মিকেলএঞ্জেলো এবং ঘুমন্ত কিউপিড

 প্রকাশিত: ২০১৭-০৪-১৫ ১৯:২৯:৪০

 আপডেট: ২০১৭-০৪-১৫ ১৯:৩৪:৩৭

ফরিদ আহমেদ:

ইউরোপীয় রেনেসাঁর একেবারে চূড়ান্ত অবস্থা, যেটাকে হাই রেনেসাঁ বলে, সেই পর্যায়ের শিল্পী হচ্ছেন মিকেলএঞ্জেলো। ইতালিতে জন্ম তাঁর। জন্মেছিলেন ১৪৭৫ সালে। এক সাথে অনেকগুলো গুণ নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। ছিলেন ভাস্কর, ছিলেন, চিত্রকর, ছিলেন কবি, সেই সাথে স্থাপত্যবিদ এবং প্রকৌশলীও ছিলেন তিনি। তাঁর করা অনেক ছবি, ভাস্কর্য এবং স্থাপত্য এখনো বিখ্যাত হিসাবে টিকে আছে। পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতকের অন্যতম সেরা মেধাবী শিল্পী ছিলেন তিনি। পাশ্চাত্য শিল্পকলাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবান্বিত করেছেন তিনি তাঁর অনন্য মেধা এবং সৃষ্টি দিয়ে।

সেটা ১৪৯৬ সাল। মিকেলএঞ্জেলোর বয়স তখন মাত্র বিশ বছর। বয়সে তরুণ তিনি। বয়স স্বল্পতার কারণে অনভিজ্ঞ। কিন্তু, অনভিজ্ঞ হলেও মেধার কোনো কমতি নেই তাঁর মধ্যে। এতো মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে নবীন এই শিল্পীকে তখন কেউ চেনে না বললেই চলে। শিল্পরসিক সমাজে তিনি উপেক্ষিত অচেনা হবার কারণে। কাজ করছেন তিনি, তৈরি করছেন একের পর এক শিল্পকর্ম। কিন্তু, এগুলোর প্রচার হচ্ছে না। লোকজন জানতেই পারছে না যে অনন্য একজন শিল্পী এসেছে এই ধরায়, যিনি একদিন বদলে দেবেন পাশ্চাত্যের শিল্প ধারাকে। তাঁর শিল্পকর্মের ক্রেতা না থাকার কারণে এই তরুণ বেশ খানিকটা হতাশই তখন।

সেই সময় ঘুমন্ত ইরোজ বা ঘুমন্ত কিউপিড নামের একটা দুর্দান্ত ভাস্কর্য তৈরি করেছেন তিনি। নিজের নামে বিক্রি করলে বিক্রি করা যাবে না, বা কষ্ট করে ক্রেতা সংগ্রহ করতে পারলেও খুব বেশি দাম পাওয়া যাবে না, এই চিন্তা থেকে প্রতারণা করার দুষ্ট একটা বুদ্ধি মাথায় জাগে তাঁর। আগেই বলেছি তিনি তখন সদ্য তরুণ। সবেমাত্র পেরিয়ে এসেছেন কৈশোরকালকে। বয়স স্বল্পতার কারণে এই প্রতারণার পরিণতি কী হতে পারে, সেটা হয়তো বিবেচনায় আসে নি তাঁর। এই প্রতারণায় তিনি একা নন, তাঁর অপকর্মে সঙ্গী হয় এক আর্ট ডিলারও। খুব সম্ভবত এই লোকের মাথা থেকেই দুষ্ট বুদ্ধিটা এসেছিলো। আজ এতো দিন পরে আর নিশ্চিত করে বলার কোনো উপায় নেই। মিকেলএঞ্জেলোও এর উদ্যোক্তা হতে পারেন, কিংবা হতে পারে তাঁর সেই আর্ট ডিলার। যে দুষ্ট বুদ্ধিটা তাঁরা যৌথভাবে বাস্তবায়িত করতে চেষ্টা করেছিলো, সেটা হচ্ছে এরকম, এই কিউপিডটাকে, যেটা আসলে তৈরি করেছেন মিকেলএঞ্জেলো, সেটাকে প্রাচীন রোমান ভাস্কর্য বলে চালিয়ে দেওয়া হবে। এতে করে লোকে আগ্রহী হবে, খুব  সহজেই ক্রেতা পাওয়া যাবে, সেই সাথে এর বাজার মূল্যও অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে।

মিকেলএঞ্জেলো তাঁর সমস্ত প্রতিভা ঢেলে দিলেন ঘুমন্ত কিউপিডের উপর। উদ্দেশ্য একটাই, একে প্রাচীন রূপ দেওয়া। এসিড মেশানো মাটি দিয়ে ঘষে ঘষে প্রাচীন রূপ দিলেন তিনি। তারপর সেটাকে প্রাচীন ভাস্কর্য হিসাবে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য পুঁতে দেওয়া হলো সেই আর্ট ডিলারের বাড়ির আঙিনায়। সেখান থেকে পরে খুঁড়াখুঁড়ি করার লোক দেখানো অভিনয় করে উদ্ধার করা হলো ঘুমন্ত কিউপিডকে। এই খোঁড়াখুঁড়ির অভিনয় লোকজন ভিড় করে দেখলো। দেখার পরে সবাই জানলো উদ্ধার করা হয়েছে প্রাচীন এক রোমান ভাস্কর্যকে, যার সৌন্দর্য অপরিসীম।

এই আর্ট ডিলার তখন কিউপিডকে প্রাচীন হিসাবে প্রচার করে সেটাকে বিক্রি করে দিলেন অন্য এক ডিলার বালডাসার ডেল মিলানিজের কাছে। বালডাসার এরপর এটাকে নিয়ে গেলেন কার্ডিনাল রিয়ারিও নামের একজন শিল্পরসিক ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছে। কিউপিডটাকে হাতে পেয়ে কার্ডিনাল রিয়ারিও নিজের সৌভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। প্রাচীন এই দুর্লভ শিল্পকর্ম বলা চলে অনেকটা হেঁটেই চলে এসেছে তাঁর দ্বারে।এটা দেখিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবেন, এই ভাবনায় এমনই মগ্ন ছিলেন তিনি যে এটার যথার্থতা বিচার করার মতো বুদ্ধি লোপ পেয়ে গিয়েছিল তাঁর। শুরুতেই  যদি তিনি বিশেষজ্ঞ কাউকে দিয়ে যাচাই করে নিতেন, তাহলে হয়তো ঠকতেন না তিনি। কিন্তু, তাঁর লোভ তাঁকে সেই কাজ করতে দেয়নি। কিউপিডটাকে দ্রুত হস্তগত করার জন্য তিনি এর যথার্থতা যাচাইয়ের দিকে গেলেন না। পাছে অন্য কেউ তাঁর আগে এটাকে কিনে ফেলে, এই ভয় থেকে অনেক টাকা দিয়ে কিনে নিলেন তিনি সেটাকে।
শুরুতে তিনি না জানলেও, সত্য গোপন থাকলো না। পরে যখন তিনি জানতে পারলেন যে, তাঁকে বোকা বানানো হয়েছে, প্রচণ্ড রকমের রেগে গেলেন তিনি। এটাই স্বাভাবিক। প্রাচীন বলে এক অখ্যাত তরুণের কাজকে গছিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। তিনি তাঁর প্রদত্ত টাকা ফেরত চেয়ে পাঠালেন বালডাসারার কাছে। বালডাসারা টাকা  ফেরত দিতে বাধ্য হলেন। কিউপিড ফেরত এলো তাঁর কাছে আবার।

কিউপিড প্রতারণার ঘটনা তখন চাউর হয়ে গেছে চারিদিকে। মিকেলএঞ্জেলো তাঁর সুনাম নষ্ট হয়েছে বুঝতে পেরে ভাস্কর্যটি কিনে নেবার প্রস্তাব পাঠালেন বালডাসারাকে। কিন্তু, অজ্ঞাত কোনো কারণে বালডাসারা সেই প্রস্তাবে সাড়া দিলেন না। কড়া ভাষায় উত্তর দিলেন এই বলে যে, তিনি বরং এটিকে নষ্ট  করে দেবেন, তবুও টাকা ফেরত নেবেন না। টাকা ফেরত পাবার সুযোগ আসার পরেও, মিথ্যা একটা শিল্পকর্মকে কেন তিনি নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন, সেটা এক রহস্যই হয়ে রয়েছে। তাহলে কি তিনি অনুমান করেছিলেন যে প্রাচীন রোমান ভাস্কর্য না হলেও, এটা একটা অনন্য সৃষ্টি? এই তরুণ একদিন মেধা এবং দক্ষতায় ছাড়িয়ে যাবেন পৃথিবীর সকল ভাস্করকে? কে  জানে?

এই কিউপিডটা পরবর্তীতে নানা হাত ঘুরে এসে পড়ে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লসের হাতে।খুব সম্ভবত ১৬৯৮ সালে হোয়াইট হল প্রাসাদের আগুন লাগা দুর্ঘটনায় এটি ধ্বংস হয়ে যায়।

জালিয়াতি এবং প্রতারণার এই ঘটনায় মিকেলএঞ্জেলোর সুনাম কিছুটা নষ্ট হয়েছিল, কিন্তু, এতে আবার তার উপকারও হয়ে গিয়েছিল অনেকখানি। এই ঘটনার কারণে ব্যাপক পরিচিতি পেয়ে যান তিনি। নেতিবাচক যদিও, তবুও প্রচারতো।  পরবর্তীতে শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেতে এটা বেশ খানিকটা সাহায্য করেছে তাঁকে। কখনো কখনো শাপও যে বর হয়ে ওঠে, এটা তার জ্বলন্ত এক দৃষ্টান্ত।

আপনার মন্তব্য