নজরুল ও নার্গিসের প্রেম!

সোলায়মান সুমন

 প্রকাশিত: ২০১৫-০৫-২৫ ০০:০৭:০০

 আপডেট: ২০১৫-০৫-২৫ ০০:১১:৪০

দ্রোহ, প্রেম, সাম্য, মানবতা ও শোষিত বঞ্চিত মানুষের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ১১৬তম জন্মবার্ষিকী সোমবার। :

নজরুল গবেষকেরা নজরুল-নার্গিসের (নার্গিসের আসল নাম সৈয়দা খানম) ঘটনাটিকে নজরুলের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা করে থকেন। সবাই প্রকাশক আলী আকবর খানকে ভিলেন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান। কিন্তু সে বিষয়ে সবাই সঠিক যুক্তি দেখাতে ব্যর্থ হন। গবেষকরা কারণ হিসেবে বলেন, মানসিক চাপ, বন্ধনহীন নজরুলকে বেঁধে ফেলার চেষ্টা, কুমিল্লা থেকে কলকাতা বন্ধুদের সাথে যোগাযোগে আলী আকবর খানের অনুৎসাহীত করা, তাকে ঘরজামাই হতে বাধ্য করবে এমন আশঙ্কা করা ইতাদি।

নজরুলই কিন্তু নার্গিসের রূপে মুগ্ধ হয়েছিল। নজরুলই কিন্তু নার্গিসের মামা আলী আকবরের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। যদিও নজরুলের ছন্নছাড়া জীবনের সাথে নার্গিসকে জড়িয়ে ফেলতে পরিবারের অনেকে সম্মত ছিল না। নার্গিস বিত্তবান খাঁ পরিবারের আদরের কন্যা। কিন্তু নজরুলের প্রতিভার কদর তারা করেছিল। নার্গিসও নজরুলের বাঁশির সুরে মুগ্ধ হয়ে মন দিয়েছিল। 

এতদিন কুমিল্লার দৌলতপুরে থাকার পর নজরুল যখন নার্গিসের তথাকথিত মোহ থেকে মুক্ত হল তখনই কেন বিয়ে থেকে সরে আসল না? ঘটা করে আমন্ত্রণপত্র তৈরি করা, তাতে আবার নিজের পরিচয় তিনি লিখেন: মুসলমানদের রবীন্দ্রনাথ কাজি নজরুল ইসলাম। সেই আমন্ত্রণপত্র কলকাতা বেশ কটি পত্রিকায় ছাপতে দেন। এত কিছুর পর বিয়ের পর রাতে পালিয়ে আসাটা কোনো ভাবেই মেনে নেয়া যায় না। 

নজরুল কলকাতায় ফিরে মামা আলি আকবরকে চিঠি লেখেন-

বাবা শশুর, 
আপনাদের এই অসুর জামাই পশুর মত ব্যবহার করে এসে যা কিছু কসুর করেছে, তা ক্ষমা করো সকলে, অবশ্য যদি আমার ক্ষমা চাওয়ার অধিকার থাকে। এইটুকু মনে রাখবেন, আমার অন্তর-দেবতা নেহায়েৎ অসহ্য না হয়ে পড়লে আমি কখনো কাউকে ব্যথা দিই না। যদিও ঘা খেয়ে খেয়ে আমার হৃদয়টাতে ‘ঘাটা বুজে’ গেছে, তবুও সেটার অন্তরতম প্রদেশটা এখনো শিরীষ ফুলের পরাগের মতই কোমল আছে। সেখানে খোঁচা লাগলে আর আমি থাকতে পারিনে। তা-ছাড়া আমিও আপনাদের পাঁচজনের মতই মানুষ, আমার গন্ডারের চামড়া নয়; কেবল সহ্য গুনটা একটু বেশি। আমার মান-অপমান সম্বন্ধে কান্ডজ্ঞান ছিল না বা ‘কেয়ার’ করিনি বলে আমি কখনো এত বড় অপমান সহ্য করিনি যাতে আমার ‘ম্যানলিনেসে’ বা পৌরুষে গিয়ে বাজে- যাতে আমায় কেউ কাপুরুষ, হীন ভাবতে পারে। আমি সাধ করে পথের ভিখারী সেজেছি বলে লোকের পদাঘাত সইবার মতন ‘ক্ষুদ্র আত্মা’ অমানুষ হয়ে যাইনি। আপন জনের কাছ থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত এই হীন ঘৃণা, অবহেলা আমার বুক ভেঙ্গে দিয়েছে বাবা! আমি মানুষের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। দোয়া করবেন আমার এ ভুল যেন দু’দিনেই ভেঙে যায়- এ অভিমান যেন চোখের জলে ভেসেযায়! 

বাকী উৎসবের জন্য যত শীগগীর পারি বন্দোবস্ত করবো। বাড়ির সকলকে দস্তুরমত সালাম দোয়া জানাবে। অন্যান্য যাদের কথা রাখতে পারি নি তাদের ক্ষমা করতে বলবেন। তাকেও ক্ষমা করতে বলবেন, যদি এই ক্ষমা চাওয়া ধৃষ্টতা না হয়। 

আরজ-ইতি 
চিরসত্য স্নেহ-সিক্ত 
নূরু। 

১৯২১ থেকে ১৯৩৭, ১৬ বছর নার্গিস নজরেুলের জন্য অপেক্ষা করেছিল। ১৯৩৭ সালে নার্গিস নজরুলকে একটি চিঠি লিখেন। সেটি নজরুল নিজে না পড়ে শৈলজানন্দকে পড়ে শোনাতে বলে। নার্গিসের চিঠি কথা নজরুলকে আবেগাক্রান্ত করে ফেলে। তিনি উত্তরে একটি গান লিখেন,

যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই 
কেন মনে রাখ তারে 
ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে।

আমি গান গাহি আপনার দুখে, 
তুমি কেন আসি দাড়াও সুমুখে, 
আলেয়ার মত ডাকিও না আর 
নিশীথ অন্ধকারে।

দয়া কর, মোরে দয়া কর, আর 
আমারে লইয়া খেল না নিঠুর খেলা; 
শত কাঁদিলেও ফিরিবে না সেই 
শুভ লগনের বেলা।

আমি ফিরি পথে, তাহে কর ক্ষতি, 
তব চোখে কেন সজল মিনতি, 
আমি কি ভুলেও কোন দিন এসে দাঁড়িয়েছি তব দ্বারে। 
ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে।

এ ঘটনার বছর খানেক পর শিলাইদহে নজরুল ও নার্গিসের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিক বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর কবি আজিজুল হাকিমের সাথে নার্গিসের বিবাহ হয়। নার্গিসের জীবন থেকে নজরুল নামের অভিশাপ কোনো দিনই মুছে যায়নি।

শেষ পর্যন্ত বলতে হয় কবিদের ব্যক্তিজীবন অহেতুক ঘাটতে নেই!

আপনার মন্তব্য