পাহাড়-নদীর ভালোবাসা

 প্রকাশিত: ২০১৭-০৪-০৫ ০১:৫৮:২৭

আফরিন জাহান হাসি:

আমার পাহাড়ের সামনে দিয়েই চলে গেছে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যাওয়ার রাস্তা। বাংলোর বারান্দার পর থেকেই আমার পাহাড়টি ঢালু হয়ে এসে মিশেছে সেই রাস্তায়।

“দাঁড়াও দাঁড়াও; তোমার পাহাড়! খুব মজার তো! ওটা তোমার পাহাড় হয়ে গেছে”- সুস্মিতা কে থামিয়ে দেয় ওর ভাই।

সুস্মিতা কপট রাগ দেখায়, আহা! বলতে তো দাও, আমার পাহাড়ই তো!

ওকে ঘিরে বসে আছে ওর ভাই আর তার বন্ধুরা, সবাই এসেছে ওর পাহাড়ের গল্প শুনতে। পাহাড়ি ঝরনার মত ছলছলিয়ে সুস্মিতা আবার বলে চলে।

বারান্দা থেকে রাস্তাটিকে খুব সরু মনে হয়, আসলে অত সরু না তা। চিটাগাং আর রাঙামাটি যাওয়ার জন্য ঐ রাস্তাই ব্যবহার করতে হয়। রাস্তা থেকে বাংলোটিকে মনে হয়, পাহাড়ের উপর ছোট্ট সুন্দর রূপকথার ঘর। বারান্দার ছাদ এর ঢাল থেকেই ঝুলে আছে নানা ধরণের টব, মাঝ বরাবর রেলিঙ এও টবে রাখা নানা অর্কিড আর ফুলের গাছ।

বারান্দার সামনে দিয়ে চিকন পায়ে চলা পথ, আর তার পর থেকেই পাহাড় ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে রাস্তা পর্যন্ত। এত বড় পাহাড় আমার, কী যে সবুজ আর স্নিগ্ধ! সারা পাহাড়েই সুন্দর করে ঘাস ছেঁটে রাখা, আর কত রকমের ফলের গাছ। বারান্দায় বসে সেসব বড় বড় বৃক্ষের মাথা থেকে পা পর্যন্ত আমি দেখতে পাই। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য, ছাতার মত পুরো গাছটা আমার থেকে নিচে, কিন্তু পাহাড়ের ঢালে বলে কেমন যেন মনে হয় কেউ হাতে করে আমার সামনে ধরে আছে আর বলছে দেখ কত সুন্দর এই গাছগুলো।

আমার পাহাড় সত্যি বিশাল, এর বুকে কত কিছু জানো! মাঝ বরাবর অফিস, এরপর সৈনিকদের ব্যারাক, তারপর ব্যাডমিন্টন খেলার জায়গা। এরপর আরও উপরে উঠলে পানির ট্যাঙ্কি, আরও কিছুদূর উঠে একটা মসজিদ। আবার পাহাড়টি বাঁক নিয়েছে, সেখানে আমার বাংলো। বাংলোর পেছনে পাহাড় আবার বাঁক নিয়ে উপরে উঠে গেছে, সেখানে আমার পাহাড়ের চূড়া, কিছুটা সমান, বিস্তৃত, ওখানেও সৈনিকদের ব্যারাক আছে, সবজির বাগান আছে। তোমরা বুঝতে পারছো, কত ছড়ানো এই পাহাড়। প্রায় আড়াইশ' পাকা সিঁড়ি একে বেঁকে শাড়ির আঁচলের মত জড়িয়ে আছে পাহাড়টি কে, কিছু আবার মাটি কেটে ইট দিয়ে, বাঁশ দিয়ে বানানো সিঁড়ি।

একজনের প্রশ্ন, “তোমার উঠতে কষ্ট হয় না?, প্রতিদিন কি ওঠা নামা করতে হয়?”

সুস্মিতা হেসে ওঠে, প্রথম প্রথম হত। সিঁড়ির ল্যান্ডিং এ চেয়ার দেয়া থাকতো, তাতে বসে বিশ্রাম নিয়ে তারপর আবার উঠতাম। পরে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া রোজ নিচে নামতেই হবে তা তো না। আমি শুধু আমার নদীটা কে কাছ থেকে দেখার জন্য নামতাম।

“বাহ বাহ! তোমার একটা নদীও আছে!”

সুস্মিতার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, কর্ণফুলীর স্ফটিক জল যেন ভেসে ওঠে ওর চোখে। হ্যাঁ, কাপ্তাই এর ঐ রাস্তার পাশ দিয়েই তো তীব্র আনন্দে ধেয়ে চলছে কর্ণফুলী। কী স্বচ্ছ তার পানি! পূর্ণিমা রাতে গভীর নদীর তলা পর্যন্ত যেন স্পষ্ট দেখা যায়। নদীর ওপাড়ে আবার পাহাড় আর সেই পাহাড়ে চা বাগান, লেবু বাগান। বারান্দায় বসে বসে নদীর ওপাড়ের পাহাড়ে আলো-ছায়ার খেলা দেখি আমি মুগ্ধ হয়ে। মেঘেরা বাগানের ভেতর ঘুরে বেড়ায়, উঁকি ঝুঁকি দেয়, আবার দূরে উড়ে চলে যায়। কখনো পাহাড়ের পেছনে লুকায়, কখনো আবার বৃষ্টি হয়ে ঝরে পরে। রৌদ্র- ছায়ায় ঐ পাহাড়ের রঙ বদলে যায়- গাঢ় নীল, ধূসর ছাই, স্নিগ্ধ সবুজ, কখনো আবার কড়া রোদে তীব্র লালচে একটা রঙ হয়। আমি দেখতে দেখতে ভাবি, ওপাড় থেকে আমার পাহাড়টিকেও এরকম রঙে রূপে ভরপুর লাগছে। অবশ্য নদীটিকে বারান্দা থেকে অনেক শান্ত মনে হয়।

আমার পাহাড় থেকে নেমে রাস্তাটা পার হলেই নদী। নদীর পাড়ে বিদ্যুত কেন্দ্রের একটা পাম্প হাউস, বেশ একটা বসার জায়গা আছে ওখানে। একটু অংশ এমনভাবে নদীর ভেতর ঢুকে গেছে, মনে হয় যেন একেবারে নদীর উপর বসে আছি। তীরে তীব্র স্রোতে পানি আছড়ে পড়ে শব্দের আলোড়ন তোলে। পাহাড়-নদীর মিতালিতে আমি আর সবুজ বসে থাকি। কখনো মুগ্ধ হয়ে ওদের প্রেম দেখি, কখনো আমরাই মুখর হয়ে উঠি।

“আচ্ছা, তাহলে তোমার পাহাড় আর নদীর মাঝে আবার প্রেমও আছে, তারা একে অপরকে ভালোবাসে!”

বাসেই তো! একজনের ভালোবাসা প্রবহমান- কখনো ধীর, কখনো চঞ্চল। আর একজনের স্থির, অবিচল। জানো নদী যে কত রকমে বয়ে চলে, সময় সময় কী যে মিষ্টি তার কলতান। একবার আমি আর সবুজ নদী পার হয়ে চা বাগানের গা ঘেঁষে হেঁটে যাচ্ছিলাম, বালির উপর আলতোভাবে যেন নদীটা ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে-তাতে ছলাৎ ছলাৎ করে মধুর ঝঙ্কার তৈরি হচ্ছে। এদিকে জন-বসতি নেই, তখন বিকেল, বাগানের লোকেরাও ঘরে ফিরে গেছে। কিছু পাখির কুঞ্জন আর মধুর ছন্দে নদীর আছড়ে পড়ার শব্দ। আমরা কথা ভুলে সেই শব্দে বিভোর হয়ে ছিলাম। অথচ এপারে যেখানে প্রায়ই বসি সেখানে কী প্রচণ্ড গর্জনে নদী তীরে আছড়ে পরে। তাই বলছিলাম নদীর ভালোবাসা কখনো ধীর, কখনো অস্থির।

সুস্মিতাকে হঠাৎ কেমন যেন দুঃখী মনে হয়। ওর ভাই বলে ওঠে, “তোমার পাহাড়-নদী দেখতে যেতে হবে, মনে হচ্ছে আমারও যদি থাকতো এরকম, ওদের ভালোবাসা কাছ থেকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।”

সুস্মিতা উত্তর না দিয়ে ভাবতে থাকে, পাহাড়-নদীর ভালোবাসা ওকে মুগ্ধ করে, ভাবায়। এমন সুন্দর ভালোবাসার মালিকানা তার নিজের এই আনন্দ ওকে বুঁদ করে রাখে। কিন্তু ওকে সব ত্যাগ করে চলে যেতে হবে। সবুজের চাকুরি সূত্রেই আজ তার এই অধিকার। সবুজের এ জায়গা থেকে বদলি হয়ে গেলেই ওকেও যেতে হবে। নতুন কেউ আসবে, মালিকানা বদলাবে।

নতুন মানুষের কল্পনায় চিরন্তন তাদের ভালোবাসা নতুন রূপে বয়ে চলবে।

আপনার মন্তব্য