বাবুই পাখি এবং কাক

 প্রকাশিত: ২০১৭-০৬-২৩ ০১:৫০:৪৪

 আপডেট: ২০১৭-০৬-২৩ ০২:০৯:৪৮

আফরিন জাহান হাসি:

নির্জন শান্ত দুপুর,পাখপাখালির কলকাকলিতে মুখর। কান পাতলে অদূরে বয়ে চলা মাতামুহুরি নদীর স্রোতের শব্দও পাওয়া যায়।

সুস্মিতা ওর ঘরের পেছনের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ছিল, পাখির কিচিরমিচির তীব্র হতেই চোখে পড়লো, এক ঝাঁক বাবুই! আসলে নারকেল গাছে বাবুইয়ের বাসাগুলোই নিশ্চিত করলো যে ওগুলো বাবুই।

সুস্মিতা দৌড়ে ওর ছোট্ট ভিডিও ক্যামেরাটা নিয়ে এলো, ওর একলা দিনের খেলনা! যা-ই ভালো লাগে তা-ই রেকর্ড করতে ইচ্ছে করে, পরে সবাইকে দেখানো যাবে। তাছাড়া জুম করে দূরের জিনিষগুলো আরও স্পষ্ট করে দেখা যায়। প্রথমে দাঁড়িয়ে তারপর দরজার পাটাতনে বসে সুস্মিতা রেকর্ড করেই চলছে...

এমনিতেই এই পাহাড় নির্জন, এখন ছেলেরা সব অফিসে। যারা ঘাস পরিচর্যা করে, আজকে তারাও নেই। এই নির্জন প্রকৃতিতে নিজেকে কেমন অবিচ্ছেদ্য মনে হয় সুস্মিতার। সবুজ গাছগাছালি, পাখির কলতান, নদীর স্রোত, বাতাসের শব্দ আর সুস্মিতা নিজে মিলেমিশে একাকার। যেন এক পরিবার!

বাবুইগুলো কখনো দুটো একসঙ্গে, কখনো একটা একাই খড়কুটো ঠোঁটে ধরে গাছের কাছে আসছে; আবার অন্য একটি তাদের ঠোঁট থেকে সেই খড় তুলে নিয়ে যে বাসার কাজ হচ্ছে সেখান পর্যন্ত যাচ্ছে, বাসার কাজে ব্যস্ত পাখিগুলো সেটা নিয়ে বাসা তৈরিতে লাগছে। সুস্মিতা অবাক হয়ে যায়! দারুণ দলবদ্ধ কাজ। মাঝের একজনকে দলনেতা মনে হয়, সে যেন সব কিছু তদারক করছে। তথ্য আদান-প্রদানেও দলনেতা ছুটোছুটি করছে। প্রত্যেকের কানের কাছে যেয়ে কি যেন বলছে। কাজ এগিয়ে চলছে দ্রুত। কী নিখুঁতভাবে ঘরগুলো পূর্ণতা পাচ্ছে! সুস্মিতা পলক ফেলতে পারে না।

মনোযোগ দিয়ে দেখতে গিয়ে মনে হলো পাখিগুলো যেন দায়িত্ব বদলও করলো। যারা বাসার কাছে ছিল, তারা চলে গেল দূরে খড় যোগাড় করতে, আর যারা এর আগে খড় আনতে গিয়েছিল তারা নিলো বাসার দায়িত্ব। এত ছোট পাখিগুলোরও সাইজে পার্থক্য আছে। সুস্মিতা দেখেই চলছে, কখনো ক্যামেরায় চোখ রেখে, কখনো ক্যামেরা থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে খালি চোখে। কেউ নিয়ম ভঙ্গ করছে বলে মনে হচ্ছে না। দ্রুত তালে ছন্দময় কাকলীতে বাবুই বাসা বুনছে।

হঠাৎ ই ছন্দ ভঙ্গ হলো, পাখিদের মধ্যে অস্থিরতা, দলনেতা যেন চেষ্টা করছে সবাইকে বোঝাতে, একজোট হতে। কাকের কর্কশ শব্দে সুস্মিতার মাঝেও অস্থিরতা দেখা দিল। দুটো বিরাট আকৃতির কাক ছোট্ট বাবুইগুলোকে তাড়া করছে। তেড়ে আসছে বার বার পাখিগুলোর দিকে।

নারকেল গাছটা অনেক উঁচু, সুস্মিতা ভেবে পায় না ওর কি করা উচিত! এর মাঝেই পাখিগুলো একজোট হয়ে যেন প্রতিবাদ করে, যেন কিছু একটা বলতে চাইছে কাক দুটোকে। কিন্তু কাক দুটো তা শুনতে নারাজ, আবারও কা-কা করে তেড়ে আসে তারা, একেবারে যেন ঠুকরে খেয়ে নিবে ছোট্ট বাবুইকে। বাবুইগুলো একটু দূরে সরে যায়। আবার কাছে গিয়ে কিছু যেন বলতে আসে, কাকগুলো মারমুখো।

সুস্মিতার বুকের ধুঁক ধুঁক সে শুনতে পাচ্ছে, হাতটাও কাঁপছে, ক্যামেরা ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। আধা ঘণ্টার উপরে হয়েছে ও বাবুইগুলোকে দেখছিল, একটু ঘাড়টাও ব্যথা করছে। গলা শুকিয়ে আসে, কাকগুলোকে কি করে তাড়ায়! জুম করে ভালো করে দেখতে গিয়েই চোখে পড়ে আরেকটি বাসা! পনেরো বিশটা বাবুইয়ের বাসা ঐ গাছে, কোনোটা সম্পূর্ণ তৈরি, কোনোটা অর্ধেক। কোনোটায় মেরামত চলছে। তবে কি কাকের ঐ বড় বাসাটা নতুন! নাকি বাবুইগুলো নতুন এলো ঐগাছে! এখন কি হবে!

বাংলায় বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ মনে পড়ে সুস্মিতার, তা হলো, “শক্তের ভক্ত নরমের যম”। ওর অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়। এই প্রবাদটি প্রচণ্ড অপছন্দ সুস্মিতার, মনে হয় যেন এই বচন অত্যাচারীকে অনুপ্রাণিত করছে। নরম হলেই যেন কাউকে পেয়ে বসতে হবে। দুর্বল এর তো পাশেও দাঁড়ানো যায়, সাহায্যও তো করা যায়। এটা কি কোনভাবে এই শিক্ষা দেয় যে শক্ত হও! সুস্মিতার কেবলই মনে হয় এই বচন নরমের দুর্বল অবস্থাটা কেই বেশী করে তুলে ধরে। আর তখন অপেক্ষাকৃত শক্ত মানুষ সেই সুযোগটা নেয়! নরমের উপর অত্যাচার চলতেই থাকে।

কেউ কেউ তো ইচ্ছে করেও শক্ত হতে পারে না। শারীরিক পার্থক্য, জীনের গঠন, পরিবেশের প্রভাব! কত কারণেই না মানুষ মৃদুভাষী, নরম আচরণের হয়। তাই বলে কি তাকে পেয়ে বসতে হবে, তার উপর অত্যাচার করতে হবে। কষ্টে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে ওর, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।

কাকগুলো কি এখন একই কাজ করবে, ছোট্ট বাবুইগুলোকে ঠুকরে তাড়িয়ে দেবে ঐ গাছ থেকে। ওদের এত পরিশ্রমের বানানো বাসাগুলোতে থাকতে দেবে না ওদের!

মেঘ করেছে, বাতাসের জোর বেড়েছে হঠাৎ করেই। মনে হয় ঝড় আসবে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে সুস্মিতা তাকিয়ে থাকে। একটা কাক গিয়ে বড় বাসাটার কাছে বসে। কা-কা কিছুটা কমে আসে, বাবুইয়ের কিচিরমিচির একটু স্পষ্ট হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই দ্বিতীয় কাকটা কি যেন কথা বলে বাবুইগুলোর সাথে, তারপর প্রথমটার কাছে গিয়ে বসে। বাবুইগুলো আবার বাসা বানাতে দ্রুত ঠোঁট চালায়। প্রথম কাকটা আবার যেন একটু তেড়ে আসে, বাবুইগুলোও সাথে সাথে একজোট হয়ে একটু এগিয়ে কাকটার কাছাকাছি যায়, কাকটা বসে পড়ে।

বাবুইগুলোর কেউ কেউ তাদের ঘরে ঢুকে পড়ে, কেউ দ্রুত শেষ কাজটুকু সেরে নিতে থাকে। কোন কোন বাসায় দুটো বাবুই একটি আরেকটির বুকে মাথা রাখে। দু-একটি বড় বাসায় সংখ্যা আরও বেশী, দোতলা বাড়ির মত দুটো দরজা, তাই দিয়ে মুখ বাড়িয়ে কথা বলছে দুটি বাবুই। বাসাগুলো প্রচণ্ড বেগে দুলছে, ঝড় শুরু হলো বলে।

সুস্মিতা তখনো ঘরে ঢুকতে পারে না, কাকগুলোকে নজরে রেখে বসে থাকে। ক্যাসেটের ফিতা শেষ, ঝড়ো বাতাস ওর গায়ে এসে লাগে। শঙ্কা নিয়ে সুস্মিতা চেয়ে থাকে তবুও। কাকগুলো ওদের বাসায় ঢুকে পড়ে, সুস্মিতাকেও ঘরে ঢুকে দরজা জানালা বন্ধ করতে হয়। ওর কাছে মনে হয় সেও যেন নারকেল গাছের কোন একটা কুঠরে এসে ঢুকলো!

আপনার মন্তব্য