অপেক্ষার প্রহর

 প্রকাশিত: ২০১৭-০৮-১৬ ০১:৪৭:২৯

মিজানুর রহমান:

মেসেজ-এর স্ক্রিনে ‘সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছি’ টপটপ করে টাইপ করার সময় আবিরকে গ্রেপ্তার করে কালো জিপে বসানো হলো।

- কি নাম আপনার?

আবির মৃদু হেসে বললো, অফিসার, ‘তুই’ সম্বোধন করে প্রশ্ন করা শুরু করেন? পুলিশরা খুব সহজে তুই-তে চলে যায়। ফর্মালিটির দরকার নেই। আমি আপনার ভবিষ্যৎ প্রমোশনের গুরুত্বপূর্ণ আসামী। আমার সময় কম।

পুলিশ অফিসার বেশ নড়েচড়ে আবিরের আরও কাছে গিয়ে বললেন, সময় কম আর ভবিষ্যৎ প্রমোশন এগুলোর মানে কি?

আবির উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো।

পুলিশ অফিসার রেগে বললেন, ‘তুই হাসি বন্ধ কর, নইলে ফায়ার করে দিবো। শালা, নর্দমার কিট, তুই আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবি না।’

পুলিশ অফিসার রাগে কাঁপছেন। গাল বেয়ে ঘাম পড়ছে। আবির আবার হাসছে, বড় গলায় হাসছে।

অফিসারের রাগ বাড়তেই লাগলো। আবিরকে পুনরায় ধমক দিবেন ঠিক তখনই অফিসারের মোবাইলে ফোন আসছে। আবির হাসি থামিয়ে বললো, ‘অফিসার, ফোন ধরেন। আপনার স্ত্রী ফোন করছেন।’

- আমার স্ত্রীর ফোন করছে এটা তুই কিভাবে বুঝলে?

আবির আবার হাসে। অফিসার, মোবাইল রিংটোনে কিশোর কুমারের গান দেয়া থাকলে কে-না বুঝে এই রিংটোন স্ত্রীর পছন্দের দেয়া! সদ্য বিবাহিত মেয়েরা স্বামীর মোবাইলের রিংটোনে এরকম গানই দেয়। আচ্ছা অফিসার, আপনার নাম মোজাম্মেল হক।

ঠিক বললাম না?

মোজাম্মেল হক নেমপ্লেটের দিকে তাকালেন। বুকের উপর নেমপ্লেট নেই! প্যান্টের দুই পকেট চেক করে আবার নড়েচড়ে বসলেন।

আবির এবার মোজাম্মেল হকের দিকে ঝুঁকে গিয়ে বললো, অফিসার, জিপের ডানপাশের গ্লাসে তাকান। মোবাইলের প্রতিচ্ছবি দেখতে পারছেন?

- হ্যাঁ, দেখতে পারছি। কিন্তু কেন?

আবির মৃদু হেসে বললো, আমার একটা অনুরোধ রাখবেন? আমি আপনাকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করবো।

- কি অনুরোধ?

- হাতকড়া খুলে দেবেন? আপনার মোবাইল দিয়ে আমার দলের লিডারকে একটি মেসেজ পাঠানো দরকার।

মোজাম্মেল হক আরও অবাক হলেন। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, তোদের দলনেতা কে? আমাকে তথ্য দে, আমি তোকে মোবাইল দিবো।

আবির মৃদু হেসে বললো, মেসেজ যখন পাঠাবো, সেন্ডবক্সে দলের লিডারের নম্বর এমনিতে পাবেন। তথ্য প্রযুক্তি যুগে এই ক্লুটা জঙ্গি নিরোধে আপনাকে অনেক সহযোগিতা করবে। আমার সময় কম। দয়া করে সময় নষ্ট করবেন না।

মোজাম্মেল হক আবিরের দিকে মোবাইল দিয়ে বললেন, সময় কম এর মানে কি?

আবির হাসছে। মোজাম্মেল হক আবিরের দিকে রহস্যঘেরা চোখে তাকাচ্ছেন। আবির টপটপ করে মোবাইলে মেসেজ টাইপ করছে। মোজাম্মেল হকের বুকে ধুকধুক করে শব্দ হচ্ছে। আতঙ্ক ক্রমশ বাড়তে লাগলো। সময় কম- এর অর্থটা কি, মোজাম্মেল হক ভাবতে লাগলেন। জানালার ফাঁক দিকে হিমেল বাতাস জিপের ভেতরে প্রবেশ করছে। মোজাম্মেল হক জিপের সামনের দিকে তাকাচ্ছেন। চারদিকে নিরবতা নেমে আসতেছে। রাতের আবছা অন্ধকারে আকাশে চাঁদ উঠেছে। জিপের সাথে চাঁদটাও সামনের দিকে এগোচ্ছে।

মোজাম্মেল হক এর চোখে আতঙ্ক আর ক্লান্তির ঘুম ভর করেছে। তন্দ্রাভাব হচ্ছে এমন সময় বিকট শব্দ শুনে মোজাম্মেল হক আঁতকে উঠলেন। পাশে আবির নেই, সিটে মোবাইল পড়ে আছে।

মোবাইল হাতে নিয়ে দ্রুত নেমে দেখলেন ১০-১৫ হাত পেছনে আবির রাস্তায় পড়ে আছে। জিপ থেকে লাফ দেয়ার সময় পেছন থেকে আরেকটি চলন্ত গাড়ি শরীরের উপর দিয়ে চলে যায়। মোজাম্মেল হক মোবাইলের স্ক্রিনে তাকালেন। মেসেজে ড্রাফট লেখা- “মোজাম্মেল সাহেব, আমি জঙ্গি নই, বিশ্বাস না হলে আপনার স্ত্রী হুমায়রাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।”

তড়িঘড়ি করে মিডিয়া, হাসপাতাল, হেডকোয়াটার সব জরুরী বিভাগে ফোন করা হচ্ছে। প্রাক তদন্তের জন্য আবিরের ছিটকে পড়া মোবাইল অন করা হলো। সাথে সাথে একটি মেসেজ স্ক্রিনে ভেসে উঠলো-

“আবির তোমার মোবাইল বন্ধ কেন? অনেকবার ট্রাই করছি। প্লিজ আবির, পাগলামি করো না। নিয়তি আমাদের দূরে টেলে দিয়েছে বলে তুমি এরকম করছো কেন? ক্যান্সারের রোগী হিসেবে তোমার বিশ্রাম নেয়া উচিত। তুমি মুজুর কাছ থেকে ফিরে যাও, প্লিজ। আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি আবির।”

মেসেজ দেখে মোজাম্মেল হক হন্য হয়ে আবিরের সেন্টবক্স দেখেন। সেন্টবক্সে মাত্র একটি মেসেজ যা হুমায়রাকে পাঠানো হয়েছে শেষ বিকেলে। সেখানে লেখা- “হুমায়রা, ডিগ্রিধারীকে নিয়ে খুব সুখেই আছো। আমি এখন তোমার হবু স্বামীর সাথে। দেখ, একটু পর সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছি।”

মোজাম্মেল হকের মোবাইলে কল আসছে। কল ধরতেই ওপাশ থেকে হুমায়রা ভীত স্বরে বলতে লাগলো, মুজু, কেউ এভাবে বাসায় নেমপ্লেট ফেলে যায় নাকি? নেমপ্লেট ফেলে যাওয়া বিপদের লক্ষণ। তোমার কিছু হলে আমার কি হবে, মুজু?'

ফোন কেটে দিয়ে মোজাম্মেল হক রাস্তায় দাঁড়িয়ে মিডিয়া কর্মী, অ্যাম্বুলেন্স আর ফোর্সের অপেক্ষা করছেন। আবিরের দেহ লাশের মত রাস্তায় পড়ে আছে। গলার অংশ নড়ছে। হুমায়রা বারবার ফোন করছে অথচ মোজাম্মেল হকের মোবাইল থেকে কল রিসিভ হচ্ছে না। রিংটোনে কিশোর কুমারের গান বাজছে- ‘চিরদিনই তুমি যে আমার, যুগে যুগে আমি তোমারই ......... সঙ্গী, সঙ্গী, আমার অমর সঙ্গী।’

আবিরের চোখ আকাশের দিকে, মোজাম্মেল হকের চোখ শব্দ করা অ্যাম্বুলেন্সের দিকে আর হুমায়রার চোখ মোবাইলের স্ক্রিনে শেষ কর্মঘন্টার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।

ধলপ্রহর বোধ আর নির্বোধের অপেক্ষা করছে।

আপনার মন্তব্য