জেসমিন

 প্রকাশিত: ২০১৮-০৯-০৬ ১২:৪৭:২৫

জহিরুল হক মজুমদার:

কন্যা পিতাকে:

প্রিয় বাবা
তুমি আমার নামটা অনেক ছোট্ট রেখেছ। মানুষের নামের তিনটা অংশ থাকে। ফার্স্ট নেইম, মিডল নেইম এবং সারনেইম। আমার নাম শুধু জেসমিন। যদিও নামটা খারাপ নয়। ফুলের নামে নাম। কিন্তু পৃথিবীর অনেক জায়গায় মানুষ আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছে। এত ছোট্ট একটা নাম! আগে পাছে আর কিছু নেই।

একবারতো ইউএসএ-তে ইমিগ্রেশন অফিসার হেসে দিয়েছিল। জেসমিন! জাস্ট এ ফ্লাওয়ারস নেম। হাউ ক্যুড ইট বি অ্যা পারসনস নেম!

আরেকবার আরেকজন ইমিগ্রেশান অফিসার পাসপোর্টটি হাতে নিয়ে বলেছিল, অ্যা ফ্লাওয়ারস পাসপোর্ট। আই ওয়ান্ট টু কিপ ইট উইথ মি। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এই বুঝি পাসপোর্ট সিজ করে নিয়ে গেল! তারপর দীর্ঘ ইমিগ্রেশন জেরা কিংবা এফবিআই হেফাজত শুরু হল বলে! কিন্তু না। এক গাল হেসে দিয়ে সিল মেরে পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে ইমিগ্রেশন অফিসার বললেন, ওয়েলকাম টু ইউ এস এ জেসমিন। লেট ইউএসএ বি ফিলড উইথ ফ্লাওয়ারস।

প্রথম পরিচয়ে আমার সুপারভাইজার আমার নাম শুনে খুব অবাক হয়েছিলেন। তিনি বললেন, তোমাকে আমি ডাকবো জেসি নামে।

প্রতিবাদ করলো জন- ফুলের নামকে সংক্ষিপ্ত করলে তার কোন সৌরভ থাকে না।

প্রফেসর পল রেগে গিয়ে বললেন- এই ছোকরা, আমাকে জ্ঞান দেবে না। তোমার নিজের কাজ কর।ও আমার মেয়ের মত। আমি যা খুশি ডাকবো।

জন ব্যঙ্গ করে বলল- প্রথম প্রথম তুমি আমাকেও ছেলের মত বলতে। কিন্তু কাজ না পারলে তুমি আর বাবা থাকোনা, হয়ে উঠ দানব।

এই জন এর প্রতি আমার একসময় দুর্বলতা জন্মায়। জন তার বাবাকে হারিয়েছে ভিয়েতনাম যুদ্ধে। আমাকে কখনো বলেনি। আমি জানতে পারি এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে।

একদিন আমি জন-এর মায়ের সাথে দেখা করতে চাই। জন আমাকে নিয়ে চলে। অনেকদূর আসার পর জন কৌতুকের হাসি হেসে বলে, এবার তোমার চোখ বেঁধে দেব। তারপর নামিয়ে দেব জায়গা মত।

আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দেখি একটা মিষ্টি হাত আমার চোখের বাঁধন খুলে দিয়ে রহস্যময় হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নিষ্পাপ শিশুর হাসিমাখা মুখে একজন মা। জনের মা।

আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখি একটা বিশাল বাগানবাড়ি। আর চারদিকে জেসমিন ফুলের বিশাল বাগান।

জন চিৎকার করে উঠে, মা এটা তুমি কী করলে! ওর চোখের বাঁধন খুললে কেন? আমি খুলতাম।

মা বললেন- জন আজকে তোমার একটা নতুন জীবন শুরু হতে যাচ্ছে। তাই এই খেলাটা আজ আর খেলার দরকার ছিলনা।

জেসমিন বাগানের আড়াল থেকে জন বেড়িয়ে আসে ক্রলিং করে। হাতে একটা একে রাইফেল।

মা বললেন- ভয় পেওনা। ওটা খেলনা রাইফেল। আর এটা ওর একটা প্রিয় খেলা।

ওর বাবা যখন ভিয়েতনামে শত্রুপক্ষের হাতে বন্দি হয় তখন এই জেসমিন বাগানে ও এই খেলাটা খেলত। বাবাকে উদ্ধার করার খেলা। আমার চোখ বেঁধে দিয়ে ক্রল করে এগিয়ে আসত। তারপর আমার চোখের বাঁধন খুলে দিত। দুর্ভাগ্য! ওর বাবা আর ফিরে এলোনা।

জন-এর সাথে আমার ঘর বাঁধা হয়নি। জন এর মত আবেগি ছেলের যা হবার তাই হয়েছে। বাবাকে খুঁজতে খুঁজতে আবেগি জন এক সময় ক্লান্ত হয়ে যায়। পিএইচডি ছেড়ে দেয়। ক্লান্তি তাকে নিয়ে যায় না ফেরার দেশে।

বাবা তুমি ভাল থেকো। নিজের শরীরের যত্ন নিও।

পিতা কন্যাকে:


মা মণি
তোমার নামটা আমি সবচেয়ে ছোট রেখেছি কেন এই ছিল তোমার প্রশ্ন। আর তারপর তোমার এবং জন এর জীবনে যা ঘটেছে তা এতদূর থেকে শুধু অনুভব করতে পারি। একেকটা প্রজন্মের জন্য সমাজে রাষ্ট্রে পৃথিবীতে একেকটা পরিস্থিতি থাকে। এই পরিস্থিতিই তাদের প্রেম, ভালোবাসা, আবেগ এবং সার্বিক জীবন নিয়ন্ত্রণ করে।

তুমি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছ, আমার নামটা অনেক লম্বা। আমার দাদা এবং নানা দু’জনেই দুটো নাম রেখেছিলেন। আমার বাবা দুটো নাম জোড়া দিয়ে একটি নাম রাখলেন। কারোর ভালোবাসাকেই তিনি আঘাত দিতে চান নি। দাদা এবং নানা দু’জনেই খুশি হলেন। কিন্তু আমার জন্য বোঝা হয়ে গেল এই নাম।

স্কুলে একটা বাচ্চাকে প্রথমেই তার নিজের নামের বানান শিখতে হয়। আমার লম্বা নামটার বানান শিখতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। মার খেতে হয়েছে শিক্ষকের কাছে অনেক। সেইসব দিন এখনো মনকে পোড়ায়।

তাই তোমার নামটা আমি রেখেছি অনেক ছোট। যাতে তুমি সহজে শিখতে পার তোমার নামের বানান। জীবনের প্রথম সফলতার জন্য যাতে তোমাকে অনেক কষ্ট করতে না হয়। তোমার মনে আছে তুমি যেদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে অর্ধেক চকোলেট আমাকে দিলে। সব ছেলে মেয়ের মধ্যে সবার আগে নিজের নামের বানান শুদ্ধ করে লেখার জন্য তোমার টিচার তোমাকে চকোলেট দিয়েছিলেন। আমার জীবনের গভীর আনন্দের দিন ছিল সেটা।

জীবন একটাই। তাকে হাসিমুখে গ্রহণ কর। পৃথিবীর যেখানেই থাক, ভাল থেকো।

আপনার মন্তব্য