হরিণ

 প্রকাশিত: ২০১৭-০৪-১৮ ১১:৫৪:৪০

ছবি: ইন্টারনেট

আফরিন জাহান হাসি:

কিছু মানুষ দৌড়ে আসার ধুপ-ধুপ শব্দে সুস্মিতার অলস ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। বারান্দার সামনে উত্তেজিত মানুষের কথা শোনা যাচ্ছে।

ঈশ, ভোরের এই আলসে ঘুমটা সুস্মিতার বড় প্রিয়! যদিও সূর্য্যি মামা এই পাহাড়ে প্রচণ্ড প্রখর, ভোর হতে না হতেই কড়া সোনা আলোয় ঘর-দোর ভেসে যায় ।তবুও ওর চোখ খুলতে ইচ্ছে হয় না। সবুজ অবশ্য উল্টো, ভোরে উঠেই ব্যায়াম করতে চলে যায়, কদিন সুস্মিতাকেও জোর করেছিল সাথে যেতে। একদিন দৌড়তে যেয়ে পরে ব্যথা পাবার পর, কদিন ধরে আর বলছে না। সুস্মিতা কান খাড়া করলো, ওরা কি বলছে শুনতে।

দু’জন একসাথে কথা বলছে, “স্যার স্যার, একটা হরিণ এসেছে পাহাড়ে, যদি অনুমতি দেন একটা গুলির...!”

সবুজের শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলা শোনা গেলো, “একদম হুড়োহুড়ি করবে না, তোমাদের বসতির দিকে ঘের দিয়ে দাঁড়াবে, এমনভাবে হরিণটাকে তাড়া করবে যেন এটা তার জঙ্গলের দিকেই ফিরে যায়। আর দেখো হরিণটা যেন ভয় না পায়।”

“কিন্তু স্যার, হরিণের মাংস...”

সুস্মিতা উঠে এসে, ওদের কথা কেড়ে নেয়, “দাওনা অনুমতি, হরিণের মাংস কখনো খাইনি।”

সবুজ আরো দৃঢ় স্বরে অর্ডার করে, তাড়াতাড়ি যাও, দেখো হরিণটা যেন ভয় না পায়।” সবুজকে আহত মনে হয়, ও আর কথা না বলে বেরিয়ে যায়।

সুস্মিতা হাত-মুখ ধুয়ে বারান্দায় এসে দেখে একজন দাঁড়িয়ে আছে বলছে, “আপা, হরিণটা জঙ্গলে ঢুকছে আবার বেরোচ্ছে, বাচ্চা হরিণ, মনে হয় মাকে খুঁজে পাচ্ছে না। স্যার বলেছে, আপনাকে দেখাতে নিয়ে যেতে ।”

ও হাঁটা শুরু করে, একেবারে প্রাকৃতিক হরিণ, ওর দেখতে ইচ্ছেও হচ্ছিল।

পাশের লোকটি কথা বলতে বলতে হাঁটছে। কিভাবে, কোথা থেকে হরিণ দেখতে হবে তা বলার পরই সে বললো, “আপনি একটু স্যারকে বোঝান, আপনি ভালো করে বললে স্যার রাজি হয়ে যাবে।”

“না, রাজি হবে না, তখন বোঝেননি, আর বলে লাভ নেই ” সুস্মিতা বলে।

উপরের দিকে ওঠা, হরিণ দেখার উত্তেজনা, সব মিলিয়ে সুস্মিতা হাঁপাচ্ছে আর নিজের হৃৎপিণ্ডের ধুঁক-ধুঁক শব্দ শুনতে পাচ্ছে। এর মাঝেই বুঝতে পারলো ও, পাশের লোকটা কিছু একটা বিড়বিড় করছে। ও আঁচ করতে পারছে সে কি বিড়বিড় করছে। তাদের স্যারের বেশ কিছু কাজের ওরা কোন অর্থ খুঁজে পায় না। এই যেমন হরিণটাকে মারতে দিচ্ছে না ।আবার পিঁপড়া মারার জন্য যে পাউডার, তার মধ্যে নাকি ডিডিটি না কি আছে তাই ঐটা ব্যবহার করতে দেয় না, অথচ পিঁপড়ার যন্ত্রণায় অস্থির হতে হয়। স্যার অন্য যে পদ্ধতি বলে তাতে কি আর অমন কাজ হয়! সবজির বাগানে রাসায়নিক সার দিতে দেয় না, কীটনাশক নিয়েও হাজার কড়াকড়ি। এত যে সাপের উৎপাত, সেই সাপ মারলেও নানা হাঙ্গামা, সাপ নাকি ইচ্ছে করে ছোবল দেয় না। সাপকে অন্যভাবে দূরে রাখতে হবে। স্যারের যে কত পাগলামি!

সুস্মিতা হরিণটাকে দেখতে পাচ্ছে। ইতস্তত, ঘুরে বেড়াচ্ছে। কী সুন্দর রঙ! প্রাকৃতিক রঙগুলো সবসময় এত সুন্দর হয়। ধীরে ধীরে গভীর গাছপালার ভেতর ঢুকে গেলো হরিণটি।ও আরো বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। এর মাঝে হরিণটা নাকি বার কয়েক এসেছে আবার ফিরে গেছে।

পাহাড়ের উপর সূর্য এই সকালেই এত তীব্র, একেবারে মাথায় এসে গরম লাগছে।ও ফিরে আসে।

ঘরে ঢুকেই সবুজকে দেখে ও উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, জানো হরিণটা এত সুন্দর! সবুজ ওর দু’হাত ধরে বসে কথা বলতে শুরু করে, “তোমার হরিণটাকে দেখে ভালো লেগেছে, না খেতে পারার কষ্ট নেইতো আর মনে? দেখ, আমরা ওর জায়গা দখল করে নিয়েছি, প্রতিনিয়ত আরো বেশী করে নিচ্ছি, এই হরিণ শিশুটির মত আরো অনেক বন্য প্রাণীর থাকার জায়গা, খাবার সব কিছুতে আমরা ভাগ বসাচ্ছি। আমাদের বুদ্ধিমত্তা অনেক উন্নত, আমাদের চিন্তা করতে হবে, কিভাবে এদের স্বার্থ রক্ষা করে মিলে মিশে আমরা পৃথিবীতে থাকতে পারি। শুধু যদি নিজেদের টুকুই ভাবি, প্রকৃতির একটুও যত্ন যদি না করি তবে কি প্রকৃতি একদিন শোধ নিবে না!

ভাবোতো, আমরা যদি শুধু ধ্বংসের দিকেই আগাই, তবে আমাদের অনাগত সন্তান, তাদের সন্তান- তাদের জন্য কি পৃথিবী আমরা রেখে যাবো!

গভীর আবেগে আর ভালোবাসায় সবুজ কথা বলে চলছে, সেই কথা শুনতে শুনতে সুস্মিতা কেমন হারিয়ে যায়। চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পায়, সোনালী আলোয় ঝলমলে সবুজ ঘাস, তার মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে একদল হরিণ, তাদের অপরূপ রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে পৃথিবী। একটু দূরেই খেলা করছে কয়েকটি মানব শিশু। তাদের আনন্দ হিল্লোলে আন্দোলিত পৃথিবী।

আপনার মন্তব্য