প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বইমেলা

গত বছর থেকে এই বইমেলাটিকে বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ থেকে সম্প্রসারিত করে পার্শ্ববর্তী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিস্তৃত করা হয়েছে। দুটি ভিন্ন জায়গায় মেলা আয়োজনের ফলে দেখা দিয়েছে নানা অসঙ্গতি। সেইসঙ্গে নানা অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতা চোখে পড়ে মেলাকে ঘিরে। আর এর সবচেয়ে বড় শিকার হয় লেখক, পাঠক, প্রকাশকরা

 প্রকাশিত: ২০১৫-০১-২৫ ২০:৫৪:২৭

 আপডেট: ২০১৭-০৮-১৬ ১৮:৪২:০১

অঞ্জন আচার্য :

পহেলা বৈশাখের পর বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক উৎসব হলো অমর একুশে গ্রন্থমেলা। এ মেলাকে ঘিরে তাই লেখক, পাঠক, প্রকাশকসহ নানা শ্রেণী-পেশা-বয়সী মানুষেরই উৎসাহের কমতি থাকে না। সারা বছরেই আনন্দ, উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে চলে তার প্রস্তুতিপর্ব। প্রাণের এই মেলাকে মনের রঙে রাঙাতে থাকে নানা আশা, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, প্রত্যাশা। তবে আশার পাশাপাশি থাকে আশাভঙ্গের মতো ঘটনাও। তবুও আশায় বুক বাঁধে মানুষ। বাঙালীর প্রাণের মিলন কেন্দ্রকে নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরিয়ে তুলতে চায় সবাই। এদিকে গত বছর থেকে এই বইমেলাটিকে বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ থেকে সম্প্রসারিত করে পার্শ্ববর্তী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিস্তৃত করা হয়েছে। দুটি ভিন্ন জায়গায় মেলা আয়োজনের ফলে দেখা দিয়েছে নানা অসঙ্গতি। সেইসঙ্গে নানা অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতা চোখে পড়ে মেলাকে ঘিরে। আর এর সবচেয়ে বড় শিকার হয় লেখক, পাঠক, প্রকাশকরা। যার প্রভাব পড়ে কমবেশি সবার ওপরই। আগেরবারের লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে জ্ঞান নিয়ে কিভাবে এবারের মেলাকে আরও বেশি সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত করা যায়, তা-ই উঠে এসেছে প্রকাশকদের সাথে আলাপ করে। পাশাপাশি দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে শঙ্কাও প্রকাশ পেয়েছে তাঁদের কণ্ঠে।

বইমেলা প্রসঙ্গে শুরুতেই কথা হয় সাহিত্য প্রকাশ-এর স্বত্বাধিকারী মফিদুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, বইমেলা যেন হুজুগে ঘটনায় পরিণত না হয়, বরং হয়ে ওঠে গ্রন্থসংস্কৃতির বিকাশের অবলম্বন, এটাই তো প্রত্যাশা। সেক্ষেত্রে কেবল বইসংক্রান্ত মামুলি তথ্যপ্রচারের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের বিষয়বস্তুর মূল্যায়ন। ভাল বইয়ের কদর যেন মিলে বইমেলায়, তেমনটাই কাম্য।

এদিকে অনন্যা প্রকাশনীর কর্ণধার মনিরুল হকের প্রত্যাশা একটু অন্যরকম। তিনি বলেন, আসছে বইমেলাটি নতুন আঙ্গিকে হোক, তাই চাই। মেলায় প্যাভিলিয়ন হচ্ছে। এটা একটা ইতিবাচক দিক। এতে করে মেলার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে। তবে পাঠক যেন যথাযথভাবে বইয়ের তথ্য পায় সেদিকে নজর দিতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। সেই সঙ্গে মেলায় পরিপূর্ণ ডিজিটাল সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাশা করছি। দেশে শান্তিশৃঙ্খলা স্বাভাবিক থাকলে মেলাটি হয়ে উঠবে আনন্দময়। তাই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান, তারা যেন মেলার সময় হরতাল-অবরোধ থেকে বিরত থাকে।

একই রকম প্রত্যাশা রাখেন সময় প্রকাশন-এর স্বত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদ। তাঁর বক্তব্য, আসছে বইমেলাটি সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে কাটুক তেমনটাই আগাম প্রত্যাশা করছি। কোনবারের মেলার সঙ্গেই অন্যবারের মেলাকে তুলনা করি না। তারপরেও তো আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকেই। গতবারে যা হয়েছে, তারচেয়ে ভাল হোক এবারের মেলা। এ বিষয়ে মাসখানেক আগে সৃজনশীল প্রকাশকদের পক্ষ থেকে মেলা কর্তৃপক্ষের কাছে দীর্ঘ একটি সুপারিশমালা পেশ করা হয়েছে। সেই অনুযায়ী কাজ করলে আশা করি কোন সমস্যা হবে না।

কিন্তু মেলা নিয়ে শ্রাবণ প্রকাশন-এর প্রকাশক রবীন আহসানের কণ্ঠে শোনা গেল প্রতিবাদী স্বর। তাঁর মতে, বইমেলা বাংলা একাডেমি থেকে প্রসারিত করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নেয়া হয়েছে। তাতে করে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা পরিলক্ষিত হয়নি। বইমেলাকে মনে হয়েছে গরুর হাটের মতো। দেখা গেছে নান্দনিকতার চরম অভাব। মেলার স্টলগুলো সুসজ্জিত থাকবে, পরিবারের মানুষদের নিয়ে সেখানে ঘোরাফেরা করবে, ধুলাবালি থাকবে না- এমনটাই প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সেই আশার কিছু মেলেনি। মেলার ভেতর আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মীদের যে মিলনমেলা ছিল তা মেলা প্রাঙ্গণ ভাগের ফলে বিনষ্ট হয়েছে। প্রকাশকদের একাংশের চক্রান্তের কারণে এমনটা হয়েছে। বইমেলা কেবলই বাণিজ্যিক মেলা নয়। এর বহুমাত্রিক রূপ রয়েছে। একুশে বইমেলা এখন আমাদের একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে। তবে দিনে দিনে এটি কর্পোরেট রূপ দিতে চাচ্ছে একদল স্বার্থান্বেষী মহল। এই আগ্রাসন প্রতিহত করতে হবে। মেলার স্বকীয়তা বজায় রেখে তা প্রাণের মেলায় পরিণত করতে হবে একযোগে সবাইকে।

আশাভঙ্গের স্বরে অনিন্দ্য প্রকাশ-এর প্রকাশক আফজাল হোসেন বলেন, প্রতিবছরই বইমেলা যেমনটা চাই, তেমনটা হয় না। বই প্রকাশনা থেকে শুরু করে মেলার আয়োজন একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মধ্যে হোক, এমনটাই প্রত্যাশা থাকে। এই যেমন গতবারের মেলাই কথা ধরা যাক। অপরিকল্পিক আয়োজনের ফলে মেলায় বেশ কিছু সমস্যা দেখা গেছে। বিশেষ করে মেলার প্রবেশ পথে। আমি চাই এবার দুই থেকে তিনটি প্রবেশ পথ হোক। মেলার প্যাভিলিয়নটি প্রাঙ্গণের চারদিক ব্লক করে এর মধ্যে করা হলে ভাল হবে। তাছাড়া মেলার মাঠে হাঁটাচলা করার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা রাখতে হবে। তার ফাঁকে ফাঁকে বসার সুব্যবস্থা রাখতে হবে, যেন পাঠকরা সেখানে বসে আড্ডা দিতে পারে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা সম্প্রসারিত হয়েছে, এটা ভাল দিক। তবে সেখানে যে পরিমাণ ধুলা ছিল, তাতে করে সবারই দারুণ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। এছাড়া অপর্যাপ্ত খাবার পানি, টয়লেট ব্যবস্থা ছিল। যে কোন কর্পোরেট কোম্পানিকে বললে তারা অনায়াসে মেলায় আগতদের জন্য বিনামূল্যে পানি সরবরাহ করতে পারে। অন্যদিকে মেলার গেটের বাইরে সারি সারি খাবারের দোকান বেশ সমস্যা সৃষ্টি করে। আমি মনে করি, এ বিষয়গুলো মেলা আয়োজন কর্তৃপক্ষ আন্তরিক দৃষ্টিতে দেখবেন। আমার মতে, মেলার আয়োজন যদি প্রকাশকদের হাতে তুলে দেয়া হয় তবে তা বিশ্বমানের করা সম্ভব। কিন্তু বাংলা একাডেমি এ ব্যাপারে ছাড় দিচ্ছে না।

শুদ্ধস্বর-এর স্বত্বাধিকারী আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল একটু ভিন্ন। তাঁর মতে, বইমেলার সময় ছাড়াও গণমাধ্যমগুলো বই এবং প্রকাশনাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে এবং এর প্রচার ও প্রসারে যা যা করা দরকার তা সামাজিক দায়বদ্ধতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পালন করবে। গণমাধ্যম ও সৃজনশীল প্রকাশনা পাশাপাশি হতে যাওয়া সাম্রাজ্য এবং কুটিরশিল্প। সেই জায়গা থেকে প্রকাশনাকে বিকশিত করার জন্য গণমাধ্যমের ভূমিকা থাকা উচিত। আমি মনে করি, একটা বই একজন মানুষকে যেভাবে শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান, রুচিশীল এবং দায়িত্বশীল মানুষে পরিণত করতে পারে তা আর কোন মাধ্যম পারে না। দ্বিতীয়ত শুধুমাত্র বইমেলাকেন্দ্রিক যে প্রকাশনার যজ্ঞোৎসবের সংস্কৃতি আমরা গড়ে তুলেছি তা থেকে বেরুতে না পারলে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের পরিপূর্ণ বিকাশ কখনোই সম্ভব নয়। তাছাড়া বই প্রকাশনা বা প্রকাশক হওয়ার জন্য কিছু নির্দিষ্ট নীতিমালা অবশ্যই থাকা দরকার, যেন বই প্রকাশনা, প্রকাশনা শিল্প হাস্যকর ব্যাপারে পরিণত না হয়। বইমেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একুশে বইমেলা আমাদের একটা ঐতিহ্যের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই ঐহিত্যকে সারাদেশ ও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার যে উদ্যোগ নেয়া দরকার তা কর্তৃপক্ষ করছে বলে আমি মনে করি না। মেলার আয়োজনে একটা সাজ সাজ রব থাকা সত্ত্বেও কোথাও যেন একটা অবহেলা পরিলক্ষিত হয়। প্রকাশনার শুরু থেকে আমি, অর্থাৎ ১১ বছর ধরে কর্তৃপক্ষের কাছে বিভিন্ন বিষয় প্রত্যাশা করে আসছি, যার অধিকাংশই পূরণ হয় না। মেলা প্রাঙ্গণে স্টল বানানো মজবুত হয় না। যার ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে সেগুলো। তাছাড়া বৃষ্টি হলে মাঠ কাদামাটিতে ভড়ে ওঠে। এর জন্য আগে থেকেই ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। তাছাড়া মেলায় প্রবেশ-প্রস্থানের ব্যবস্থা যেন সুন্দর হয়। গতবছর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত মেলায় এক গেট দিয়েই প্রবেশ ও বের হওয়ার রাস্তা রাখা হয়েছিল। যার ফলে অনেক নারী অপদস্থ হয়েছেন। এমন অপ্রীতিকর ঘটনা যেন আর না ঘটে সে ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। মেলায় আসা-যাওয়ার জন্য যা যা করণীয় আয়োজকের পক্ষ থেকে তা-ই করা উচিত বলে মনে করি।
 
ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ-এর প্রকাশক জয়নাল আবেদীন জুয়েল বলেন, আমি মনে করি বইমেলায় সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে রেখে সৃজনশীল প্রকাশনাগুলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রাখা উচিত। আর শিশুদের স্টলগুলো রাখতে হবে সোহরাওয়ার্দী মাঠে। কারণ গতবার শিশুদের স্টলগুলো আলাদা করার ফলে অনেক প্রকাশনা সংস্থা ক্ষতির শিকার হয়েছে। এছাড়া মেলায় টয়লেট সমস্যা দূর করতে হবে। প্রবেশ পথ সুন্দর ও সুশৃঙ্খল রাখা অবশ্যই জরুরী। এক্ষেত্রে আমরা প্রতিবারেই বলে আসছি, মেলার আয়োজন প্রকাশকদের হাতে ছেড়ে দিতে। কিন্তু বাংলা একাডেমি তা করতে চায় না। তারা তাদের কর্তৃত্ব হারানোর ভয়ে আয়োজনটি নিজেদের কাছে রেখেছে। অন্যদিকে মেলার বইরে পাইরেসি বইয়ের সে পসরা বসে তা শক্ত হাতে প্রতিহত করতে হবে। এর ফলে আমরা যারা সৃজনশীল ও মানসম্মত বই প্রকাশ করি, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এছাড়া সোহরাওয়ার্দী মাঠের মাঝখানেই প্রতিদিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মূলমঞ্চ রাখার আহ্বান করছি।

তবে জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন আশাহত কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, আয়োজন তো প্রায় শেষ, এখন আর মন্তব্য করে কী-ইবা লাভ হবে? তারপরেও কিছু কথা থাকে। প্রতিবারই বইমেলায় প্রকাশকদের জন্য প্রতি ইউনিট স্টল বরাদ্দ থাকে ছয় ফুট/আট ফুট করে। সে সময় মেলাটি কেবল আয়োজিত হতো বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। তখন স্থান সঙ্কুলান হতো না। এখন সেটি সোহরাওয়ার্দী মাঠ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু গতবারের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, দুই জায়গায় মেলা হওয়াতে পাঠকরা বিভ্রান্ত হয়েছে। কেউ কেউ অভ্যাসবশত বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ঘুরে কাঙ্খিত স্টল না পেয়ে ফিরে গেছেন। এর ফলে আমাদের বিক্রিতে দারুণ প্রভাব ফেলেছে। তাছাড়া সোহরাওয়ার্দী মাঠে মেলার প্রবেশমুখে বিভিন্ন খাবারের দোকান সৌন্দর্য নষ্ট করে। বই কিনতে আসা পাঠককে দোকানদাররা টানাটানি করে, যা খুবই অপ্রীতিকর। খাবারের দোকান যদি রাখতেই হয় তবে তা মেলার ভেতরের কোন এক জায়গায় রাখা যেতে পারে।

রোদেলা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী রিয়াজ খান বলেন, গত বছর শিশুদের স্টলগুলোকে রাখা হয় বাংলা একাডেমির ভেতরেই। এতে করে শিশুরা অভিভাবকদের নিয়ে বাংলা একাডেমি চত্বর ঘুরে চলে গেছে। আমরা যারা বড়দের বইয়ের পাশাপাশি শিশুদের বইও প্রকাশ করি, তারা এতে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। তাই এ ব্যাপারে গণমাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাধ্যমে মেলার পূর্ণাঙ্গ তথ্য পরিবেশনের বিষয়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা আশা করছি। তাছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটের সামনে এমন কিছু রাখা উচিত যাতে করে বাইরে থেকে দেখে যে কোন মানুষই বুঝতে পারেন যে, ভেতরে একটি মেলা হচ্ছে; যা আগের বছর ছিল না। আমি চাই, বইমেলাটি যেন পরিণত হয় সত্যিকারের প্রকাশকদের মেলায়। মেলা প্রাঙ্গণ যেন থাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সেই সঙ্গে খাবারের পানি ও পয়ঃনিষ্কাষণের জন্য যেন সুব্যবস্থা থাকে। এছাড়া যেটা জরুরী, তাহলো প্রবেশ ও বহির্গমন পথ আলাদা রাখতে হবে। আর বিশেষভাবে প্রত্যাশা করছি মেলা চলাকালে যেন দেশের রাজনীতি স্থিতিশীল থাকে। মেলাকে হরতাল বা অবরোধমুক্ত রাখার আহ্বান করছি।

অন্যদিকে অন্বেষা প্রকাশন-এর স্বত্বাধিকারী শাহাদাত হোসেন বলেন, একুশে বইমেলাকে ঘিরে আমাদের স্বপ্ন থাকে বেশি। তবে সব স্বপ্ন বাস্তবায়নও হয় না। গতবার মেলা স্থানান্তরিত করার ফলে সাময়িক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ঘাটতি দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি। আশা করছি মেলা-কর্তৃপক্ষ তা কাটিয়ে উঠবে এবার।

অন্যদিকে সংহতি প্রকাশনীর পরিচালক ফিরোজ আহমেদ অনেকটা খেদের সাথে বলেন, দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এই বইমেলাকে ঘিরে থাকে নানা অনিয়ম। মেলায় নতুন প্রকাশনীর স্থান বরাদ্দে ব্যাপক অনিয়ম আছে। তাছাড়া দেখা যায় মানহীন বই প্রকাশের হিড়িক। যারা ভালো বই প্রকাশ করে, তারা মূল্যায়িত হয় না। উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন পড়ুয়া প্রকাশনীর কথা। তাঁর মতে, এই প্রকাশনাটি বাংলাদেশের প্রায় সব লেখকের মানসম্মত বই প্রকাশ করেছে। তাদেরকে দেয়া হয় মাত্র সিঙ্গেল স্টল। অথচ বইয়ের নামে আবর্জনা প্রকাশ করেও অনেকে ডবল-ট্রিপল স্টল নিয়ে বসে থাকে। প্রকাশক সমিতির একশ্রেণীর কায়েমী গোষ্ঠী রাজনৈতিক ক্ষমতা দেখিয়ে এ সুযোগটা নিয়ে থাকে। এসব কারণে বাংলা একাডেমিকে মননশীল বইয়ের পৃষ্ঠপোষক বলে মনে হয় না। এদিকে সরকারী টেক্সের কারণে এবার কাগজের দাম ভয়াবহ চড়া। তারপরেও অন্য পণ্যের চেয়ে বইয়ের মূল্য কম। আমি চাই, মেলা হবে উচ্ছল, প্রাণবন্ত। এখানে পাঠকরা ঘুরবে ফিরবে, বসে আড্ডা দেবে, বই কিনবে।

নালন্দা প্রকাশনীর প্রকাশক ও প্রধান নির্বাহী রেদওয়ানুর রহমান জুয়েল বলেন, আমরা চাই এ বছর অনেক বড় পরিসরে এই মেলা হোক। আমরা চাই প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে যাতে সহজে মানুষ মেলায় প্রবেশ করতে পারে এবং সহজে মেলা থেকে বের হয়ে যেতে পারে। চাই মেলায় সুন্দর সুন্দর কর্নার গড়ে উঠুক। চাই শিশুদের জন্য একটি সাজানো গোছানো জায়গা। আমরা চাই কোন অবস্থাতেই যেন মেলা দু’ভাগে ভাগ না হয়। এটা আমাদের এ বছরের সবচেয়ে বড় দাবি। বইমেলায় একটি ফুডকোড থাকা জরুরী। এছাড়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পর্যাপ্ত পয়ঃনিষ্কাষণের ব্যবস্থা রাখা। মেলার পরিবেশ থাকা চাই খোলামেলা, অর্থাৎ প্রতিটি কোণায় পর্যাপ্ত জায়গার ব্যবস্থা রাখা। সবচেয়ে বেশি দরকার কোন সারিতে কী কী প্রকাশনার স্টল রয়েছে তা নাম লিখে তীর চিহ্ন দিয়ে বোর্ডে লিখে দেয়া- তাহলে পাঠকরা সহজেই তার মনের মতো করে ঘুরে ফিরে বই কিনতে পারবে। আমরা চাই কারও কাছ থেকে স্পন্সরশিপ নিয়ে মেলায় ফ্রি পানি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হোক। সর্বোপরি আমরা আশা করি এ বছর বইমেলা কর্তৃপক্ষ মেলার প্রবেশ পথে একটি কাউন্টিং মেশিন স্থাপন করুক- তাহলে আমরা মেলা শেষে জানতে পারব কতজন পাঠক মেলায় প্রবেশ করেছিল।

প্রকৃতি’র প্রকাশক কবি সৈকত হাবিব বলেন, একুশে বইমেলার সঙ্গে বাঙালীর ভাষাচেতনা জড়িত। তাই একজন লেখক ও প্রকাশক হিসেবে এর কাছে আমাদের প্রত্যাশাও অনেক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা ভাষার জন্য আত্মত্যাগ করলেও এখনও অধিকাংশই ‘ভুল’ বানানটিও ভুলভাবে লিখি। আমাদের মধ্যে যারা একটু ইংরেজী-বিদ্যা জানি, তারা কতটা বাংলাভাষা কম জানি- এটাকে গর্বের বিষয় করে তুলি। এই যখন বাস্তবতা তখন বাংলা ভাষা-সাহিত্যের শুদ্ধতম প্রসার অত্যন্ত জরুরী। এক্ষেত্রে একুশে বইমেলা একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তাঁর মতে, বাংলা একাডেমি ভাষাচেতনার প্রতিষ্ঠান এবং একুশে বইমেলার কর্তৃত্বকারী প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত মানসম্পন্ন বই নিয়ে একটি পূর্ণ বইমেলার স্বপ্ন অপূরণীয় রয়ে গেছে। অথচ একাডেমির নিয়ম-কানুন দেখলে মনে হয় তারা এ ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। কিন্তু বাস্তবে তার দেখা মেলে না। একুশে বইমেলাটি হোক পাঠকদের জন্য আরামদায়ক একটি বইমেলা এবং সত্যিকারের ভাষাপ্রেমের বইমেলা- আপাতত এইটুকুই প্রত্যাশা।

এদিকে মূর্ধন্য প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী সঞ্জয় মজুমদার আবির কণ্ঠে শোনা শঙ্কা। তিনি বলেন, দেশের যে পরিস্থিতি দেখছি তাতে করে বেশ শঙ্কিত আছি মেলা কেমন হবে না-হবে। এই যেমন, কিছুদিন আগে বগুড়ায় অনুষ্ঠিত বইমেলার গেটের সামনে ১০-১২টি বোমা ফাটানো হয়েছে। এ ঘটনার পর সেখানকার পাঠক-দর্শক কমে যায়। এমন যেন কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া এবার মেলার ভেতর স্টলের ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। যদিও প্রতি ইউনিট স্টলের আয়তন কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। আগে স্থান সঙ্কুুলান ছিল না, তাই ইউনিট ছোট ছিল। কিন্তু গতবারের থেকে মেলা সোহরাওয়ার্দীতে প্রসার করা হয়েছে। এখন তো আর জায়গার সমস্যা নেই। তারপরেও ভাড়া বাড়ানোতে আমাদের খরচ বেড়ে গেছে।
 
নতুন প্রকাশনা সংস্থা হিসেবে এবার বেশ কয়েকটি বই প্রকাশ করেছে অনুপ্রাণন প্রকাশন। সংস্থাটির স্বত্বাধিকারী আবু এম ইউসুফ বলেন, বাংলাদেশে গ্রন্থ প্রকাশনা শিল্পটি প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে অনেকে মনে করতে পারেন যে গ্রন্থ প্রকাশনা একটি ভাল লাভজনক ব্যবসা। কিন্তু বিষয়টা কিন্তু ঠিক সেরকম নয়। দেশে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে লেখালেখির জগতে পদার্পণ করছে অনেক প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ। আর বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশের বইমেলাকে ঘিরে গ্রন্থ প্রকাশনার মাধ্যমে তরুণদের আত্মপ্রকাশের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে প্রকাশকরা তাদের ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতা রক্ষা করার স্বার্থেই এগিয়ে আসছেন। এজন্য গ্রন্থ প্রকাশনার সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কিছু নতুন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানেরও এই কারণে জন্ম হচ্ছে প্রতি বছর। তারই ধারাবাহিকতায়ই প্রতি বছরই একুশে বইমেলার পরিসর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বইমেলা আয়োজন করা বাংলা একাডেমির কাজ না। কিন্তু অনেকটা ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের মতো করেই এই দায়িত্বটা কাকতালীয়ভাবে বাংলা একাডেমির ঘাড়ে এসে পড়েছে। যখন ছোট আকারে বইমেলা হতো তখন হয়ত বাংলা একাডেমির পক্ষে সেটা কোনভাবে আয়োজনটা করে ফেলা সম্ভব হতো। কিন্তু এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা সম্প্রসারিত হওয়ার মধ্য দিয়ে মেলার পরিসর বৃদ্ধি পাওয়াতে বাংলা একাডেমির পক্ষে পুরো আয়োজনটা সুষ্ঠুভাবে করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই কারণে কিছু অব্যবস্থাপনা তো আছেই। তাছাড়া মেলার পরিবেশ পরিকল্পনার মধ্যে নেই কোন নান্দনিকতার ছোঁয়া। যেখানে পাঠকরা এসে বই কেনার পাশাপাশি যেন তাদের সময় কাটানোর মধ্যে কিছুটা আনন্দের স্পর্শ পেতে পারে। বইমেলার অঙ্গনটিকে স্বাস্থ্যকর ও নান্দনিকভাবে সাজানোর জন্য স্থপতি ও ভৌত-পরিকল্পনাবিদের পরামর্শ নেয়া খুব প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। যেটা বাংলা একাডেমি ভেবেছে বলে আমার মনে হয় না।

বইমেলা ঘিরে প্রকাশকদের নানা প্রত্যাশা, অভিযোগ, অনুযোগ ও শঙ্কা ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গে কথা হয় বাংলা একাডেমির জনসংযোগ ও সমন্বয় বিভাগের প্রধান, উপ-পরিচালক মুর্শিদ আনোয়ারের সঙ্গে। প্রকাশকদের এসব বক্তব্যের সাথে কিছুটা একমত পোষণ করে তিনি বলেন, গত বছরের বইমেলাটি ছিল তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত। এর ফলে হাতে খুব বেশি সময় পাওয়া যায়নি। যার ফলে কিছুটা ত্রুটি ছিল বটে। কিন্তু এবারের বইমেলাটির কার্যক্রম শুরু হয়েছে অনেক দিন আগে থেকেই। তাই এ বছর আশা করছি তেমন সমস্যা হবে না। এবার মেলার পরিধি আরও বিস্তৃত করা হয়েছে। রাখা হচ্ছে প্যাভিলিয়ন। তাছাড়া গতবার যে টয়লেটের সমস্যা ছিল, এবার তা দূর করা হবে। বসানো হবে পর্যাপ্ত টয়লেট সুবিধা। ধুলাবালি রোধে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হবে। প্রতিবারেই আমরা এর জন্য দিবাগত রাত থেকেই ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সূর্যের আলো ও মানুষের আনাগোনার ফলে মেলার মাঠ ধুলাময় হয়ে ওঠে। মেলার প্রবেশপথ যেন সাচ্ছন্দ্য মতো হয়, তার জন্য গেটের পাশে কোন খাবারের দোকান বসতে দেয়া হবে না। তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দূরে নেয়া হবে। তবে গতবারের মতো এবারেও শিশুদের স্টলগুলো রাখা হচ্ছে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেই।




আপনার মন্তব্য