বাংলাভাষার বানান: যে বিপত্তির বয়স প্রায় দুশো বছর

 প্রকাশিত: ২০১৭-০৬-২৩ ০৩:০৭:৫৫

রবিশঙ্কর মৈত্রী:

ইদ বানান নিয়ে নানান নাবালক কথা ফেসবুকে বেশ জমাট বেঁধেছে। ভালোই লাগছে-- ফেসবুকে আমরা এখন বানান নিয়েও কথা বলি, ভাষা নিয়ে ভাসা ভাসা আলোচনাও করি।

বাংলা একাডেমির উপরে আমাদের নানান অভিযোগ অনুযোগ চাওয়া-পাওয়া, না-পাওয়া নিয়ে অনেক অনেক মন্তব্য আক্ষেপ থাকতেই পারে। সম্প্রতি ইদ বানান নিয়েও বাংলা একাডেমি তুমুল আলোচনায় উঠে এসেছে।

মাথা মুড়ে নুয়ে না দিলে কোনো প্রতিষ্ঠানই সরকারের আনুকূল্য পায় না। নতমস্তক চৈতন্যভক্তরাই তো বাংলা আশ্রমের পুরোধা হতে পারেন-- অতএব আমাদের আক্ষেপ ক্ষোভ প্রতিবাদও প্রায় অর্থহীনই মনে হয়।

বাংলা একাডেমির হাজারটা দোষ থাকলেও কিছু গুণ আছে-- সেই গুণগুলোর কথা আমরা হরহামেশা ভুলেও যাই। বাংলা একাডেমি গত চার দশকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অভিধান প্রকাশ করেছে। বাকি সব প্রকাশনার কথা বাদ দিলেও বাংলা একাডেমি কেবল অভিধান প্রকাশের জন্যই বাংলাভাষাপ্রেমীদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমরা যারা লিখি তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলা একাডেমির কাছেই কিছু চাই, চাইতে পারি।

এই একটু আগেই ফরাসি ভাষার ক্লাস শেষে আলেসের প্রবাসবাড়িতে ফিরে এলাম। ফরাসি ভাষা নিঃসন্দেহে উচ্চমানের ভাষা। কিন্তু ব্যাকরণ না জানলে ফরাসি ভাষা কোনো রকমে একটু আধটু বলতে শিখলেও লিখতে ও পড়তে পারা সম্ভব নয়। ফরাসি ভাষায় প্রচুর ইংরেজি শব্দ আছে। এই ভাষা থেকেও ইংরেজি ভাষায় অনেক অনেক শব্দ অবিকল ঢুকে পড়েছে। একই শব্দ একই অর্থে একই বানানে ইংরেজি এবং ফরাসিতে চালু থাকলেও উচ্চারণ কিন্তু ভিন্ন। যেমন BUS, NATION-- এই দুটি শব্দের ফরাসি উচ্চারণ-- বুস্ এবং ন্যাসিওঁ। আমরা যে শহরকে প্যারিস (PARIS) বলে জানি-- ফরাসিদের উচ্চারণে সে শহরের নাম পারি। ফরাসি ভাষায় শব্দ শেষের এস প্রায়ই অনুচ্চারিত থাকে।

ফরাসি ভাষায় যাঁরা লেখেন তাঁরা কখনো বলেন না--আমারও একটা নিজস্ব বানানরীতি আছে। ফরাসি ভাষার প্রতিটি শব্দের বানান সবখানে সবার জন্য এক, অভিন্ন। এ দেশেও উচ্চারণ ভিন্নতা আছে। উত্তর ফ্রান্সে সকালকে বলা হয় মাতাঁ (Matin), কিন্তু দক্ষিণ ফ্রান্সের লোকেরা একই বানানের ভিন্ন উচ্চারণ করেন-- এঁরা বলেন-- মাতেন। অবশ্য আনুষ্ঠানিক ব্যবহারে সবখানে প্রমিত উচ্চারণ এক-- Matin (মাতাঁ, Bien (বিয়াঁ), Train (থাঁ)।

বাংলাভাষার বানান নিয়ে নানান বিপত্তি চলছে প্রায় দুশো বছর ধরে। আমাদের গদ্যের বয়সও মাত্রই দুশো বছর। ভিনভাষার অতিথিরা বাংলায় এসে অভিধান রচনা করেছেন, ব্যাকরণ লিখেছেন, ছাপাখানা বানিয়েছেন। তখন বিদ্যাসাগরকে না-পেলে এখনো যে আমরা কোন অন্ধকারে ডুবে থাকতাম-- এটা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। বিদ্যাসাগর দয়ারও সাগর। তিনি দয়া করে বাংলাভাষার প্রকাশনায় হাত দিয়েছিলেন বলে আমরা অতিথি বাংলাপ্রেমীদের ভুলভাল থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম।

সৃজনশীল মানুষমাত্রই ভাষাভঙ্গিতে স্বকীয় হবেন-- এটাই সহজ স্বাভাবিক। কিন্তু লেখকের নিজস্ব বানানের অস্তিত্ব তৈরি করা মানে রাষ্ট্রের ভাষাশৃঙ্খলাকেই অস্বীকার করা। ভাষাশৃঙ্খলার অভাবে পৃথিবী থেকে এরই মধ্যে কয়েক হাজার ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

বানান নিয়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস স্যারের সঙ্গে আমার একটু আধটু ঠুকোঠুকি হত বইকি। তাঁর ‘দোজখের ওম’ বইয়ের প্রুফ দেখেছিলাম। দ্যাখা, গ্যালো-- এরকম কয়েকটি বানানকে ঠিক করে লিখে দিয়েছিলাম-- দেখা, গেল। স্যার একটু রাগ করেছিলেন। বলেছিলেন-- দ্যাখা, গ্যালো-- এভাবেই লিখি, উচ্চারণে সুবিধা হয়।

আমি বলেছিলাম-- উচ্চারণে সুবিধার জন্যে তাহলে এই শব্দগুলো এভাবে লিখুন স্যার--খ্যালা, চ্যালা, ঠ্যালা, ফ্যালা, ব্যালা, ভ্যালা, ম্যালা, হ্যালা।

স্যার বলেছিলেন-- সর্বনাশ-- শব্দগুলো দেখতেই এখন কেমন লাগছে?

তখন আরো কথা হয়েছিল-- এ্যামোন, ক্যামোন, ত্যামোন, য্যামোন।

বানান নিয়ে আজকের ভুলটা বাংলা একাডেমির নয়। বাঙালির ভুল এবং অপরাধ সেই গোড়া থেকেই। স্বীকার করতে লজ্জা নেই-- আমরা মাতৃভাষা শিখি না। বাংলা পড়তে বলতে লিখতে শিখি না।

জাতি হিসেবে আমরা এখনো নতদাসভাবাপন্ন। পরের ভাষা শিখি জাতে ওঠার জন্য, নিজেকে শিক্ষিত হিসেবে জাহির করার জন্য, স্বচ্ছলতালাভের জন্য।

একজন ফরাসিকে যখন আমি বলি, দুঃখিত আমি ফরাসি ভাষায় ভালোভাবে কথা বলতে পারি না। তিনিও তখন বলেন, আমিও দুঃখিত। আমি তোমার বাংলাভাষায় কথা বলতে পারি না।

নিজের মাতৃভাষা খুব ভালোভাবে বলতে না পারাটা ফরাসি দেশে অপরাধ বলেই গণ্য হয়-- এমন কথা আমি ফ্রান্সে এসেই প্রথম জেনেছি।

ফ্রান্সে দ্বাদশ শ্রেণি অব্দি অভিবাসীসহ সকল ছাত্রছাত্রীকে ফরাসি ভাষা শিখতে হয়। ফ্রান্সের শিক্ষানীতি সবার জন্য এক এবং অভিন্ন। এদেশে দ্বাদশ শ্রেণিতে ফরাসি ভাষার চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না-হওয়া মানেই অর্ধশিক্ষিত থেকে যাওয়া।

বাংলা ব্যাকরণ জানা না থাকলে বানান এবং উচ্চারণ ভুল হবেই। কেউ কেউ মনে করছেন, বাংলা একাডেমি এখন বানানের নতুন নিয়ম তৈরি করছে। আমরা হয়তো কেউ কেউ ভুলে গেছি, অথবা জানি না-- ১৯৩৫ সালে সংস্কার করা বানানই নতুন করে চালু করছে বাংলা একাডেমি।

বিদেশি শব্দের বানানে দীর্ঘ-ঈ, দীর্ঘ-ঊ, মূর্ধন্য-ণ, মূর্ধন্য-ষ ব্যবহৃত হবে না। যেমন-- ইদ, স্ট্রিট, ইশারা, উজির, আয়রন, স্টেডিয়াম, স্টেশন।

তৎসম থেকে তদ্ভব হয়ে গেলেও শব্দের বানানে ওই একই নিয়ম। যেমন-- পাখি (পক্ষী), বাড়ি (বাটী), শাশুড়ি (শ্বশ্রুটীকা), পরান (প্রাণ)।

দীর্ঘ ঈ-এর পরিবর্তে হ্রস্ব-ই দিয়ে ইদ লিখলে প্রথম প্রথম চোখে একটু লাগে বইকি। দু-একবছর পর ইদ বানানও চোখসওয়া হয়ে যাবে।

আলেস শহরেও আমার বেশিরভাগ বন্ধু মুসলমান। তাঁরা মূলত আলজেরিয়া আর মারক্কো থেকে ফ্রান্সে এসেছেন। আমি যখন ওঁদেরকে প্রসঙ্গক্রমে রোযা রমযান ইত্যাতি শব্দগুলো বলি, তাঁরা তখন কিছু বোঝেন না। যখন জিহ্বা ভেতরের দিকে ঠেলে দিয়ে বাতাস আটকে বলার চেষ্টা করি-- রামাদান, ইদউল ফিতর, ইনশা্আল্লাহ্ ---তখন তাঁরা আমার শব্দগুলো একটু একটু বুঝতে পারেন। তার মানে বাংলাদেশে প্রচলিত আরবি ফারসি শব্দগুলো বাংলার আদলেই উচ্চারিত হয়। যেমন আমাদের ইংরেজি একসেন্টেও বাংলার তীব্র কদমঘ্রাণই থাকে।

শব্দের উচ্চারণ যেমন তেমন--বানান এক না হলে চরম বিপত্তি হয়। ইন্টারনেটের জগতে আমাদের অনেক কাজ এখনো বাকি। আমরা এখনো বাংলা বানানের একটি রীতি না মেনে চললে নানান জটিলতা বাড়তেই থাকবে। এমনকি ফ্যামিলি নামের নানান বানান লেখার কারণে বিদেশে কতোজনকে কতো ভোগান্তি এবং অবিশ্বাসের মধ্যে পড়তে হয় তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। ফরাসি থেকে হিন্দি উর্দুতে প্রায় ঠিকঠাক অনুবাদ করে দেয় গুগল। কিন্তু ফরাসি ও ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করতে গেলেই গুগল পাগল হয়ে যায়। কারণ আমরাই যে অসুস্থ। ভুর ব্যালা চুর দ্যাখেন ঠিক আছে-- আঞ্চলিক উচ্চারণে ওটাই সঠিক। শুনতেও বেশ ভালো লাগে। কিন্তু গুগলেও যদি ওগুলো ঢুকে যায় তাহলে বাংলাভাষার উনচল্লিশ রকম গন্ধ নিয়ে-- ওই গুগল তো পাগল হতে বাধ্য।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, পরিচালকরা বানানরীতি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন না। একাডেমির হয়ে বিদগ্ধ বিজ্ঞজনেরাই ভাষার রীতিনীতি নিয়ে কাজ করেন। যাঁরা ভাষা নিয়ে কাজ করেন-- তাঁদের নিষ্ঠার ও শ্রমের সঙ্গে আমাদের পরিচয় থাকলে অভিধান নিয়ে আমরা কোনো অশোভন কথা বলতে পারতাম না।

লেখককে ভাষাবিদ হতে হয় না, কিন্তু ভাষার রীতি মানতেই হয়। লেখক ভাষা ‍সৃষ্টি করেন। ভাষায় নতুন প্রাণ দান করেন। কিন্তু ভাষার ব্যাকরণ ও বানান সংস্কার নিয়ে কাজ করেন ভাষাপণ্ডিতরা।

কৃষককে কৃষিবিজ্ঞানী হতে হয় না। কিন্তু মাটির গুণাগুণ রীতিনীতি কৃষককে মেনে নিয়েই ফুল ফল ফসল ফলাতে হয়। আমরা নিশ্চয়ই জানি-- একই মাটি একই বীজ-- কিন্তু সকলের হাতে একই নন্দনে ফুলের সৃজন হয় না।

বানান নিয়ে নানান অনর্থক কথা বলে নিজের লেখা নষ্ট করার কী দরকার? দুশো বছর আগে আমাদের স্কুল কলেজ ছিল না। একাডেমি তো সেদিন মাত্র হল। টোল আর মাদ্রাসার এই আমরা বিদেশ থেকে অনেককিছুই ধার করেছি, তাই-- আমাদের গ্রন্থাগারের নাম লাইব্রেরি, আমাদের বাংলাভাষা চর্চা গবেষণা ও প্রকাশনা কেন্দ্রের নাম-- বাংলা একাডেমি।

আপনার মন্তব্য