পাঠ পর্যালোচনা: শরণার্থী শিবির থেকে

 প্রকাশিত: ২০১৯-০২-০৭ ২১:০৯:৫৭

সঙ্গীতা ইয়াসমিন:

বাঙালির জীবনে মুক্তিযুদ্ধ একটি মহাকাব্য। একে পাশ কাটিয়ে আমাদের জীবন, সংস্কৃতি, বোধ, বিবেক, বেড়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের এই বিশালাকায় ক্ষত, বেদনার এই গাঢ় অনুভব আমাদের শিল্প-সাহিত্যকেও করেছে অনেক বেশি ঋদ্ধ। যার প্রকাশ আমরা দেখি নানা ব্যঞ্জনায় শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গনে।

‘শরণার্থী শিবির থেকে’ মোজাম্মেল হক নিয়োগী রচিত একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কিশোর উপন্যাস, যা ১৯৭১ সালের শরণার্থী শিবিরের পটভূমিতে প্রথম উপন্যাস। এই উপন্যাসের গল্প মূলত বাস্তব তথ্য অবলম্বনেই নির্মিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের মেঘালয়ে বাঘমারা শরণার্থী শিবিরের প্রতিদিনের জীবনযাপনকে কেন্দ্র করেই এই গল্পের জন্ম ও আবর্তন। যুদ্ধ চলাকালীন মানুষের জীবন-ভাবনা, বিবেক, প্রতিমুহূর্তের অস্থিরতা-আশঙ্কার যে চলমান প্রবাহ সেই জীবনেরই খণ্ডিত চিত্র রূপায়িত হয়েছে এই গল্পে। যেখানে একটি সত্যই মূর্ত হয়ে উঠেছে- ‘বেঁচে থাকা’। মৃত্যুই যখন অনিবার্য গন্তব্য হবার কথা ছিল, তখন বেঁচে থাকাটাই বড় লড়াই। কেবল বেঁচে থাকার তাগিদেই দেশ, মা, মাটি সব ছেড়ে শুধু প্রাণ হাতে নিয়ে সীমান্ত পার করেছে লক্ষ লক্ষ মানুষ।

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বাবু, যার জীবন ঘিরেই এর কাহিনী বিন্যস্ত হয়েছে। বারো বছর বয়সের এক কিশোরের শৈশব, যুদ্ধপীড়িত সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে তার বেড়ে ওঠা, ঘটনার পরম্পরায় তাকে করে তুলেছে আরও বেশি বাস্তব বোধ বুদ্ধিসম্পন্ন। বয়সের চেয়েও বয়সী বাবুর ভেতরের যে দহন, তা-ই তাকে তাড়িত করেছে আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে। তার চোখের সামনেই যখন পাকি কুত্তারা তার একমাত্র স্নেহের আঁচল বড় বোনকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেল তখন সে এক অসহায় কিশোর। পাকিস্তানি সেনাদের পায়ে জড়িয়ে কাঁদা ছাড়া সেদিন আর কিছুই করার সামর্থ্য ছিল না। সেই ঘটনা তার মনে এক জিঘাংসা তৈরি করেছিল। যা একটি কিশোরের স্বাভাবিক জীবনের বাস্তবতা নয়, গল্পের প্রয়োজনে এটি নির্মম সত্য। এখানেই লেখকের মুনশিয়ানা।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জীবনে যে বহুমুখী প্রভাব ফেলেছিল, বদলে দিয়েছিল আমাদের জীবনবোধ, আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের ঠিকানা সবই চিনতে শিখিয়েছিল নতুন করে, এই উপন্যাসের গল্প আমাদের তেমন উপলব্ধির সামনেই দাঁড় করিয়ে দেয়; অন্তত বাবুর জীবনচরিত দেখে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূল সুরের ওপরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল নাজমুল ইসলাম বাবুর প্রতি গিরিবালা আর গিরিশচন্দ্রের সন্তানতুল্য স্নেহের মাঝে আমরা সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনারও পরিস্ফুটন প্রত্যক্ষ করি। দেশ ছেড়ে পালানোর সময়ে নদীর জলেই কুড়িয়ে পেয়েছিল অচেতন বাবুর ছোট্ট শরীর। এই দম্পতি সেদিন সাথে করে বাবুকে নিয়ে না গেলে তার জীবনাবসানও ছিল অবশ্যম্ভাবী। হিন্দু বাবা-মায়ের ঘরে মুসলিম এই সন্তানের রেশন কার্ড প্রাপ্তির ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে গিরিবালা কৌশলের আশ্রয় নিতেও দ্বিধা করেননি। এ কেবল এক মায়ের স্নেহার্দ্র মনই নয়; এক নীরব লড়াইয়ের সাক্ষীও বটে।

বস্তুত, আশ্রয়কেন্দ্রের জীবনে ধর্ম-বর্ণ-জাত সবকিছুর ঊর্ধ্বে সকলের এক অভিন্ন পরিচয়; সকলেই উদ্বাস্তু। দেশহীন মানুষ। তাঁদের এই একাত্মতা, এসব হারানোর ব্যথাই তাঁদেরকে আরও বেশি করে বেঁধেছিল এক সূত্রে। সেই যূথবদ্ধ জীবনের বোধে ছিল মা-মাটি-দেশ। সব হারানো মানুষগুলোর দেশ নামক ‘মা’য়ের জন্য যে আকুলতা, দেশের মুক্তির জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা তা কেবল সময় আর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এর ব্যাপ্তি বহুদূর বিস্তৃত সে কথাই বর্ণিত হয়েছে এই গল্পের ভাঁজে ভাঁজে। তারা স্বপ্ন দেখে একদিন দেশ স্বাধীন হবে, আবার ফিরবে তারা আপন মাটিতে। সকলের হয়তো ফেরা হয়ে ওঠে না আর। শত স্বপ্নের সমাধি হয়ে যায় যুদ্ধের ময়দানেই।

শরণার্থী শিবিরের এই জীবনযুদ্ধই রাতারাতি নারায়ণকে নবজন্ম দিল। যাকে সবাই জোকার আর আড্ডাবাজ নারায়ণ বলেই জানত, সেও একদিন মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেল মুক্তিযুদ্ধে। মাকে সে বোঝাল যুদ্ধে না গেলে তাঁর আরেক মাকে অবমুক্ত করতে পারবে না শত্রুর হাত থেকে। মাও তাই একমাত্র পুত্রকে সঁপে দিলেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাতে; সাথে দিলেন আশীর্বাদের ফুল চন্দন। মা বললেন, ‘যা, মাকে শত্রুমুক্ত করে তবেই ঘরে ফিরবি, আর তা যদি না পারিস তবে মরে যাবি। মনে রাখিস, সে মরণ লজ্জার নয়, গৌরবের।’

এমন বীরপ্রসবা মায়েদের জন্যই বাংলার দামাল ছেলেরা সেদিন দাঁড়িয়েছিল শূন্য হাতে বজ্র কামানের মুখে।

বাবুর যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের কিছুকাল আগেই। বয়স যখন ৩-৪ তখন সে হারায় বাবাকে, বাবার মৃত্যুর পরে মা দ্বিতীয় বিয়ে করে অন্যত্র চলে যান। পিতৃ-মাতৃহীন এই ছোট্ট শিশুটির আশ্রয় হয় নানী কোলে। বছর দুয়েক পরে নানীও চলে গেলেন। তখন ঢাকায় বড় বোনের বাড়িতে একমাত্র এবং শেষ আশ্রয় জোটে। তখনই বাজল যুদ্ধের ডামাডোল। দুলাভাই হলেন নিখোঁজ। বোনকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে গেল।

এসমস্ত ঘটনায় বাবু নির্বাক-নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আশাহীন ঘোর অন্ধকারে কেবল মৃত্যুই তাড়িয়ে বেড়াত তাকে। শরণার্থী শিবিরে আসার পরে সপ্তাহখানেক সে চোখই খোলেনি, বাঁচতেই চায়নি। হঠাৎই নিজের ভেতরে সে এক অমিত তেজ অনুভব করল, যা তার বোনের সম্ভ্রমহানির প্রতিশোধ নিতে উন্মুখ করে তুলল। যুদ্ধে সে যাবেই মনস্থ করল।

অতঃপর শরণার্থী শিবিরে থেকেই মুক্তিফৌজ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ করে যুদ্ধে যোগ দিল বাবু। পর পর কয়েকটি সফল অপারেশনের পরেই এল সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। হোসেনপুরের আর্মি ক্যাম্প। যেটি আদতে তাঁর শৈশবের গ্রাম, ফেলে আসা স্কুল, মাঠ-ঘাট প্রান্তর, তাঁর চেনা জগতের ভিটে। যেখানে তার বোন শত নির্যাতন সয়েও ভাইয়ের অপেক্ষায় থাকবে বলেই সে বিশ্বাস করত। স্বপ্ন দেখত বোনকে উদ্ধার করার। কিন্তু ততদিনে বাংলার সবুজ জমিন হয়ে গেছে তার বোনের সবুজ শাড়ির আঁচল। তার ধর্ষিতা বোনের রক্তাক্ত শরীর হয়ে গেছে আমাদের স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য।

উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছিল আমি যেন সাক্ষাৎ সেই সময়ের মধ্য দিয়েই যাচ্ছি। বাঘমারা ক্যাম্পের প্রতিদিনের জীবন, জীবন-মৃত্যুর খেলা, মুক্তির লড়াই, স্বদেশের প্রেম, আর গেরিলা অপারেশনের ঘটনাবলি এক নিমেষেই আমায় নিয়ে গেছে ৪৭ বছর পেছনের সময়ে। আর এখানেই লেখকের সার্থকতা।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে প্রথম প্রকাশের পরে পাঠকের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা আর ভালোবাসায় চিত্রা প্রকাশনীর ব্যানারে বর্ধিত কলেবরে মুদ্রিত হতে যাচ্ছে এই উপন্যাস এ বছরের বইমেলায়। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এই গল্প মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে আজকের প্রজন্মকে দ্বিধাবিভক্তির হাত থেকে বাঁচাবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে দেশ গড়ায় উদ্দীপিত করবে। আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসের সন্ধান দেবার দায় আমাদের সকলের। সেই দায় সানন্দে কাঁধে নিয়েছেন লেখক নিজেই। লেখকের জন্য অপরিসীম ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা।

কিছু মুদ্রণ ত্রুটি বাদ দিলে এই উপন্যাসের কাঠামো, গল্পের বিন্যাস এবং চরিত্র চিত্রণ এক কথায় অনন্য। উপন্যাসের সার্বিক বিবেচনায় প্রচ্ছদও অনেকাংশে দুর্বল মানের যা দৃশ্যত বলাই যায়। আশাকরি এই বিষয়ে ভবিষ্যতে লেখক অধিক যত্নবান হবেন।

পরিশেষে বলব, মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করতে হবে হৃদয়ে, দেশ মাতৃকার কাছে আমাদের যে ঋণ তা শোধ করে যেতে হবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। এই হোক আমাদের আজকের অঙ্গীকার।

আপনার মন্তব্য