পশ্চিম আকাশে সোনার সিংহ দেখা কবি

 প্রকাশিত: ২০১৯-০২-১৭ ১৩:০০:৩০

মাসুদ পারভেজ:

রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী কিংবা শুধু কবিতা গোনায় ধরলে কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি। আবহমান বাংলার কবি। রূপসী বাংলার কবি। শুধুই কবি। যিনি কবিতার সাথে ঘরসংসার করতে গিয়ে সেই সময়কার দু'এক ব্যতিক্রম ছাড়া সবার বিরুদ্ধতা সয়েছিলেন। স্ত্রী কল্যাণী দাশ কিংবা মাতা কুসুমকুমারী দাশ বা শোভনা সবার মিলু আদতে জীবনযুদ্ধে বারবার পরাজিত হওয়া একজন। যে কিনা বাংলা সাহিত্যে কবিতার রাজাধিরাজ।

জীবনানন্দের দাশের কাব্যচর্চাবোধ এত গভীর যে স্বয়ং কবিগুরুও বুঝতে ব্যর্থ ছিলেন। বাংলা কবিতার হাওয়া বদলের কথাটা সেই সময়ে জীবনানন্দ দাশ নানা লেখা, সমালোচনায় ও কৈফিয়ত দিয়ে বুঝাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিদারুণ ব্যর্থ হয়েছিলেন। আবার তার উল্টারথে এসবের মধ্য দিয়ে তিনি রচনা করে গেছেন বাংলা সাহিত্যের অগণিত রত্ন। এসবের ভেতর দিয়ে তিনি নির্দ্বিধায় যেতে পারতেন ইয়েটস, শেলী কিংবা কিটসের সমপর্যায়ে। আফসোস হল, সেই সময়কার ভোমরাগুলো তাকে অবিরাম হুল ফুটিয়ে আগাগোড়া জীবন বিষিয়ে তুলেছিলেন।

মাতা কুসুমকুমারী দাশ চেয়েছিলেন ছেলে ব্রাহ্মণ সমাজহিতৈষীদের নিয়ে ভক্তিমূলক কবিতা লিখবেন। বাবা চাইতেন ছেলে শিক্ষিত হয়ে ঘরের হাল ধরবেন। পড়ালেখা শেষ করে জীবনানন্দ দাশ অধ্যাপনা করলেও ছিলেন সাহিত্যের মানুষ। বিশেষত কবিতার মানুষ। শুরুটা ভক্তিমূলক হলেও অচিরেই জীবনানন্দ পথ চিনে গিয়েছিলেন নিজেই। ফলে বাংলা সাহিত্যে কবিতার সম্ভারে উজ্জ্বল তারাগুলো জীবনানন্দের।

এ পথ এতই কঠিন ছিল যা ভাবা অসম্ভব। অধ্যাপনার চাকুরীতে মনোনিবেশ না করা, চাকুরী ছেড়ে নতুন চাকুরী নেওয়া, তাও ভালো না লাগা, সহযোগীদের অসহযোগিতা করা ও কবিতার নিন্দনীয় ব্যবচ্ছেদ ; জীবনানন্দ দাশ শান্তি খুঁজে পান নি। নাটোরের বনলতা সেনের কাছে তিনি কিছু পেয়েছিলেন, নাকি এটাও উনার রহস্যজালিকার এক ঐশ্বরিক সৃষ্টি মাত্র তা জানা নেই। যদিও আকবর আলী খানের এ নিয়ে বিস্তর ঘাটাঘাটি নতুন তথ্যের যোগান দিতে পারে।

জীবনানন্দ দাশ এক জীবনে অর্থাৎ ৫৫ বছরের জীবনে যা অবহেলা, লাঞ্ছনা ও অপবাদ পেয়েছিলেন তা অন্য কোন সাহিত্যিক সয়েছেন কিনা জানা নেই। যে কোন কবিতা ছাপা হলেই একেবারে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেই সময়কার অনেক অ-কবি তার উল্টো যুক্তি সহকারে যা লিখতেন তাতে জীবনানন্দ বোধহয় লিখেছেন ; সব কবিই কবি নয়। কিন্তু নিজের টাকা দিয়ে বই ছাপিয়ে কোন সাহিত্যিকের আনুকূল্য না মেলা, স্ত্রী কল্যাণীর সীমাহীন দু:খে পতিত হওয়া ও স্ত্রীর সাথে বলতে গেলে সম্পর্ক থেকেও না থাকার অবস্থা জীবনানন্দের ভুগতে হয়েছিল।

বরিশালে থাকতে চেয়েও কলকাতার দিকে চলে যাওয়া জীবনানন্দের জীবনে নিদারুণ দুর্ভোগ বয়ে এনেছিল। ভাইয়ের বাড়ীতে উঠলেও বেকারত্ব তাকে অস্থিরতায় ফেলে দিয়েছিল। সে সময়ে বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্য আরও দু'এক জনের বদান্যতা পেয়ে যে জীবন পার করেছিলেন তা নিতান্তই অপমানজনক।

চাকুরী কিংবা যে কোন কিছু একটা করে খেতে চাওয়া জীবনানন্দের গতি হয় নি। উল্টো এক গভীর বিষাদে নিজেকে নিয়ে দুর্ভাবনার অন্ত ছিল না। এদিকে বেকার জীবন, স্ত্রী কল্যাণীর মান অভিমান আবার কলকাতার নতুন জীবনে বেশ বেকায়দায় ছিলেন । যা তাকে লিখিয়েছে উপন্যাস অনেকগুলো। কিন্তু ট্রাংকে ভরে রেখেছিলেন। এমন অনেক কবিতাও ছিল। তার উপন্যাস মূলত যাপিত জীবনের ডায়েরী। সমাজ, মানুষ, পরিবেশ ও বিশ্বের নানা কথা লেখায় এসেছে। যা তাকে ভীষণ কষ্ট দিয়ে দিয়ে নি:শেষ করেছে।

জীবনানন্দ দাশ নীরবে লিখতে চেয়েছেন। লিখে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সময়কার কবি কিংবা কবিতার নামে ভাঁড়ামো করা লোকেরা তা শান্তিতে করতে দেয় নি। বলা যায় জোট করেই তারা জীবনানন্দের বিরোধিতা করেছিল। অথচ সেই জীবনানন্দের নাম আজ অবধি অবাধ বিচরণ করছে। আর যারা বিরোধিতার নামে তাকে রুখে দিতে চেয়েছিল তা বিস্মৃত।

বরিশাল ছেড়ে গ্যালেও বরিশালের দারুণ দিনগুলো জীবনানন্দ কখনোই ভুলেন নি। একবার এই বাংলা থেকে শামসুর রাহমান ও কায়সুল হক জীবনানন্দের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। এমন আন্তরিকতা ও ভালোবাসা কবি দেখিয়েছিলেন তা রীতিমতো অভাবনীয়। অথচ বসার মত চেয়ার ও ছিল না কবির।

এখানে আরও একটা প্রাসঙ্গিকতা আছে, যা জীবনানন্দ বুকে ধারণ করেছেন আজীবন। পূর্ব বাংলায় ভাষা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হলে জীবনানন্দের কলম থেমে ছিল না। তিনি প্রবন্ধ লিখে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে লিখেছিলেন। একেবারে যুক্তি ও ভালোবাসার নিরিখে তিনি নিজ ভাষার দুরূহ সময়ে ব্যথিত হয়েছিলেন। বস্তুত, জীবনানন্দের কলকাতা যাওয়ার কোন ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু ভাগ্য তাকে ট্রামের দেশে নিয়ে গিয়েছিল।

জীবন যাপনের এ-ধার ও-ধারে ক্লান্ত হয়ে জীবনানন্দ দাশ তখন দিনাতিপাত করছিলেন ফড়িঙ হয়ে। কোনখানে খুব একটা সুবিধে করতে না পেরে আক্ষরিক অর্থেই তখন জীবনানন্দের শনি চলমান। কল্যাণীরা স্কুল মাস্টারি ও কবির টিউশনি, এ দুই মিলিয়ে টানাপোড়নের সংসার। সন্তানেরা কোন রকমে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। এসবের মধ্যে ধারদেনা চলছিল। সঞ্জয়, অচিন্ত্যকুমার, বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রীর কাছে যখনতখন পৌঁছে যেতেন কবি। এবং উনারাও কখনোই না করেন নি কবিকে। উল্টো বলতেন, আপনাকে দেখে রাখা আমাদের দায়িত্ব। এ নিয়ে কোন চিন্তা করবেন না।

জীবনানন্দের একা হওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। একা মানে নির্জনে বসে লেখা। শুধুই লেখা। এটা নিয়ে এত সিরিয়াস ছিলেন, যে তিনি কয়েকজনকে নিয়ে একটা জমি সহ দেখে আসছিলেন। জীবনানন্দের খুব ইচ্ছে, এমন একটা ঘর থাকবে, যেটা ঘিরে থাকবে ঘুঘু আর শালিক। অশ্বত্থ গাছ আর পেঁচা তাকিয়ে থাকবে বিপন্ন বিস্ময়ে। জীবনানন্দের হয়ে তারা গান গাইবে গলা ছেড়ে । তারা বন্ধু হয়ে চলবে আপন সঙোপনে।

জীবনানন্দের চলে যাওয়ার বছর দু'এক আগে আশপাশের পরিবেশ আমূল পরিবর্তন এসেছিল। এমনকি প্রথমবারের মতন পুরষ্কার ও পেয়েছিলেন। এদিক সেদিক থেকে কবিতা পড়ার আমন্ত্রণ ও এসেছিল। অবাক করার বিষয় হল, নির্জনে থাকা কবি সেখানটাই যাচ্ছিলেনও। তাও আবার পরিপাটি হয়ে, উৎসাহের সাথে।

একেবারে শেষ সময়ে এসে জীবনানন্দের মানসিক অস্থিরতা চরমে পৌঁছেছিল। কোথাও কোন এক এক্সিডেন্ট দেখলে কিংবা ভিড় দেখলে বোনের বাসায় হন্য হয়ে আসতো, বলতো এ বাসার সবাই কি ঠিক আছে! এটা একধরনের হ্যালোসিনেশন। যা থেকে কবি বের হতে পারেন নি।

এক নি:স্তব্ধতা নিয়ে একদিন হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। অবশ্য ডায়াবেটিস হওয়ার পর তিনি সুবোধের সাথে নিয়মিত হাঁটতে যেতেন। সেদিন সুবোধ ছিল না, যেদিন ট্রাম জীবনানন্দের শরীর চাপা দিয়েছিল। সঞ্জয়, বোন সুচরিতা ও ডাক্তার নার্সদের অক্লান্ত চেষ্টা সত্ত্বেও কবি জীবনানন্দের শরীর নীল হয়ে গিয়েছিল। বিষাক্ত শরীরে নীল রক্তের করুণ বিষে জীবনানন্দ দাশ বিদায় নিলেন ধূসর পৃথিবী থেকে।

যে প্রশ্নের উত্তর মিলবে না :

জীবনানন্দের বেঁচে থাকার সময় কিংবা আরও গভীরতার দিকে চোখ ফেরালে কবিতা লেখার শুরু থেকে সজনীকান্তদের জন্য তা রীতিমতো দুরূহ হয়ে উঠেছিল। সজনীকান্তরা জোট করে কবি জীবনানন্দের ভেতর থেকে কবিতা ঝেটিয়ে বিদায় করতে চেয়েছিল।

কিন্তু সেই সজনীকান্ত যখন জীবনানন্দের সুহ্নদ সঞ্জয়ের অনুরোধে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন মৃত্যুপথযাত্রী জীবনানন্দের সাথে দেখা করতে তখন ঘোলাটে লাগে। তাহলে কি সজনীকান্তরা জীবনানন্দের ট্রাম? এমনিতেই তারা নৈতিক দায় এড়াতে পারে না। যারা এতগুলো বছর জীবনানন্দের জীবনে ধুতরাফুল ছড়িয়েছিল।

সঞ্জয়কে সজনীকান্ত যখন বলেন : আমি কি বুঝি না জীবনানন্দ কত বড় কবি। তা নাহলে এতবছর তার বিরোধিতা করে আসলাম কেন। মোদ্দাকথা, জীবনানন্দ বড় কবি তা মেনে নিয়েই সজনীকান্তরা ইচ্ছেকরেই জীবনানন্দের জীবন বিষিয়ে তুলেছিল। তারা ভীত ছিল। কবিতার বাঁক বদলের যে রাজা এসে গিয়েছিল তা তারা শুরুতেই বুঝতে সক্ষম হয়েছিল ; মেনে না নিয়ে তারা ষড়যন্ত্র করে গিয়েছিল।

নাটোরের বনলতা সেনের কবি দারুণ স্বরে খুন
হয়ে যায় ধূসর পাণ্ডুলিপিতে
আকাশজুড়ে জীবনানন্দের পরমাত্মা
বিরাজ করে আজও ঘাইহরিণীর চোখজুড়ে
আজও মাতাল রাতে উতলা হয়ে আসে
কবি জীবনানন্দ দাশ ;
বাংলা সাহিত্যে কবিতার বরপুত্র হয়ে।

দোহাই:
জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা : আব্দুল মান্নান সৈয়দ
একজন কমলালেবু - শাহাদুজ্জামান

আপনার মন্তব্য