সমুদ্র জাগছে দূরে

 প্রকাশিত: ২০১৯-০৯-০৬ ০১:৪৪:৪৩

 আপডেট: ২০১৯-০৯-০৬ ০১:৪৬:১০

তুষার গায়েন:

বালি, এইখানে বালি, সাদা ধু ধু বালিয়াড়ি
আকাশ গড়িয়ে নামে আলো চন্দ্রাহত
জ্যোৎস্না মাড়ানো পর্যটক পায়ে পায়ে
দূরে জাগছে সমুদ্র নৈঃশব্দের গায়ে এঁকে
গম্ভীর শঙ্খের ধ্বনি, দুপুরে ভাটার টানে
হঠাৎ উধাও জল, বালির পাঁজর ফুঁড়ে
উন্মোচিত শূন্য চরাচর এখন উঠছে ফুঁসে
গর গর রাগে জল, প্ৰভূত সঞ্চিত হলে দারুণ বিক্রমে
সবাইকে অপ্রস্তুত ক'রে নিমিষে ঝাঁপিয়ে পড়ে
ঢেউয়ের তাড়া খেয়ে সোল্লাসে পালাচ্ছি দূরে
গর্জন হুঙ্কারে আছড়ে পড়ে জল সমুদ্রের তীরে
সাদা সিল্কের মতো বালি জলে ডুবে বিমর্ষ ছাইরং
মুহূর্তেই শুষে নিয়ে হেসে ওঠে ধবধবে চাঁদের আলোয়

ধাওয়া করে আসে ঢেউ ধু ধু জল পরিসর হতে
দিগন্ত মোড়ানো সাদা ফণার বিক্রম
আছড়ে ঝাপটে পড়ে মূহুর্মূহু বৃত্তচাপ,
নিমিষেই নিঃশেষিত জলের উচ্ছ্বাস
ফুটে ওঠে ফের স্ফূৰ্তিময় গোলাকার ঢেউ
অনিঃশেষ প্রবাহের ইচ্ছাময়ী কেউ
নৃত্যরত চক্রাকারে অতল আধার --
আয় ঢেউ, আয় উর্মিমালা
কতটুকু নিতে পারি তোকে
দু'হাতে জাপটে ধরে বুকের খাঁচায়
দুরন্ত ঝাঁপিয়ে পড়া তোর বার বার
এই বুক, এই পিঠ ব্যথা হয়ে যায়
জলের ধাক্কায় ডুবে গিয়ে শ্বাসরোধী
লোনা জল জিহ্বার ডগায়, ঝাপ্টা মেরে জেগে উঠি
বুক-সমান জলের নাব্যতায় -- আয় ঢেউ, আয় উর্মিমালা
আমার অন্তর ধুয়ে নিয়ে যা সকল জ্বালা তোর জলে ...

আয়, আয় উর্মিমালা টলমল জলের দু'ধারে উঁচু পাহাড়ের ঢেউ, দূরে
দৃষ্টির দূরত্বে নীল টেকনাফ থেকে টেনে নেয় নাফ নদী--
মাথার উপরে গাংচিল ওড়ে অনর্গল মনুষ্য শিশুর কণ্ঠে কলকল
ধু ধু বঙ্গোপসাগর বার্তা পাঠায় উত্তাল ঢেউয়ের-- দুরু দুরু দোলে লঞ্চ
পাটাতনে দাঁড়াবার উদাসীন ভাব হঠাৎ হোঁচটে কাটে, নাগালেই লঞ্চের রেলিঙ ...
ওপার পাহাড় থেকে যারা ঝাঁপ দিল জলে, আগুনের শিখা থেকে
বাঁচাতে নিজেকে ও স্বজন-পরিজন, বাঁকা নৌকার গলুই যতটা নাচতে পারে
ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে থেকে বিপদ-সঙ্কুল, বিপন্ন রোহিঙ্গাকূল ভেসে আসে
কান্নার দমকে ঢেউ আরো বাড়ে সমুদ্দুর জুড়ে, লেলিহান আগুনের শিখা
জলের উপর গাঢ় লালের প্রলেপ; নিঃসীম আকাশে কালো ধোঁয়া
এই টানা জলস্রোত দু'ধারের পাহাড় ছুঁয়ে ঐকতানে যেভাবে চলেছে দূরে
বিবিধ পাতার গাছ, অসম উচ্চতা নিয়ে পাহাড় শোভিত রাখে মৌন পাহাড়ি-স্বভাব
মানুষেরা ভালোবাসে কলহ বিবাদ; মিথোজীবিতার স্বাদ নিতে অপারগ
উন্মত্ত জেহাদ আর বিস্মৃত বুদ্ধের বাণী কাঁদে বনের ভিতর!

মাথার উপর ওড়ে গাঙচিল, মানুষের ছুঁড়ে দেয়া বাতাসে খাদ্যের কণা
দারুণ ক্ষিপ্রতা নিয়ে খপ করে ধরে, জলে ঝাঁপ দিয়ে মাছ শিকারের চেয়ে
অনায়াস আহারের আনন্দে প্রলুব্ধ পাখি, পাড়ি দিয়ে আসে
সমস্ত তরঙ্গ পথ-- সেইন্ট মার্টিন
এখানে প্রবাল দ্বীপ, সূর্য, বালি
পড়ে থাকি নারকেল বীথির শেকড় ছুঁয়ে
শত কোটি বছরের ঘূর্ণাবর্তে জড়িয়ে পেঁচিয়ে প্রবালের দলা
জমে গিয়ে কঠিন শিলার পিণ্ড -- শীতে, সূর্যতাপে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো বালি
ঝিকমিক বালিয়াড়ি, মাইল মাইল মনুষ্যবিহীন, তারামাছ, কাঁকড়ার মেলা
এবং যেখানে মানুষ -- কিছু মৎস্যজীবী দুরন্ত সাগরে হানা দেয়
জীবন তরঙ্গে খেলে জুয়া, যে প্রাণ স্পর্ধিত হয়ে ওঠে সাগরের উত্তুঙ্গ ফেনায়
তা রেখে কে যায় নিস্তরঙ্গ জীবন খাঁচায়? কড়কড়ে সূর্যতাপে শুটকির মেলা
ছড়ায় আঁশটে গন্ধ; তাজা মাছ মশলা মাখানো গামলায়, ফর ফর ভাজা
হতে থাকে ডুবো তেলে, পর্যটক জিহ্বার আস্বাদে মেলে কিছু কাঁচা টাকা
এখানে ওখানে দু'একটা কিশোরী হাতে নিয়ে ছোট ছোট কড়ি, ঝিনুকের মালা
কাছে আসে, "আহ! লাগবে না, যাহ না!" বলতেই ঝর ঝর করে দেয় ফেলে কড়ি
ঝিনুক আমার করতলে, "আপনারে স্যার, ভালো লাগছে আমার
এমনি দিলাম, লাগবে না টাকা!" সবিস্ময়ে হার মানি বিক্রয়-কৌশল দেখে ওর
সস্নেহে পকেট থেকে হাতে তুলে দেই দশখানি টাকা।

যেই প্রবাহের টান এতদূর নিয়ে আসে সীমান্ত রেখায়
সেই প্রবাহের বিপরীত টানে ফিরে ফিরে যাওয়া ...

আপনার মন্তব্য