নৃপেন্দ্রলাল দাশের কবিতায় ঐতিহ্যচেতনা

 প্রকাশিত: ২০১৭-১১-০৬ ০১:২৪:৫১

আবুল ফতেহ ফাত্তাহ:

কাব্যের হীরকদ্যুতি তাঁকে দিয়েছে শিল্পবীক্ষণের সক্ষমতা, প্রতীতি ও প্রস্থান। নিবিড় একাকিত্ব আর সবুজ নিসর্গে সহাবস্থান তাঁর অন্তর জুড়ে বিরাজিত। বলা যায় রৌদ্র আর আলো-আঁধারের মিথস্ক্রিয়ায় একটি মন বিবাগীকণ্ঠে গুমড়ে মরছে। কিন্তু একী বিরহতাপ না হতোদ্যম ছায়ার সংরাগ বলা মুশকিল। তবে ব্যক্তিগত কথাভাষ্যে চিরদিনই তিনি প্রণোচ্ছল সজ্জন। অতিরেখ ভালোবাসা আর বর্ণিল উচ্ছ্বাস আবেগ-ব্যারোমিটারের উচ্চগ্রাম স্পর্শ করে তাঁর কথনে, আচরণে। যথার্থই তিনি কবিস্বভাবের পূর্ণ পরিচয় দানে সমর্থ। তিনি নৃপেন্দ্রলাল দাশ (১৯৪৯)। বাংলা কবিতার নিভৃত ছায়ার দূরগামী পথিক। যাঁর অন্তরে সবুজের মায়াজাল আর দুচোখ জুড়ে বিস্ময়-বিপন্ন জীবনের স্থির চিত্র। আবার একটুখানি পারমার্থিক আনন্দ তাঁর অবচেতন মনে খেলা করে, কুলুকুলু ধ্বনিতরঙ্গে।

মিথ, পুরাণ ও মানবিকতাভাষ্যে তাঁর কাব্যে উঠে এসেছে শরীর-মন-নিসর্গের প্রাণসবুজ ঘ্রাণমথিত কথকতা। দেশচেতনার রুপালি খেয়ায় তাঁর কবিতার উপমা-রূপক-উৎপ্রেক্ষা, শব্দ-ধ্বনি পরিক্রমণ করে শ্রীমঙ্গলের সবুজ সায়রে। বনহংসীর গ্রীবারেখা স্পর্শ করে তাঁর কাব্যখেয়ার বিচরণমুখ বেত্রবতী, মনু, খোয়াই, হাকালুকি, ঘুঙ্গিয়াজুড়ি নদী-হাওর আর মনপাহাড়। ইতিহাসের নেপথ্যছায়া খেলা করে তাঁর সৃজনে মননে। আপাতদৃষ্টিতে শ্রীমঙ্গল তাঁর সাধনকেন্দ্র হলেও চিন্তাস্রোতে, লেখনীসঞ্চালনে, বিচিত্রমুখী ভাবপ্রক্ষেপণে তাঁর অবস্থান, দেশব্যাপী সারস্বতমহলে পরিব্যাপ্ত। ধ্র“পদী কাব্য-আঙ্গিক তাঁর মননসঞ্জাত। মিথ-পুরাণ-লোকজীবন তাঁর কাব্য-উপাদান আর বাচনিক কাব্যভাষার উৎস সৃজনশীল মনোব্যাকরণ। দুঃখবোধ, অতৃপ্তি, বিরহকাতরতা, সারল্য, জ্ঞানতৃষ্ণা প্রভৃতি আকুতি তাঁর ব্যক্তিগত অভিধানের প্রিয় শব্দবন্ধÑপ্রিয়প্রসঙ্গ। আবার সৃষ্টিশৈলীর প্রতি মমত্ববোধ থাকা সত্ত্বেও এক ধরনের শৈথিল্য আবেগের কারণে নিরীক্ষা- প্রয়াস সর্বতোভাবে সমর্থন লাভ করেনি। কিন্তু এটাও সত্য যে গদ্যশৈলীর ক্ষেত্রে তিনি যে নিজস্ব পথে পরিক্রমণ করে চলেছেন সেটাও পাঠকের কাছে নিরীক্ষা স্তর বইকি। কবি নৃপেন্দ্রলাল দাশ হয়ত দ্বিমতও পোষণ করতে পারেন। একজন পাঠক হিসেবে তাঁর কাব্যপাঠের রসাস্বাদন করতে যেয়ে এ ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। বিষয়টি অন্য কবিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে।

সবকিছু ছাপিয়ে তাঁর স্বভাব-চৈতন্যে যে বৈশিষ্ট্য পাঠকমনের দৃষ্টি আকর্ষণে-সক্ষম সেটা সারল্য। অকপট উচ্চারণে নিজের অক্ষমতা আর অসহায়ত্ব কবিতার শব্দ-পঙ্ক্তি ও উপমায় তিনি তুলে ধরেন। নাগরিক কৃত্রিমরসের কূটাভাসে তাঁর কবিতা আকীর্ণ নয়। বলা যায়, তিনি যা ভাবেন এর সমস্তই উঠে আসে তাঁর ভাষ্যে। পাঠকের অধিগম্যতা সম্পর্কে যে কবি বেশি বেশি সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন সে কবির কাব্যদেউল নিঃসন্দেহে কালিক সীমা অতিক্রম করে। নৃপেন্দ্রলালের কবিতা সে অর্থে প্রগতির সোপান বেয়ে মানুষের মনের সমীপবর্তী।

ইতিহাসের নির্মম সত্যের অজানা আখ্যান, অনুভূতির কানে শোনা ও অন্তর্দৃষ্টির রূপকল্প উপমহাদেশে ইংরেজদের দুঃশাসন-চাতুর্য, পাকিস্তানি হায়েনাদের শোষণ-নিপীড়ন ও গণহত্যা নৃপেন্দ্রলাল দাশের কাব্য-প্রতিমাকে বহুমাত্রিকতা দিয়েছে। সৃজনরসের ধারায় কখনও তিনি ইতিহাসের নায়ক, কখনও খলনায়ক, কখনও-বা অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা আবার কখনও সংবেদনশীল বিশ্বকবিতার চারাগাছ বপনের একজন নিপুণ কারিগর। কখনও-বা রুবাই পঙ্ক্তির প্রেমরসে সিক্ত কবি ওমর খৈয়াম। যাঁর অন্তরে শুধু রুবাই। রক্তমাংসে রুবাই! এ-প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক তাঁর কবিতা থেকে।

আমি মুক্তিযোদ্ধা নই, কামরুলের শাপলার
কারিগর নই, জাতীয় পতাকার লালবৃত্তে
রক্ত আমি ঢালিনি কখনো। হয়ত যাইনি
যুদ্ধে আমি। এস-এল-আর দেখিনি কখনও
কেবল আমার রক্তে ফুটে থাকে নির্বিরোধী
একগুচ্ছ রক্তিম রুবাই
একটি চরিত্রÑ একজন খৈয়াম।
                       [রক্ত আমার রুবাই : নির্বাচিত কবিতা, পৃ. ৭৫]

হৃদয়ের রক্তক্ষরণে কবি লিখে যান মুক্তিযুদ্ধের গান, অমর কবিতা। আবার অভিমানের চূড়ায় বসে আপাতবিরোধ মনোভঙ্গিতে সব সৌর্য-বীর্যের প্রতি তাঁর এক ধরনের নিরাসক্ত ভাব পাঠককে অবাক করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সৃজনশীল শুদ্ধরসের কবি খৈয়াম হতে তাঁর কোনও আপত্তি নেই। বরং আগ্রহের মাত্রা একটু বেশি :

আমার ভেতরে কোনও নাদিরশাহ নেই, কোনও
বীরোত্তম নেই, যুদ্ধটুদ্ধ নেই। আছে এক তাঁবুর নির্মাতা
শুদ্ধ খৈয়াম।
         [পূর্বোক্ত : পৃ. ৭৫]

শিল্পরসের অপার্থিব ছোঁয়া তাঁর কবিতাকে দিয়েছে অনিন্দ্য প্রণোদনা। নারীর সৌন্দর্যকলার সঙ্গে কবিমনের শিল্পিত চিত্রকল্প পাঠককে মুগ্ধ করে বিচিত্র ভাবনায়। নৃপেন্দ্রলালের বৈশালী এমনি এক বিচিত্র ভঙ্গিমার নারীচিত্র। যার সৌন্দর্য-বিভায় কবিমন লোক থেকে লোকাতীত সৌন্দর্য-সন্দর্শনে মুগ্ধ-বাকরুদ্ধ। শিল্পের জারকরস আর তুলিস্পর্শে জেগে ওঠে তাঁর প্রিয়মুখ, চারুশীলা-বৈশালী। অনিন্দ্যসুন্দর রূপমাধুর্যে যে নারী কবির অপার মুগ্ধতার বয়ান হয়ে ধরা দেয় পাঠক অন্তরে। আমরা অবাক হয়ে শুনি সে-কথন অথবা অবলোকন করি সে-সৌন্দর্যের বিভারেখা-

আমি দেখি তোমার কটাক্ষে নাচে
চৌদ্দশ ভুবন। মিছিল। ফেস্টুন। ঘরবাড়ি।
আমি দেখি, তোমার কনিষ্ঠার কাছেÑ
একটি বিকেল ভীষণ কাতর।
আমি দেখি, তোমার অনামিকা
অর্কিডের মতো ছুঁড়ে দিচ্ছে অলীক পাথর
আমি দেখি, তর্জনী তোমার সশস্ত্র
যোদ্ধার মতো হটাচ্ছে রাত্রিকে।
আমি দেখি, মধ্যমাটা শুয়ে আছে
অন্ধ-তিরন্দাজ।
               [বৈশালীর জন্য স্বাগত ভাষণ : পূর্বোক্ত পৃ. ৬৫]

এই যে বোধ, সৌন্দর্যবিস্তার আর চেতনাসঞ্চারী মনোভঙ্গি এটা কি শুধু শরীরী বিচিন্তা? নাকি চিরায়ত সৌন্দর্যের সাবলীল প্রকাশ? মুগ্ধ পাঠকই এর মীমাংসাসূত্র আবিষ্কারে উন্মুখ হবেনÑ কবিভাষ্যে যেন সে অদৃশ্য ইঙ্গিত আমরা অনুভব করি।

বাংলাদেশের অপার সৌন্দর্যে বহতা নদীর অফুরান ঢেউ আমাদের আন্দোলিত করে। নদীতীরে গড়ে ওঠা হাট-গঞ্জ-শহর ও নগর সভ্যতার প্রতীক, শিল্প ও সংস্কৃতি বিকাশের কেন্দ্র এবং জীবনমান উন্নয়নের পোতাশ্রয়। মিশরের নীলনদ, চীনের হুয়াংশু, পাঞ্জাবের সিন্ধু, ভারতের গঙ্গা-যমুনা, বাংলাদেশের পদ্মা-মেঘনা-মনু-খোয়াই, সুরমা-কুশিয়ারা সভ্যতার ফল্গুধারাÑ লক্ষ প্রাণের শিহরন! নৃপেন্দ্রলাল মনুতীরবর্তী মৌলভীবাজার শহর-জনপদে ১৯৮৪ সালের জলোচ্ছ্বাস আক্রান্ত জনজীবনের নিদারুণ চিত্র কাহিনিকাব্যে চিত্রিত করেন। কবির হৃদয়ার্তি, বেদনাবোধ, অসহায় মানুষের আহাজারি আমাদের আহত করে। বালিকান্দির কৃষকের আর্তনাদ, তলিয়ে যাওয়া শাহ মোস্তফা মাজার, ডুবে যাওয়া কালীবাড়ি, ঝড়ে যাওয়া মাটির প্রতিমা, মঞ্জুবাবুর আসন, পলায়নপর কালীবাবুরা, ভীরু খরগোশের কাতরতা নিয়ে কবি শাহজাহান হাফিজ আবার জনৈক কর্তাব্যক্তির বোটে চড়ে সঙ্গিনীসহ চমৎকার বন্যাশোভা দর্শন। বিপরীত দৃশ্যে রীতা নন্দীর ভুলে যাওয়া গীতবিতানের বাণী, বদরুল হক শাস্ত্রীর মানবিক বোধ, ‘নমিতা কোথায় আছে’ চলে মধ্যযামে কেঁদে ওঠা নারী, সজলের লাশ, মৃত শিক্ষকের দাফনযোগ্য মাটির উদ্দেশ, অপূর্ব বাবু, জাফর মানে সৈয়দ আবু জাফরের কাছে সমস্যা-উত্তরণের কোনও কৌশল আছে কিনা জিজ্ঞাসা! আবার প্রকৃতিরঞ্জন, রহিমউল্লাহ, অসিত, ভূষণজিত, আকমল হোসেন নিপু, সিকান্দর আলী, মোহিবুল আমীন, অধ্যাপক বিমল ঘোষ, এবাদুর রহমান, কিশোরীপদ, শ্যামল প্রমুখের নামোচ্চারণে জলের পাহাড়ে তলিয়ে যাওয়া মানুষের আর্তচিৎকারে পাঠক হতবাক হন। বিস্ফারিত দৃষ্টি নিয়ে অবলোকন করেন মনু নদীর দানবিক আক্রোশ! কবিতা থেকে দু-চারটি স্তবক উদ্ধার করছি :

    ক.    জ্বলে যাচ্ছে বাড়িঘর, জলের আগুন হালাকু
        খানের মতো খান খান করে দিচ্ছে সব
        সভ্যতাকে ঠুকরে খাচ্ছে হিংস্র আদিমতা
                             [জলবন্দি মানুষ : পূর্বোক্ত পৃ. ৫৮]

    খ.    ভীরু খরগোসের কাতরতা নিয়ে বুকে কবি শাহজাহান
        হাফিজ এসে ভেজা কণ্ঠে বলেছেন : আমার পায়ের
        নিচে মাটি কই? কই আমার বিশ্বাসের ভূমি?
        মাটি অবিশ্বাসী নয়? তবু কেন ডুবে যাচ্ছে
        আমার বিশ্বাসে ভরা মৌলভীবাজার।
                                        [পূর্বোক্ত : পৃ. ৫৯]

    
    গ.    একজন কর্তাব্যক্তি বোটে চড়ে দুরবিন হাতে আসছেন
        রূপসি সঙ্গিনীকে সঙ্গে করে। কী চমৎকার
        বন্যার শোভা। তুলে নিচ্ছেন অনুপম পোজ
        নিজস্ব ক্যামেরায়।
                               [পূর্বোক্ত : পৃ. ৫৯]

    ঘ.    একজন জলের কয়েদি দেখে এইসব দৃশ্যাবলি
        মূর্ছা যায়। তিনদিন পর আহত সূর্য ওঠে পুব
        আকাশে অপরাধীর মত।
                                  [পূর্বোক্ত : পৃ. ৬০]

    ঙ.    মনু কি দুঃখের নাম, দুঃখ কি মনুনাুী নদী?
        মনু এক তীব্র হলাহল
        মানুষের সমস্ত আনন্দকে করেছে দখল।
                                              [ পূর্বোক্ত : পৃ. ৬২]

প্রথাবদ্ধ জীবনের বিপরীতে সৃষ্টিশীল মন চিরকালই জেগে ওঠে। জিজ্ঞাসার লতাগুল্মে রক্তাক্ত হয় মন। বালিয়াড়ি ঝড়ে কখনও-বা দিনযাপনের ঘরবেসাতি উড়ে যায়, উবে যায়। ‘আমার শৈশব জুড়ে কোনও দুঃস্বপ্ন ছিল না’ বলে কবি নৃপেন্দ্রলালের নির্ভার উচ্চারণ কি কেবল আপ্তবাক্য? নাকি ঘাতক সময়ের কাছে আত্মসমর্পণ? কবিকণ্ঠে আমরা শুনতে পাই-

        হে আমার ঘাতক দিনকাল
        শৃঙ্খলাহীনতার মধ্যে কি কোন ক্ষমাহীন
        কল্যাণব্রত থাকে না
        ব্রতহীনতার মধ্যে কোন সৌম্য
        স্বাভাবিকতা?
                    [উপদেশের বিরুদ্ধে সওয়াল : পূর্বোক্ত, পৃ. ৫২]

সংগত কারণে কবির এ ভাষ্যের সঙ্গে আমরা সহমত পোষণ করি। আবার শৃঙ্খলিত জীবনের বিপরীতে শ্রেয়শীল মানুষের কথকতা নৃপেন্দ্রলালের কবিতায় অভিজ্ঞান ছড়ায়, গাঢ় উচ্চারণে :

    আমি, মানুষের দ্রাবিঢ় রক্তে দৈবের বিরোধী স্লোগান পুষেছি।
    আমি, মানুষের অন্ধ বিশ্বাসের সাঁকোটাকে করেছি খান খান।
    আমার করোটিতে কবিতার কার্তুজ আছে,
    মানুষের শ্রেয়শীল ব্রতকথা আছে।
                            [গন্তব্যে মোহিনী ছায়া শত্র“র : পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৩]

ঐতিহ্যপ্রীতি মানুষকে জিজ্ঞাসু করে। অতীত তাকে নিয়ে যায় স্বর্ণশোভাময় আরেক জগতে। প্রাচীন ভারতের সভ্যতা-সংস্কৃতির স্মারক অজন্তা-ইলোরার গুহাচিত্র, সিন্ধুতীরের হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো আর আবেস্তার প্রতœপুথি ও এর অক্ষরবিন্যাস আমাদের উজ্জীবিত করে। এই প্রতœসভ্যতার শিকড় জুড়ে আমাদের পূর্বপুরুষের বর্ণাঢ্য সৃজনীধারার ইতিহাস পরিব্যাপ্ত। ঐতিহ্য-পিয়াসী কবির চেতনবিশ্ব ও সমান্তরাল গতিতে বহমান :

সময়ই, অজন্তার স্তনবতী নারী।
সময়ই, হরপ্পার টেরাকোটা ইট
সময়ই, আবেস্তার অচেনা হরফ।
                  [ হে সময়, হে সুনীল শত্রু : পূর্বোক্ত পৃ. ৫৬]

‘বৈশালীর প্রতি সনেটগুচ্ছ’ নৃপেন্দ্রলাল দাশের ধ্রুপদরীতির গীতিকবিতা। শিরোনাম থেকেই স্পষ্ট যে এগুলো সনেটরীতির কবিতা। বৈশালীকে উদ্দেশ করে কবি নৃপেন্দ্র তাঁর অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছেন এ-পর্বে। ঐতিহ্য-অন্বেষা আর দেশমাতার পরিপূর্ণ বিকাশই এসব কবিতার উদ্দিষ্ট। কবি বিশ্বস্ত চিন্তায় তাঁর প্রেম, আকুতি, স্বদেশের রূপ, দ্রোহ, ভালোবাসা ও ইতিহাস বিমূর্ত চেতনায় বাক্সময় করে তুলেছেন। একটি উদাহরণ :
আমার সোনার বাংলা এই অযান্ত্রিক ইলিশের
দেশ, তোমার উপমা। তোমার দেহের ভাঁজে গৌড়
বরেন্দ্রের প্রাচীন সৌগন্ধ দোলে, বহু বছরের
বুদ্ধ ও মাৎস্যন্যায়ের অভিজ্ঞতায় দারুণ তুখোড়
তুমি। তাম্রলিপ্ত, সমতট, শশাঙ্কের এই দেশ-
                                    [১২ সংখ্যক সনেট : পূর্বোক্ত পৃ, ২৩]


এ-বর্ণনায় কবি অনেকটাই ঐতিহ্য-সন্ধিৎসু। আত্ম-আবিষ্কারে, ঐতিহ্য-অন্বেষায় জনপদ, বন্দর আর রাজ্যপাটে পরিক্রমণশীল নাবিক, অভিযাত্রী। এই সনেটগুচ্ছের সম্প্রসারিত দীর্ঘ কবিতা ‘এই ইলিশের দেশ’ (২০১৪)-এর বিষয়-বিন্যাস ও রচনাশৈলী  পাঠককে মুগ্ধ করে। ইতিহাসের কালপর্ব ঘুরে কবি নৃপেন্দ্রলাল বাংলার পল্লি-প্রকৃতির রূপমাধুর্য অবগাহন করে যেতে চান আজীবন। এখানেও কবি প্রকৃতিকুঞ্জে, পৃথিবী চরাচরে আমৃত্যু অবস্থানের স্বপ্ন বুননে তৎপর।

    যতদিন বেঁচে আছি ততদিন দেখে যাবো-
    কুশিয়ারা নদীতে সাঁতার কাটে বাঙালি কিশোরী
    দুর্গাসাগরে মহাপদ্ম মেলে বরিশালের
    স্থানীয় শৈলীতে জলের নূপুর।
    দেখে যাবোÑ নওল কিশোর ‘ল্যাপটপ’ স্বপ্ন বোনে
    সারাদিন। দেখে যাবোÑ
    কর্ণফুলির পানিতে ভাসায় দুঃখ দেহশ্রমী নারী।    
    দেখে যাবোÑবাংলার শাশ্বত বঙ্গরূপ।
                                [এই ইলিশের দেশে : পৃ. ১৬]

কবি নৃপেন্দ্রলাল দাশের কবিমন বিবাগী-উদাস। ঐতিহ্যপ্রীতি আর দেশপ্রেম তাঁর কবিতাকে দিয়েছে ভিন্নমাত্রা। তাঁর মননবিশ্বে বহুরৈখিক শিল্পমাধ্যম খেলা করে। কবিতার সবুজ সায়রে সারস গ্রীবায় তাঁর উপমারূপক-উৎপ্রেক্ষা ছন্দিতলয়ে সাঁতরায়। নিসর্গপ্রেম কবির অন্তর্গত চেতনার শিল্পিত অভিব্যক্তি। অনেকটা স্বভাবকবির রূপমাধুর্য সন্দর্শনের সহজাত  প্রক্রিয়া। ধ্রুপদরীতির কাব্যচর্চায় তিনি অনেকটাই সিদ্ধহস্ত। আর এজন্য তাঁর কাব্যপাঠে সচেতন পাঠক খুঁজে পান শিল্পরসের বয়ান, নান্দনিক চিত্রকল্প অথবা প্রেমবিহ্বল হৃদয়ের মৃদুকম্পন। সবকিছু ছাপিয়ে তাঁর ঐতিহ্যচেতনা পাঠককে মুগ্ধ করে। শিল্পরসের সঙ্গে জীবনরসের সংশ্লেষ যত বেশি প্রগাঢ় হয় পাঠকের বোধ, বিশ্বাস ও চেতনায় তা প্রবলভাবে নাড়া দেয়। নৃপেন্দ্রলালের কাব্যে আমরা এমনটি খুঁজে পাই। ইতিহাস-ঐতিহ্য ও দেশমাতৃকা তাঁর কবিতার অবয়ব জুড়ে বিবাগী হাওয়ার মতো উড়ে যায়, কিছু বলে যায়। বলা যায়, কবিতার দিঘল দিঘিতে তিনি অনায়াসে সাঁতার কাটেন নিজস্ব ভঙিমায়। যদিও পারমার্থিক প্রচ্ছন্ন ছায়া মাঝেমধ্যে তাঁর অন্তরে খেলা করে কিন্তু কবিতার শব্দপঙ্ক্তি তাঁকে প্রবল আকর্ষণে বাস্তব জগতের সঙ্গে একীভূত করতে চায়। এরকম দ্বান্দ্বিক বিহ্বলতা মাঝেমধ্যে তাঁকে পেয়ে বসে। এটা কী আধুনিক কবিস্বভাবের স্তরবিন্যাস? সচেতন পাঠক তা খুঁজে পাবেন।

আপনার মন্তব্য