সামনে সিঁড়িপথ

 প্রকাশিত: ২০১৯-০৩-২৫ ১২:১০:৫১

রেহানা বীথি:

কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, আঁচলটা টেনে মুখটা মুছে নিলো জয়া। মাথা উঁচু করে দেখে নিলো, আর কতটা উপরে উঠতে হবে ওকে। অদ্ভুতভাবে প্যাঁচানো কাঠের সিঁড়িটা ঠিক কত উপরে উঠেছে কে জানে! মরচে পড়া লোহার রেলিং, ভেজা স্যাঁতসেঁতে কাঠের সিঁড়ি। পায়ের চাপে চাপে আর্তনাদ করছে থেকে থেকে। যেন বলছে, যেও না, যেও না উপরে। কিন্তু যেতে যে হবেই ওকে। উপরে আরও আরও উপরে।

এরই মাঝে সন্ধ্যে হয়ে গেলো বুঝি! সিঁড়িপথে আসার আগে দেখেছিলো জয়া, কী ভীষণ সুনসান চারিদিক! থমথমে কালো মেঘ আকাশে। পেঁজা তুলো মেঘগুলো প্রাণপণে সরাতে চাইছিলো সেগুলো। সাদা আর নীল নীল রঙ লেপে দিতে চাইছিলো কালো মেঘের বুকে। পারছিলো না। তখন বোধহয় সকাল, না না, হয়তো দুপুর হবো হবো। আশেপাশে কেউ নেই। কোনো কিছুর সাড়া নেই। চিকন সরু পথ, দু'ধারে জঙ্গল, এঁকেবেঁকে কোথায় চলে গেছে! ও সেপথ ধরেই এগিয়েছিলো। জানে না কেন, কিন্তু এগিয়ে গিয়েছিলো। পথের শেষে কি আছে? কেউ কি আছে ওর প্রতীক্ষায়? দু'বাহু প্রসারিত করে ডাকছে, "এসো... এসো, বিলীন হও। এখন অন্য কিছু নয়, এখন সময় ভালোবাসার। উন্মুক্ত হও, প্রকৃতির মতো হও তুমি, সুপ্রিয় আমার!" কত কাঙাল ও ভালোবাসার। কেউ কখনও টের পেলো না কেন? বোঝাতে পারেনি কাউকেই? কিন্তু কেন?

হঠাৎ ঝোপের ভেতর থেকে একটা কাঠবিড়ালি বেরিয়ে এলো। কয়েক পলক ওর দিকে তাকিয়েই তর তর করে উঠে গেলো একটা সদ্য শেকড় উপড়ে পড়ে যাওয়া গাছে। আশ্রয় চায়? কিন্তু গাছটির নিজেরই তো প্রাণ সংশয়। জয়ার বিষণ্ণ ঠোঁটও হেসে ফেললো একটু।

কতদূর হেঁটে এসেছে জানে না জয়া। অসহ্য গুমোট গরম। কোথা থেকে যেন দোলনচাঁপার গন্ধ ভেসে আসছে। হঠাৎ খেয়াল হলো তার, পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। স্বচ্ছ জলে টইটুম্বুর! ফুটফুটে একটা ছোট্ট মেয়ে ঘাটে পা দুলিয়ে বসে আছে। মনে হলো দোলনচাঁপার গন্ধটা ওর গা থেকেই আসছে। গুনগুন করে কিছু গাইছে কি মেয়েটি? হঠাৎ ওর নাম ধরে কে যেন ডাকলো। আসছি মা.... বলে একছুটে চলে গেলো মেয়েটি। খুব চেনা চেনা কণ্ঠটা যেন! যেন...যেন বহুদিনের চেনা, একেবারে আপনজন! ওর মা-ও তো এমনভাবে ডাকতো ওকে ছোটবেলায়। সেই কত আগের কথা! তারপর সব হারিয়ে গেলো। শৈশব হারিয়ে গেলো, অমন করে ডাকার মানুষজন হারিয়ে গেলো। নিঃস্ব হয়ে গেলো জয়া। হঠাৎ করে ভীষণ তৃষ্ণা পেয়ে গেলো যেন। ফিরে দেখলো পুকুরটা নেই। নেই কেন? ওর যে তৃষ্ণা মেটেনি এখনও। টলটলে পুকুরের জলে হয়তো তা মিটতো। হয়তো!!

কোথাও কেউ নেই। সামনে সুদীর্ঘ সরু পথ। আকাশে থমথমে মেঘ। হাঁটতে হাঁটতে একটা বিশাল মাঠ চোখে পড়লো। দূরে.... অনেক দূরে। তার ওপারে আবছাভাবে একটা গ্রাম, ছবির মতো। অস্থির হয়ে উঠলো ওর মন। পা চালাতে হবে জোরে। ওই গাঁয়ে যেতেই হবে ওকে। ওহ্, এত তৃষ্ণা! এত তৃষ্ণা কেন ওর?

চলতে চলতে মাঠের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে পড়েছে জয়া। হ্যাঁ, ওই তো, দেখা যাচ্ছে ছবির মতো গ্রামটা! এখন আর আবছা নয়, বিকেলের সোনালী আলোয় উদ্ভাসিত, স্পষ্ট। ছায়াঘেরা একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর দেখতে পেলো ও। লকলকে লাউয়ের ডগার ফাঁকে কার যেন একটা মুখ ভেসে উঠলো! খুব চেনা...খুউব চেনা! হয়তো প্রেমের টানে, কিংবা হয়তো ক্ষুধার জ্বালায় ঘর ছেড়েছিলো একটি মেয়ে। কিংবা... কিংবা হয়তো লজ্জায়। কী যে নাম ছিলো ওর? মনে পড়েছে, শাবানী। গফুরের মেয়ে শাবানী। বিলের ধারে যখন ভেসে উঠতো মরা মাছ, পচে গন্ধ ছড়াতো, পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নাকে হাত চাপা দিতো সবাই। তখন শাবানীরা তৎপর সেই পচা মাছ তুলে ঘরে নিয়ে গিয়ে রান্না করতে। তীর্থের কাকের মতো চুলার কাছে বসে থাকতো শাবানীর একবছর পর পর জন্ম নেয়া কয়েক ভাইবোন। ক-ত-দি-ন পর ওরা মাছ খাবে! চাঁদের মতো রূপ, আর ঢলোঢলো যৌবন ছিলো শাবানীর। "গরীবের ঘরে এত রূপ ভালো নয় গো," বলতো অনেকেই। তো সেই শাবানী একটুতেই খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়তো যখন তখন। গাঁয়ের জোয়ান ছেলেদের সাথে সে কী ঢলাঢলি! কখন না জানি কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলে। ঘটেও গেলো। খিলখিল হাসিটা কোথায় হারিয়ে গেলো যেন। পথের ধারে দু'হাতে মাথা চেপে ধরে বমি করতে দেখলো ওকে অনেকেই। গাঁয়ে ঢিঁ ঢিঁ পড়ে গেলো। তারপর.....! কোথায় যেন হারিয়ে গেলো শাবানী। কোথায় আর হারাবে? কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে ওপারের দেশে গিয়ে শরীর বেচে খাচ্ছে। কে যেন দেখেছে ওকে সে দেশে। ফিরে এলে এ গাঁয়ে আর জায়গা হবে না ওই নষ্টা মেয়ের, একমত হয়েছিলো সবাই। তবে? এ গাঁয়ে কেমন করে এলো ও? অমলিন হাসিমুখটা পেলো কোথায় মেয়েটা! একটা শান্তির নীড়? আর এখনও অক্ষত ওর ঢলোঢলো যৌবন? সে যাকগে, একগ্লাস জল চাওয়াই যায়, যাবে কি ওর কাছে? ক্লান্ত জয়া, তৃষ্ণার্ত জয়া হাত বাড়িয়ে ডেকেওছিলো ওকে। কিন্তু... কিন্তু কোথাও কেউ নেই। শুধু একরাশ মিঠেল হাওয়া পরশ বুলিয়ে দিলো ওর সারাগায়ে। আহা...

নতুন করে চোখের সামনে জেগে উঠলো গোধূলিবেলা। কোথা থেকে এলো এ কাঠের দোতলা বাড়ি? থিতিয়ে যাওয়া সূর্যের কমলা আলোয় কেমন যেন ঘোর লেগে গেলো। যেন এ বাড়িটাই খুঁজছিলো জয়া! যেন....যেন ওই স্যাঁতসেঁতে কাঠের সিঁড়ি দিয়েই ওঠার কথা ছিলো ওর। উপরে, অনেক উপরে।

উঠছে জয়া। নড়বড় করছে রেলিং, পড়ে যাবে কি ও? যদি পড়ে যায়, যদি নিভে যায় ও? সিঁড়ি থেকে নীচে তাকিয়ে দেখলো জয়া। মনে হচ্ছে গভীর খাদ। অতল....। পড়ে গেলে কেউ জানতেই পারবে না! কে আছে ওর? কেউ নেই... কেউই নেই! কিন্তু কেন? কেউই কি আসেনি ওর জীবনে? প্রেমিক, বন্ধু কেউ! কেউ কি বলেনি, দোলনচাঁপার গন্ধ পাই তোমার গায়ে? ছেড়ে যেও না কখনও হৃদয়হরণী! বলেছিলো। রিমঝিম বরষায় একসাথে ভিজেছিলো দু'জন। ভেজা কদম খোঁপায় গুঁজে দিয়েছিলো অনেকবার। আকাশের তারা গুণেছিলো একসাথে। এক বুক উষ্ণতা নিয়ে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো, তুমি আমার, শুধুই আমার!

এক টুকরো কাঠ খুলে পড়লো সিঁড়ি থেকে। পড়ে কোথায় হারিয়ে গেলো! কত নীচে পড়লো ওটা? একটা দোতলা বাড়ি, কিন্তু এত উঁচু কেন? শেষ হচ্ছে না তো সিঁড়ি! অন্ধকার হয়ে গেলো যে! এই আধারে কেমন করে উঠবে ও? কেমন করে খুঁজবে ও, যা আছে খোঁজার? সেই যে বৃদ্ধা, ঘোলাটে চশমা, যার একচোখের কাঁচ ফেটে দু'ভাগ, কী যেন খুঁজতো সেই বুড়ি রাতদিন। হাতড়ে হাতড়ে ঘুরে বেড়াতো সারাটা উঠোন। ধানের গোলার ঘুপচিতে, ঢেঁকিঘরের কোণায়, মাধবীলতার ঝোপের কাছে খুঁজেই চলতো সে। চশমাটা পাল্টে দেয়া হয়েছিলো কোনো এক সময়। খাপ খাওয়াতে পারেনি সে তাতে। ঘোলাটে ভাঙ্গা কাঁচের চশমাতেই যেন তার খুঁজে বেড়াতে সুবিধা। হাতড়ে মনমতো কিছু পেয়ে গেলেই মুখের ভাঁজগুলো আরও স্পষ্ট করতেই যেন ফোকলা মুখে জর্দার সুবাস ছড়িয়ে সে কী হাসি! অন্ধকার সয়ে গেছিলো তার। শুধু অন্ধকার কেন? সময়ে সবই সয়ে যায়, ভার কমে হৃদয়ের, হয়তো! গভীর ক্ষত একের পর এক প্রলেপে ঢাকা পড়ে যায়। আমরা বেঁচে থাকি। আমরা রাত্রিদিন মিশে যেতে থাকি অচেনায়।

অপরিচিতের জন্য তৈরি করে নিই নিজেকে। আমরা সুখী হতে চাই।

ঘেমে যাচ্ছে জয়া। ঘাম বাড়ছে, সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ওর তৃষ্ণা। গলা শুকিয়ে কাঠ । ঢোক গিলতে গেলেই খটখটে শুকনো জিহ্বাটা তালুতে গিয়ে ঠেকছে । একটা দমকা কাশির বেগ সামলে নিলো ও বহুকষ্টে। সিঁড়ি বোধহয় আর বেশি বাকি নেই। ছাদের আভাস পাওয়া যাচ্ছে যেন। কোমল জ্যোৎস্না আর উন্মুক্ত আকাশের নীচে জয়ার প্রতীক্ষিত খোলা ছাদ,আহ! তৃষ্ণা মিটবে কি ওখানে? মিটবে....অবশ্যই মিটবে, মিটতেই যে হবে।

প্যাঁচানো সিঁড়িটা আর একবার ঘুরলেই ও পৌঁছে যাবে ছাদে। ক্লান্তি শেষের উত্তেজনায় বেশ একটু ফুরফুরে হয়ে উঠলো জয়া। সিঁড়িপথ শেষ হলো অবশেষে। সামনে তার বিশাল ছাদ। কোজাগরী পূর্ণিমায় ভেসে যাচ্ছে আকাশ। যেন দু'হাত ভরে নিয়ে নেয়া যাবে। কিন্তু এ কী! এই ছাদের মধ্যে আবার ঘর কেন? রূপালী জোছনায় ভাঙ্গাচোরা ঘরটা আকুল হয়ে তাকিয়ে আছে যে জয়ার দিকেই! প্রায় খুলে পড়বে এমন দরজাটার ওপরে একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে দেখা যায়। তাতে খুব অস্পষ্ট হলেও পড়তে পারলো জয়া, লেখা রয়েছে "অচিনপুর ডাকঘর।" ডাকঘর!! এই ছাদের উপর! চাঁদের মায়াবী আলোয় এ কোন মায়ার খেলা! মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ভেতরে ঢুকলো জয়া। কেউ নেই ভেতরে। শুধু বদ্ধখামে কিছু চিঠি ছড়ানো রয়েছে একটা টেবিলে। আর হাজার হাজার জোনাকির আলো ঘরময়। জ্বলছে আর নিভছে। সেই আলোতে দেখতে পেলো জয়া, চিঠিগুলো তারই। তাকেই লিখেছে তার প্রিয়জনেরা। খামের ওপরেই যেন ভেসে উঠলো সেইসব প্রিয়জনের মুখগুলো। চিঠিগুলো বুকে চেপে ধরে আকুল হয়ে কাঁদতে লাগলো জয়া। এত প্রিয়জন আছে ওর! সবাই ভালোবাসে ওকে! তবে কেন ও একা ভাবে নিজেকে? সেই যে ভালোবাসার কথা শুনিয়ে আর মনে রাখেনি যে পুরুষ, তখন থেকেই তো একা ভেবে এসেছে নিজেকে। একটা ছোট্ট গণ্ডীর মধ্যে গুটিয়ে নিয়েছে নিজের ভাবনা চিন্তার জগত। তবু এত চিঠি! এত ব্যাকুলতা সবার!

ভুলে গেলো জয়া সব অভিমান। জমাট বাঁধা কষ্টগুলো গলে গলে পড়লো দু'চোখ বেয়ে। তৃষিত হৃদয় জুড়াবে এবার। ওই তো একটা পাহাড়ি ঝরনা! চিঠিগুলো একটা পাথরের ওপর রেখে ঝরনার নীচে মেলে দিলো নিজেকে। আহ, কী শান্তি! কী অপার্থিব সুখ! তাপিত দেহ, মন শীতল হলো....জুড়িয়ে গেলো যেন! এবার ফেরা যাক। আপনজন রয়েছে যে জয়ার প্রতীক্ষায়! কিন্তু চিঠিগুলো, চিঠিগুলো কই? এদিক ওদিক খুঁজলো ও। নেই, কোথাও নেই।

আবার সেই তৃষ্ণা... গলার কাছটায় শুকনো খটখটে। জল চাই, অনেক জল। কোথায় পাবে সে?

ওই তো, ভীষণ স্বচ্ছ একগ্লাস জল।হাত বাড়িয়ে নিতে গিয়ে কিসে যেন বেধে গিয়ে হোঁচট খেলো ও। উফ...! ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। জানালার ফাঁক দিয়ে ভোরের আলো এসে পড়েছে ঘরে। সেই তার একলা ঘর, সেই একাকী জয়া। কলিংবেল বাজছে। কে এলো এই সকালে?

আপনার মন্তব্য