রক্তজবা

 প্রকাশিত: ২০১৮-১২-১৬ ০০:১৯:৪০

 আপডেট: ২০১৮-১২-১৬ ০০:২৪:০৪

নাজমুল হক তপন:

‘তোমার-আমার গৌরব
জবা ফুলের সৌরভ’
’চারিদিকে একই শুনি
জবা নামের জয়ধ্বনি’

এমন স্লোাগান দিতে দিতে ১২/১৩ বছরের কিশোরী তার বড় বোনতুল্য সেলিনা খাতুনের বাড়িতে প্রবেশ করে। হাসতে হাসতে সেলিনা বলে, এই পাগলি এগুলো কী বলিস? নিজের নামের এমন ঢাক পেটাচ্ছিস?  বেনি দুলিয়ে, ঠোঁট বেঁকিয়ে গ্রামের স্কুলে সপ্তম শ্রেনীতে পড়ুয়া জবার চটপট জবাব, নিজের নামের মর্যাদা বাড়াচ্ছি। মানুষ সবকিছুই করে নিজের নামের গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য। তোমার বুদ্ধি আরেকটু বেশি হলে তুমিও বুঝতে? নাও ধরো বলে, ফুলের একটা ছোট ডালা সেলিনার হাতে দেয় জবা। চুলের বেনি ধরে কাছে টেনে নিয়ে সেলিনা বলে, দৌড় দিস না, নতুন বানানো মোয়া খেয়ে যাস।

‘বু...ঝে...ছি’, জবাব দেয় জবা। জিজ্ঞাসু চোখে সেলিনা বলে, ‘কি বুঝেছিস?’
জবা- আমাকে ডাক পিওন হতে হবে। হা হা হা হা।
সেলিনা- ছাই বুঝেছিস।
জবা- ঠিক আছে। আমার বুঝাবুঝির দরকার নাই। মোয়া দাও খেতে খেতে চলে যাই। আর কিছু কিন্তু নেব না। মনে থাকে যেন?

এ পর্যায়ে জবাকে আরেকটু বাড়তি আদর করে জড়িয়ে ধরে সেলিনা বলে,
’দিকে দিকে একই শুনি
জবা নামের জয়ধ্বনি’, এরপর জবার হাতে একটি চিরকুট গুঁজে দেয় সেলিনা। আর বলে, তোদের বাড়িতে আজ বিকালের দিকে যাব। কোথাও যাস না। থাকিস? জবার উত্তর- তোমার জিনিসসহ বান্দা হাজির থাকবে। নো টেনশন... খুকুমনি।

জবার কথার ধরনে হাসতে হাসতে সেলিনা বলে, খুব পেকেছিস দেখি!
এ কথায় পাত্তা না দিয়ে জবা বলতে থাকে, বলতো, এই ফুলগুলি কোথা থেকে এনেছি?
সেলিনা: এগুলো তোদের বাগানের ফুল না?
জবা: নো। যে বাগানের ফুল তুমি চাও, সেই বাগানের। জিয়াদ ভাই কাল রাতে ট্রেনিং থেকে এসেছে। আজ যে কোনো সময় চলে যাবে। মনে হয় সন্ধ্যার দিকে যাবে। আজ সকালে ‘খোকা বাবু’র বাগানে ফুল তুলতে গিয়ে আমাদের কথাও হয়েছে। একটু পর আবার যাব।’ তুইও ‘খোকা বাবু’  বলিস। কিছুটা কপট রাগ দেখিয়ে উত্তর দেয় সেলিনা।

জেলা শহরে এক আত্মীয়ের বাসায় থেকে কলেজে পড়ে সেলিনা। ম্যাট্রিক পাসের পর কয়েক মাস আগে কলেজে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু ২৫ মার্চের পর থেকেই স্কুল-কলেজ সব বন্ধ। সন্তানদের শহরে থাকাটা নিরাপদ মনে করছেন না কোনো অভিভাবকই। গত কয়েক মাস ধরেই গ্রামের বাড়িতে সেলিনা। একই কলেজে বিএ পড়ে জিয়াদ। আগে সেভাবে যোগাযোগ না থাকলেও একই গ্রামের ছেলে একই কলেজে পড়ার সূত্র ধরে, বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে জিয়াদ-সেলিনা। তবে জিয়াদের মাথায় সারাক্ষণ রাজনীতি। দেশ স্বাধীন করতে হবে এসবকিছু। জিয়াদের অনেক কথাই বোঝে না সেলিনা। তবে দেশের কথা বলতে গিয়ে সাধারণ চেহারার ছেলেটার চোখে যে দিপ্তী দেখে সেটা আলোড়িত করে সেলিনাকেও। রাজনীতি নিয়ে আগ্রহ না থাকলেও ঝড়ের পূর্বাভাস ঠিকই টের পায় সে।

‘তোমার-আমার ঠিকানা
পদ্মা মেঘনা যমুনা’।
’একটা দুইটা পাঞ্জাবি ধর
মাথায় তুলে আছাড় মার’
এই সব স্লোগান দিতে দিতে জিয়াদের বাড়িতে প্রবেশ করে জবা।

গত কিছুদিন ধরেই দু’একজন ছাড়া সবারই জিয়াদের ঘরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আছে। তবে এই নিষেধাজ্ঞা জবার জন্য প্রযোজ্য নয়। জিয়াদ বাড়িতে থাকলে যখন খুশি তখনই ঘরে ঢুকতে পারে জবা। জিয়াদের ঘরে প্রবেশের মুখেই জিয়াদ বলে ওঠে...
‘তোমার আমার গৌরব
জবা ফুলের সৌরভ।’

জিয়াদকে চিঠি দিতে দিতে জবা বায়না ধরে, বন্দুক দেখাও। কোনোদিন দেখিনি।

আমার কাছে বন্দুক আছে, জবা রানীকে কে বলল? মোক্ষম শেল ছোড়ে জবা, সেলিনা আপু বললে তো বন্দুকই দিয়ে দিতে। দেখাও ভাল হবে না। অস্ত্র দেখতে দেখতে গল্প জুড়ে দেয় জবা। সবাই বলে তোমার নাকি অনেক সাহস। আমার কিন্তু মনে হয় না।

কেন রে? জিজ্ঞাসা করে জিয়াদ। সেলিনা বুবুর সামনে দাঁড়ালে তোমার অবস্থা হয় ক্লাসে পড়া না পারা ছাত্রের মত। এরপর দেখা হলে তোর বুবুকে তোর সামনে কান মলে দেব, জবাব দেয় জিয়াদ। এ পর্যায়ে জবা বলে, তাড়াতাড়ি দেশ স্বাধীন কর। যতো তাড়াতাড়ি দেশ স্বাধীন করবা ততো তাড়াতাড়ি তোমরা বিয়ে করতে পারবা। কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে যায় জিয়াদ। অস্তস্তি কাটানোর জন্য চুপ করে থাকে।

নীরবতা ভাঙে জবা তোমাদের বিয়ে হলে বুবুর অনেক শাড়ী আমি পাব। কী মজা! সেলিনা বুবুর তো আপন বোন নাই আমিই সব। চিঠির উত্তর নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুট লাগায় জবা।

বর্ষার পানি কেবল নামতে শুরু করেছে। একটা বড় খালের এপারে হওয়ায় হানাদার বাহিনী শিমুলতলী গ্রামে হানা দিতে পারেনি। আর এতে করে এই গ্রামটাই হয়ে উঠেছে মুক্তিযোদ্ধাদের পারষ্পরিক যোগাযোগের কেন্দ্র। আশপাশের অনেক গ্রাম থেকেই দলে দলে মুক্তিযোদ্ধারা এখানে সংঘঠিত হচ্ছে। প্রথম দিকে চোরাগুপ্তা হামলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও সময় গড়ানোর সঙ্গে বেশকিছু অপারেশনও চালিয়েছে মুক্তি বাহিনী। খালের ওপারে হানাদার বাহিনীর একটা বড় ক্যাম্প। দিনে দিনে ওরাও শক্তিবৃদ্ধি করেছে। বর্ষার পানি পানি কমে যাওয়ার পর স্থানীয় রাজাকারদের নিয়ে ওরাও অপারেশনে নামল। শুরু হলো বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাসি। আশপাশের কয়েকটা গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হলো। বেশ কয়েকজন মেয়েকেও ধরে নিয়ে যাওয়ার সংবাদও পাওয়া গেল। এ পর্যায়ে গ্রাম ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন শিমুলতলী গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা। কিন্তু বিপদ যে এত দ্রত আসবে এটা ভাবতে পারেনি অনেকেই।

নিজের বসতভিটা ছেড়ে যাওয়া তো আর মুখের কথা নয়।  তারপরও নিজেদের সাধ্যমতো জিনিস-পত্র নিয়ে গ্রাম ছাড়তে শুরু করল শিমুলতলীর অধিবাসীরা। অনেক মানুষের আনাগোনা থাকায় আশপাশের গ্রামগুলোতে হানাদার বাহিনীর কৃকীর্তি দ্রুতই এসে পৌঁছতো শিমুলতলী গ্রামে। আগের দিন গ্রাম ছেড়েছে সেলিনা আখতার ও তার পরিবার। জবাকে জোর করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু একদিন পর রওনা দেবে বলে বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকে গেল জবা। এ গ্রামের কয়েকজন যে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে এটা তখনো জানতে পারেনি গ্রামবাসীরা। বিনা মেঘে বজ্রাঘাত! স্থানীয় রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে হানাদারদের বিরাট একটা দল ঢুকল গ্রামে। ‘মেলেটারি’, মেলেটারি, পালাও-পালাও’ শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠল চারপাশ।

গ্রামবাসীরা যে যার মত ছুটতে শুরু করল। অনেকেই এক বস্ত্রে পালাতে পারলেও, বেশ কয়েকজন ধরা পড়ল। এই দলে ছিল জবার পরিবার। এলোপাথাড়ি গুলিতে মারা গেল বেশ কয়েকজন। অনেক বাড়ি ঘর পুড়ল। গ্রামে সেরকম মেয়ে নাই। এটা নিয়ে চরম বিরক্তি প্রকাশ করল হানাদার কামান্ডার। মিলিটারি নয়, জবাদেরকে ধরল একই গ্রামের ঘাপটি মেরে থাকা রাজাকাররা।  বাবা-মাকে গুলি না করে মারধর করে ছেড়ে দিল। এরপর ১৩ বছর বয়সী পুরো গ্রামকে মাতিয়ে রাখা জবাকে উপঢৌকন হিসাবে পাঞ্জাবি অফিসারের সামনে নিয়ে আসল তারা। পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করার মতো বয়স হয়নি জবার। টেনে-হিঁছড়ে নেওয়ার সময় জবা শুধু বলল, ‘আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছো, জিয়াদ ভাই জানলে তোমাদের লাশ শিয়াল-কুত্তা দিয়ে খাওয়াবে।’  

ওই রাতেই অনেকের সহায়তা নিয়ে জিহাদের সঙ্গে দেখা করলেন জবার বাবা-মা। খালের ওপারে ক্যাম্প অ্যাটাক করে জবাকে উদ্ধার করা যায় কিনা এমন আলোচনাও হল। কিন্তু একটা সুসজ্জিত বাহিনীর ক্যাম্প অ্যাটাক করার মতো আর্মস -অ্যামুনেশন নাই। বাস্তবতা খুব ভালভাবেই বুঝতে পারছে জিয়াদ। এদিকে জিয়াদের হাত ধরে কাকুতি-মিনতি করছে জবার মা। কান্না জড়ানো গলায় জিয়াদ বলল, ‘চাচা-চাচী .. আমার রক্তের সম্পর্কের বোনের চেয়েও আপন জবা। মনে করেন, আমার বোনকে আমি নিজে হাতে কুরবানী দিলাম।’ শশ্মানের নীরবতা নেমে আসল। মেয়ে উদ্ধারের শেষ আশাটুকু নিভে গেল। কাঁদতে শুরু করলেন জবার বাবা-মা।  

জবার বাবা-মার দিকে অপরাধীর চোখে তাকিয়ে সঙ্গীদের দিকে ফিরে জিয়াদ জানাল, জবাকে উদ্ধার করতে পারব কিনা জানি না। তবে যারা জবাকে ধরে নিয়ে গেছে, তাদের লাশ শিয়াল-কুত্তা দিয়ে খাওয়াব। এখন থেকে আমাদের প্রথম কাজ ওই পাঞ্জাবি পা-চাটা কুত্তাদের খুজেঁ বের করা।

একের পর এক বিজয়ের খবর চারদিকে। জবাকে যারা ধরে নিয়েছিল তাদের দু’জনকে নিজে হাতে গুলি করে খালের পাড়ে ফেলে রাখল জিহাদ। আর সবার উদ্দেশ্যে জানাল, ওদের লাশ যদি কেউ সরায় তাহলে কপালে তার খারাবি আছে। বাংলার পবিত্র মাটি যেন ওরা না পায়। মুক্তি বাহিনীর ভয়ে খাল পেরিয়ে আসার সাহস পায়নি হানাদাররাও। শেয়াল-কুকুরেই খেয়েছে বিশ্বাসঘাতকদের ঘৃণিত শরীর।

যুদ্ধের তীব্রতা অনেকে বেড়ে গেছে। হানাদাররা লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছে। হানাদার বাহিনীর খুব গুরুত্বপূর্ণ এক ঘাঁটি দখলের লড়াইয়ে জিতল মুক্তি বাহিনী। তবে মারাত্মকভাবে আহত হল জিয়াদ। সতীর্থরা তাকে ক্যাম্পে নিয়ে আসতেও সমর্থ হল। সেখান থেকে আরো উন্নত চিকিৎসার জন্য জিয়াদকে নেয়া হল শিকারপুর ক্যা¤েপ। কিন্তু জীবনীশক্তি শেষ হয়ে গেল জিয়াদের। শেষ সময়গুলোতে জিয়াদ শুধু একটাই কথা বলত, ‘জবা আমাকে মাফ করিস বোন। আর সঙ্গীদের তার শেষ কথা ছিল, দোস্ত আমার কবরটা বাংলাদেশের মাটিতে দিস।’

এর দু’দিন পর দেশ স্বাধীন হল। খাল পার হয়ে ক্যাম্পে ঢুকল গ্রামবাসীরা। কয়েকজন অত্যাচরিত মেয়ে উদ্ধার হল। জবার বিষয়ে এদের দু’একজন যা জানাল তা সংক্ষেপে- এক অফিসারকে কামড়ে-খামচে চোখ-মুখ রক্তারক্তি করে দিয়েছিল জবা। এরপর আর কোনোদিন তারা জবাকে দেখেনি।

বাড়ির কাছেই কবর দেয়া হল জিয়াদকে। সেলিনার প্রস্তাব মত শহীদ মিনার নির্মিত হল জিয়াদের কবরের পাশেই। শহীদ মিনারের কাজ শেষ হওয়ার ভোর রাতে। সবকিছু ফেলে রেখে চিরদিনের জন্য গ্রাম ছাড়লেন জবার বাবা-মা। আর কোনদিন গ্রামে ফেরেননি তারা।


গ্রামের স্কুলে প্রবেশের মুখেই ফুল বাগান। ফুলবাগানে অনেক টকটকে রক্তজবা। এই বাগানে সবসময়ই জবা ফুল থাকে। প্রধান শিক্ষক সেলিনা খাতুনের কড়া নির্দেশ, বাগানে জবা ফুল থাকতেই হবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এই স্কুলে একটি দিনের জন্যও জবা ফুল ফোটেনি এমনটা কেউ কখনো দেখেনি।

গ্রামের হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে অবসরে গেলেন সেলিনা খাতুন। স্কুলের শেষ দিনে, এক সময়ে  তারই  ছাত্র, নতুন প্রধান শিক্ষককে সেলিনা খাতুন বিনীত সুরে বললেন, ‘আমি যে ক’টা দিন বাঁচি, এই স্কুলের ফুল বাগানে তোমরা রক্তজবা বাঁচিয়ে রেখো।’

আপনার মন্তব্য