মন বোঝ না, প্লিজ!

 প্রকাশিত: ২০১৭-১১-০৯ ১০:১০:০৮

 আপডেট: ২০১৭-১১-০৯ ১০:১৬:৫২

আফরিন জাহান হাসি:

নয় দশ বছরের ছোট্ট মেয়েটা সবুজের চারদিকে ঘুরছে, লাফ দিয়ে ওর মুখটা ধরার চেষ্টা করছে, চেষ্টা করছে পুরো মনোযোগটা পেতে আর একটি কথাই বলে চলছে, “একটু বোঝ প্লিজ, একটু বোঝ”।

সবুজ ওর মুখের হাসি লুকানোর চেষ্টা করছে আর কপট গাম্ভীর্য নিয়ে বলছে যে তুই বুঝিয়ে দিলেই তো আমি বুঝে যাই, তুই ঠিক করে বুঝিয়ে দে। সবাই তাই দেখে হাসছে। সুস্মিতাও প্রথমে হেসে ফেলেছিল, তারপরও ও সবুজকে অনুরোধ করে, অনেক তো হলো, এবার ওর কথাটা বোঝ। সবুজ বলে ওঠে, “তুমি নাক গলাচ্ছো কেন? দেখি না, ও আর একটু মাথা খাটাতে পারে কিনা!”

পিচ্চিটাও কিছুটা বুঝতে পারছে যে ওর ভাই ইচ্ছে করে এমন করছে, কিন্তু কথাটা এগিয়ে নিতে পারছে না যেহেতু সবুজ প্রথম অংশটাই বোঝেনি বলছে। পিচ্চিটার অসহায় মুখের ভাব দেখে সুস্মিতার মন খারাপ হয়ে গেল, সে বারান্দায় চলে এল। ওর এমনিতেও মনটা খারাপ ছিল,গতকালই একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সবুজের সাথে কথা কাটাকাটি হলো।

আচ্ছা, সবুজ কি এইরকমভাবে ইচ্ছে করেই ওকে বুঝছে না, নাকি সত্যিই বুঝতে পারছে না! কেউ যদি কিছু ইচ্ছে করে বুঝতে না চায়, তাকে কি বোঝানো যায়! গতকালের বিষয়টা নিয়ে এর আগেও সবুজের সাথে আলোচনা, বিতর্ক- সবই হয়েছে, কিন্তু কোন লাভ হয়নি, একই জিনিষের পুনরাবৃত্তি।

সবুজ কিছুতেই কোন কিছু নিজে পছন্দ করে কিনবে না। এতদিন হয়ে গেল ওদের সংসার, কখনো সুস্মিতাকে সাথে না নিয়ে ওর জন্য কোন উপহারও সবুজ কেনে না। তার মনে ভয়, সুস্মিতার পছন্দ হবে না। নিত্যকার টুথপেস্ট, সাবান থেকে শুরু করে যেকোনো কিছুই সুস্মিতা কিংবা ওর ননদদের পছন্দে কেনা হয়। সুস্মিতা কত বলে, আমার খুব শখ, তুমি নিজে পছন্দ করে আমার জন্য কিছু কিনে আনো। সবুজ আঁতকে ওঠে, “হুম আনি, তারপর দেখা যাবে, এটা আর একটু কালো, কিংবা লাল হলে ভালো হতো, এটা এমন না হয়ে ওমন হলে ভালো হতো!” সুস্মিতা কত বলে তুমি এনেই দেখ, আমি এগুলো বলি কিনা। সবুজ মাথা ঝাঁকায়, ওর নাকি জানা আছে, ওর পছন্দ নিয়ে ওর বোনেরা নাকি সবসময় হাসাহাসি করতো। সুস্মিতা কিছুতেই ওর মনের এ অবস্থা বদলাতে পারেনি।

বিষয়টা তুচ্ছ, বাদও দেয়া যায়। আবার সবুজ একটু চেষ্টা করলেও পারে, যেহেতু সুস্মিতার আসলেই শখ হয়। সুস্মিতা চেষ্টা করে বাদ দিতে কিন্তু সবুজই তোলে প্রসঙ্গটা। কোন কিছু নিয়ে যদি একবার বলা যায় যে এটা কেনাটা বোকামি হয়েছে ওমনি সবুজ বলে ওঠে, ও কিনলেই নাকি ওকে একচোট শুনতে হতো।

সুস্মিতার মন খারাপ হয়ে যায়, প্রত্যেকেরই ভুল হতে পারে এটাকে এভাবে দেখতে হবে কেন, সে কি সব কিছু নিয়েই এমন করে বলেছে! ওখানেই সমস্যা। সবুজের বক্তব্য অনুযায়ী, সবকিছু নিয়েই নাকি ওকে ওভাবে শুনতে হবে। আর এ বক্তব্যই সুস্মিতার জন্য প্রচণ্ড কষ্টের। কেন ওর ধারণা যে ও যাই কিনে আনবে তা নিয়েই ওকে কথা শুনতে হবে!

সুস্মিতার একটি আর্টিকেলের কথা মনে পড়ে যায়। ডা. অ্যালান শোয়ার্জ (এলসিএসডব্লিউ, পিএইচডি) তার ব্লগ এ লিখেছেন এই প্রিকনসিভড নোশন নিয়ে। এই মনোবিজ্ঞানীর ভাষ্য অনুযায়ী আমরা সবাই কম বেশী প্রিকনসিভড নোশন দ্বারা আক্রান্ত। মানে একটা পূর্বধারণা নিয়ে রাখা। এই বায়াস যত তীব্র হয়, মানুষের মাঝে ভুল বোঝাবুঝিও তত তীব্র হয়। আর তাই মাঝে মাঝেই দেখা যায়, কারো সাথে কোন আলোচনায় বিতর্ক হচ্ছে, একজন যা বোঝাতে চাইছে, অন্যজন বুঝছে পুরো ভিন্ন একটা বিষয়- তার পূর্ব ধারণার প্রেক্ষিতে। এ থেকে যদি আমরা বেরোতে পারি, তবে মানুষে মানুষে ভুল বোঝাবুঝি কমে আসবে অনেক। এই মনোবিজ্ঞানী পরামর্শ দিয়েছেন, অন্যের কথা খোলা মন নিয়ে, মনোযোগ দিয়ে শুনে তারপর কথা বলতে। যত বেশী নিজের মধ্যে থেকে পূর্ব ধারণা দূর করা যাবে তত আমরা নতুন কিছু জানতে শিখতে পারবো। সুস্মিতা ভাবে এই লেখাটা সবুজকে পড়তে বলবে।

এক ঝাঁক গাংচিল এর পাখা ঝাপটানোর শব্দে সুস্মিতার ভাবনায় ছেদ পড়ে। ওর বাংলো পাহাড়ের উপর, পাহাড়ের ঢালে একটি কড়ই গাছ, ছাতার মত সুন্দর লাগে বারান্দা থেকে। সে গাছে একঝাঁক গাংচিল এসে বসেছে। এখান থেকে সৈকত কত দূরে ও জানে না, মাঝে মাঝেই গাংচিলগুলো দল বেঁধে আসে এই গাছে, যেন বিশ্রাম নেয়, আবার উড়ে যায়। শুভ্র সুন্দর! সুস্মিতার মন ভাল হয়ে যায়, পাখিগুলো দেখে। মানুষও তো এরকম দল বেধে থাকতেই ভালোবাসে! কত ভালোবাসে একজন মানুষ আর একজনকে! তবু কেন এত ভুল বোঝাবুঝি, এত দূরে সরে যাওয়া!

পাখিগুলো দেখতে দেখতে সুস্মিতা কামনা করে মানুষের মাঝে ভালোবাসার বন্ধন দৃঢ় হোক, অবসান হোক সব ভুল বোঝাবুঝির।

আপনার মন্তব্য