খোলা মুখ থেকে সেটি উগরে দিয়েছিল কবরের ভয়ঙ্কর দুর্গন্ধ, আর সেটি উচ্চারণ করেছিল এই শব্দগুলো: ‘আহ! তাহলে আপনাকে পাওয়া গেল, অবশেষে, এখন তাহলে, ইয়ে, আমি আপনার কলার চেপে ধরেছি, আপনার গ্রেটকোটটাই আমার দরকার। আপনি আদৌ বিচলিত হননি আমরাটা খুঁজতে সাহায্য করার জন্য, আর এমনকি যা প্রত্যাশিত ছিল আপনি আমাকে তার চেয়েও বেশী গালমন্দ করেছিলেন - সুতরাং এখন আপনি আপনারটা আমাকে দেন।’

সেই অসহায় ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি’ প্রায় তার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন, কারণ অফিসে চরিত্রের যে শক্তি তিনি প্রদর্শন করেন, সাধারণত তার অধীনস্থ কর্মচারীদের সাথে, আর এমনকি তার পুরুষালী কাঠামো ও আচরণ দেখাই যথেষ্ট কোনো মানুষের মন্তব্য প্ররোচিত করার জন্য, ‘বাপরে বাপ, কি চরিত্র,’ যাই হোক, সেই মুহূর্তে, বীর কোনো যোদ্ধার বৈশিষ্ট্যসহ বহু মানুষের মত তিনি বেশ তীব্রভাবেই ভয় পেতে শুরু করেন যে - আর অবশ্যই বিনা কারণে নয় – হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে এক ধরনের স্নায়ু-বৈকল্যের স্বীকার হবেন তিনি। যতটা দ্রুত সম্ভব তিনি তার গ্রেটকোটটি ছুড়ে দেন আর চিৎকার করে চালককে তার নিজের নয় এমন কণ্ঠস্বরে চিৎকার করে বলেন, ‘বাড়ি চলো, যত দ্রুত তুমি পারো’। আর চালক সমস্যার কোনো মুহূর্ত সংশ্লিষ্ট এমন একটি কণ্ঠস্বর শুনে, যার সাথে সুস্পষ্টভাবে খুব জোরালো নির্দেশ জড়িত, নিজেকে বাঁচাতে তার মাথা খানিকটা নিচু করে ঘাড়ের মধ্যে রেখে, তার চাবুক চালায় এবং তীরের গতিতে সে এগিয়ে যায়। ছয় মিনিটের চেয়ে সামান্য বেশী কিছু সময়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তার বাড়ির সামনে চলে আসেন। ফ্যাকাসে, ভয়ঙ্করভাবেই শঙ্কিত, কোনো গ্রেটকোট ছাড়া, ক্যারোলিনা ইভানোভনার কাছে না গিয়ে তিনি বাসায় ফিরে এসেছিলেন। খানিকটা ভারসাম্যহীনভাবে টলতে টলতে তিনি তার নিজের ঘরে যান, এবং খুব অস্থিরতার সাথে তিনি সেখানে রাত কাটান আর তার ফলাফল ছিল সকালে খাবারের সময় তার মেয়ে তাকে সরাসরি বলে, ‘আজ তোমাকে খুব ফ্যাকাসে লাগছে, বাবা।’ কিন্তু বাবা কোনো উত্তর দেননি। কি ঘটেছে সে বিষয়ে একটি শব্দও তিনি কারো কাছে উচ্চারণ করেননি, কোথায় তিনি গিয়েছিলেন অথবা কোথায় যাওয়া তার উদ্দেশ্য ছিল।

ঘটনাটি তার উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এরপর, অনেক কম সংখ্যকবারই তিনি তার অধীনস্থ কর্মচারীদের বলেছিলেন, ‘কত সাহস আপনার? আপনি জানেন কে আপনার সামনে দাড়িয়ে আছেন?’ আর যদি তিনি এ ধরনের কোনো শব্দ উচ্চারণও করতেন, প্রথমে অধীনস্থ কর্মচারীটি কি বলতে চাইছেন সেটি শোনার পরই শুধুমাত্র তা উচ্চারণ করতেন। কিন্তু আরো বেশী উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হচ্ছে, এরপর থেকে মৃত সেই কেরানির অশরীরী উপস্থিতি পুরোপুরিভাবে থেমে যায়। জেনারেলের গ্রেটকোট নিশ্চয়ই তার গায়ের সাথে ভালোই মানানসই ছিল। আর যাই হোক না কেন, গ্রেটকোট ছিনিয়ে নেবার আর কোনো ঘটনার কথা শোনা যায়নি।

তাসত্ত্বেও বহু সক্রিয় আর উদ্বেগপূর্ণ জনগোষ্ঠী আশ্বস্ত হতে অস্বীকার করেছিলেন এবং তারা বলা অব্যাহত রেখেছিলেন যে মৃত সেই কেরানির অশরীরী আত্মাটি এখনও শহরের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় আবির্ভূত হচ্ছে। একজন কোলোমনা (২১) পুলিশ সদস্য সত্যিই, তার নিজের চোখে, একটি দালানের পিছন থেকে সেই অশরীরী আত্মাকে বের হয়ে আসতে দেখেছিলেন। কিন্তু খানিকটা দুর্বল হবার সুবাদে – এতটাই দুর্বল যে একবার একটি প্রাপ্তবয়স্ক তরুণ শূকর, যে কিনা কারো বাড়ি থেকে দৌড়ে বের হয়ে আসছিল তাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল, আশে পাশে দাঁড়ানো ভাড়া স্লেড গাড়ির চালকদের দারুণ মজার কারণ হয়েছিল সেই ঘটনাটি, পরে যাদের প্রত্যেককে অর্ধেক কোপেক করে তিনি জরিমানা করেছিলেন, যেন তার জন্য কিছু নস্যি কিনতে পারেন – তিনি, যেমন আমি বলছিলাম, খানিকটা দুর্বল হবার কারণে সাহস করেননি তাকে আটকাতে যাবার জন্য, শুধুমাত্র তাকে অনুসরণ করেছিলেন অন্ধকারে যতক্ষণ না অবধি ভুতটি হঠাৎ করে পেছন ফিরে তাকিয়েছিল, আর থেমে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘পিছু নিয়েছেন কেন, কি চাই?’এবং তার মুষ্টিবদ্ধ হাতও প্রদর্শন করেছিল, যা আপনি এমনকি জীবিত কোনো মানুষের মধ্যেও দেখতে পাবেন না। পুলিশ সদস্যটি কোনোমতে বলেছিলেন, ‘কিছু না’ আর সাথে সাথেই তিনি উল্টোদিকে পা বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু এই ভূতটি ছিল অপেক্ষাকৃত লম্বা ও তার বিশাল একটি গোঁফও ছিল এবং স্পষ্টতই তিনি ওবুকভ ব্রিজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, এরপর এটি রাতের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায়।
(সমাপ্ত)

টিকা:
২১ কোলোমনা: গোগোলের সময় সেইন্ট পিটার্সবুর্গের খানিকটা বাইরের একটি জেলা।

আপনার মন্তব্য