একজন মরমী সাধক

 প্রকাশিত: ২০১৪-১২-২৮ ২২:৩৬:১৪

 আপডেট: ২০১৪-১২-২৮ ২২:৪১:১৪

মারূফ অমিত:

বর্ষায় আজ নৃত্য-গীতের ব্যবস্থা নেই। রামপাশা- লক্ষণশ্রীর জমিদারি নেই। উঁচু দেহ, দীর্ঘভূজ ধারাল নাসিকা, জ্যোতির্ময় পিঙ্গলা চোখ এবং একমাথা কবিচুল, সুফী সুফী ভাবের সেই সুদর্শন জমিদার পুরুষও আজ নেই। 
 


একজন মরমী কবি, বাউল সাধকের কথা বলছি। সঙ্গীতের সাথেই তার মাখামাখি, নাম; হাছন রাজা। তাঁর প্রকৃত নাম দেওয়ান হাছন রাজা, অনেকে অহিদুর রেজা হিসেবেও জানেন। হাছন রাজার জন্ম ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর (৭ পৌষ ১২৬১) সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ শহরের নিকটবর্তী সুরমা নদীর তীরে লক্ষণছিরি (লক্ষণশ্রী) পরগণার তেঘরিয়া গ্রামে। হাছন রাজা জমিদার পরিবারের সন্তান। তাঁর পিতা দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী ছিলেন প্রতাপশালী জমিদার। হাছন রাজা তাঁর ত্রিতীয় পুত্র। আলী রাজা তার খালাতো ভাই আমির বখ্‌শ চৌধুরীর নিঃসন্তান বিধবা হুরমত জাহান বিবিকে পরিণত বয়সে বিয়ে করেন। হুরমত বিবির গর্ভেই হাছন রাজার জন্ম। হাসনের পিতা দেওয়ান আলী রাজা তাঁর অপূর্ব সুন্দর বৈমাত্রেয় ভাই দেওয়ান ওবেদুর রাজার পরামর্শ মত তাঁরই নামের আকারে তাঁর নামকরণ করেন অহিদুর রাজা।
 


হাছন রাজাকে মরমী সাধক হিসেবেই আমরা জানি। বাউল বিশেষজ্ঞদের মতে তিঁনি মানবতাবাদী বাউল ফকির লালন সাঁইয়ের অনুসারী ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে মরমী ধারা যুগ যুগ ধরে বহমান থাকলেও এ ধারার উজ্জ্বল কবি বা গীতিকারের সংখ্যা খুব বেশি নয়। সাধারণভাবে "মরমী" বলতে আমরা বুঝি "বিশ্বপ্রকৃতির মর্মে যিনি প্রবিষ্ট, তিনিই মরমী"   তবে আভিধানিকভাবে দেখতে গেলে দেখা যায় ইংরেজি Mystic শব্দের বাংলা অনুবাদ ‘মরমী’। Mystic শব্দটির উৎপত্তি গ্রীক ভাষা থেকে।  সৃষ্টি তত্ত্ব, জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন নিয়ে ভাবাটাকেই মরমী বলা যেতে পারে।  একের ভেতরে দুই আবার দুইয়ের ভেতরে এক নিয়ে ভাবাটা মরমী সাধকদের নিবিড় আরাধনা। দেওয়ান বলেছেন; //এই দেখিলাম, এই নাই, কি করি উপায়রে-প্রেমের মাতাল হইয়া হাছন রাজা গান গায়রে// এখানে প্রেমের মাতাল শব্দগুচ্ছ সহজেই প্রমাণ করে দেওয়ানের মরমী পর্যায়। দেহ আত্মার মিলন এখানে প্রেমের মাধ্যমেই হয়েছে।   
 
 


প্রথম যৌবনে হাছন রাজা ছিলেন ভোগবিলাসী এবং সৌখিন ছিলেন। রমণী সম্ভোগে তিনি ছিলেন অক্লান্ত। তাঁরগানে নিজেই উল্লেখ করেছেন-//সর্বলোকে বলে হাসন রাজা লম্পটিয়// প্রতিবছর বিশেষ করে বর্ষাকালে নৃত্য-গীতের ব্যবস্থাসহ তিনি নৌকায় চলে যেতেন এবং বেশ কিছুকাল ভোগ-বিলাসের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করে দিতেন। এর মধ্যেই বিশেষ বিশেষ মুহুর্তে তিনি প্রচুর গান রচনা করেছেন, নৃত্য এবং বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমেই তিনি এসব গান রচনা করেছেন। এসব গানে জীবনের অনিত্যতা সম্পর্কে,ভোগ-বিলাসের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে নিজেকে স্মরন করিয়ে দিয়েছেন।  //নেশা লাগিল রে, বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিল রে- হাসন রাজা পিয়ারির প্রেমে মজিল রে,নেশা লাগিল রে// এই গানটি তিনি বাইজির নৃত্য দেখতে দেখতে রচনা করছিলেন। হাসন রাজা পাখি ভালোবাসতেন। 'কুড়া' ছিল তার প্রিয় পাখি। তিনি ঘোড়া পুষতেন। তাঁর প্রিয় দুটি ঘোড়ার নাম ছিল জং বাহাদুর এবং চান্দমুশকি।  আনন্দ বিহারে সময় কাটানোই হয়ে উঠলো তাঁর জীবনের একমাত্র বাসনা। আনন্দ বিহারে অসংখ্য বাইজির সাথে রাত্রি যাপন'ও করেছেন।   
 
 


বিলাসী হাছন হঠাৎ করেই আধাত্ম্যে জড়িয়ে যান। আধ্যাত্নিক স্বপ্ন-দর্শন হাসন রাজার জীবন দর্শন আমূল পরিবর্তন করে দিল, মনের দুয়ার খুলে গেলো তাঁর। তাঁর মনের মধ্যে এলো এক ধরনের উদাসীনতা, বৈরাগ্য ভাব। তিনি মুর্শিদ ভক্ত হয়ে পড়লেন, সৃষ্টিকর্তার স্বরূপ উদ্ঘাটনে মগ্ন হলেন।   //“ লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ী ভালা নায় আমার, কি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝার,ভালা করি ঘর বানাইয়া, কয় দিন থাকমু আর ,আয়ন দিয়া চাইয়া দেখি, পাকনা চুল আমার//  তবে মুর্শিদ ভক্ত হাছন শরিয়ত পন্থি ছিলেন না।মোল্লা-মুনশীর বিপক্ষে তিনি অনেক গান রচনা করেছেন। মারিফতি ভাব ধারার অনেক দিন তাঁর গানে ফুটে উঠে। তিনি লিখেছেন; //‘আমি যাইমু গো যাইমু আল্লাহরও সঙ্গে// তাঁর এ কথার মাধ্যমে সহজেই  আল্লা'র রূপ মানুষের ভিতর খুজে পাওয়ার'ই সামিল। শ্রী চৈতন্যের বৈষ্ণব কবিতা ও গান  হাছনের বাউলিয়ানা মানসিকতাকে প্রেমধর্মের বন্যায় ভাসিয়েছিল। কৃষ্ণের ভক্ত হয়ে গেছিলেন //আমি মরিয়া যদি পাই শ্যামের রাঙ্গা চরণ// দেওয়ান হাছন রাজা গেয়েছেন; //হিন্দুয়ে বলে তোমায় রাধা, আমি বলি খোদা// অর্থাৎ নামে নয় আরাধনাই সাধনের মূল উপজীব্য এমন ভাবধারাই তিঁনি লালন করেছেন তাঁর হৃদ্যে।  হাছন রাজা  সকল ধর্মের নির্যাস, সকল সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যই আধ্যাত্ন-উপলব্ধির ভেতর দিয়ে বাউল সাধনাকে আপন করে নেন। তাঁর অনুভবে ধর্মের এক অভিন্ন রূপ ধরা পরে- সম্প্রদায় ধর্মের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সর্বমানবিক চেতনার বিকাশ ঘটে। ওপরদিকে, মৃত্যু চিন্তা হাছন রাজার গানের এক প্রধান বৈশিষ্ট্য।  মৃত্যু চিন্তা সর্বদাই তাকে উদাস করে রেখেছে।  মৃত্যুর অমোঘতা নিয়ে তিনি লিখেছেন; //একদিন তোর হইবোরে মরণরে হাছন রাজা একদিন তোর হইবেরে মরণ।মায়াজালে বেড়িয়া মরণ, না হইলো স্মরণরে হাছন রাজা একদিন তোর হইবে রে মরণ।যমের দূতে আসিয়া তোমার হাতে দিবে দড়িটানিয়া টানিয়া লইয়া যাবে যমেরও পুরীরে।সে সময় কোথায় রইবো (তোমার) সুন্দর সুন্দর স্ত্রীকোথায় রইব রামপাশা, কোথায় লক্ষণছিরিরে।করবার নিরে হাছন রাজা রামপাশার জমিদারীকরবায় নিরে কাপনা নদীর পাড়ে ঘুরাঘুরি রে।আর যাইবায়নি হাছন রাজা রাজা গঞ্জ দিয়াকরবায় নিরে হাছন রাজা দেশে দেশে বিয়া//   গানের কথাগুলোর মাধ্যমে সহজেই উপলব্ধি করা যায় ভবের সংসারে সুন্দরি নারী, বাড়ি অথবা জমিদারি কিছুই স্থায়ী নয়, সবই ক্ষণস্থায়ী। প্রাণ পাখি উড়ে গেলে মাটির এ ভান্ড নিথর, নিরর্থক। হাসন রাজার গানে আঞ্চলিক বুলি, প্রবচন ও বাগ্‌ধারার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। শ্রীহট্ট বা সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয় তাঁর গানে।  আক্কল, জিয়ন, ভালা, ঠেকাইলায়, মুঞ্জিয়াগানা, বেসক, বাড়ৈ, খেইড়, বন্ধে, লাঙ্গ, নাতিন, বুচা ইত্যাদি শব্দ গুলো যথার্থ প্রমাণ।   
 
 


হাছন রাজা কোন পন্থার সাধক ছিলেন তা স্পষ্ট জানা যায় না। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি এভাবে বলেছেন; ‘আমি’র পরিচয় দিয়েছেন এভাবে- আমি হতে আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে। আমি হতে এই ত্রিজগৎ। আমি হতে সৃষ্টি হয়েছে ধ্বনি। আমি সুন্দর, আমি ধ্বংস, আমি ভিতর ও বাহির, চিন্তা ও বাক্য, আমি প্রকাশ ও বাহির, চিন্তা ও বাক্য, আমি প্রকাশ ও অপ্রকাশ। আমার দৃষ্টি থেকে সৃষ্টি হয়েছে আকাশ ও পৃথিবী। এই দৃশ্যমান জগৎ। এই রূপ আমার কর্ণ হইতে সৃষ্টি হয়েছে এই শব্দ, এই ধ্বনি, আমার শরীর থেকে সৃষ্টি হয়েছে শক্ত ও নরম, ঠান্ডা ও গরম। আমি নাসিকা দ্বারা সৃষ্টি করেছি গন্ধ, আমি জিহ্বা দ্বারা করেছি এই রস মিষ্ট ও তিক্ত। আমার তো আদি অন্ত নেই। জীবনের তো শেষ নেই। সে তো চিরকালই জীবিত। আমি আপনাকে চিনেছি জেনেছি- আপনাকে চিনলে তাকে চেনা যায়।’ কাজী নজরুল ইসলামও তার বিদ্রোহী কবিতায় বলেছেন ‘আমি আপনারে আজ চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।'  তাঁর পদাবলীতে কোন গুরুর নামোল্লেখ নেই। কেউ কেউ বলেন তিনি চিশতিয়া তরিকার সাধক ছিলেন। সুফীতত্ত্বের প্রেরণা ও প্রভাব তাঁর সঙ্গীতে ও দর্শনে থাকলেও, তিনি পুরোপুরি এই মতের সাধক হয়তো ছিলেন না। নিজেকে তিনি 'বাউলা' বা 'বাউল' বলে কখনো কখনো উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি বাউলদের সমগোত্রীয় হলেও নিজে আনুষ্ঠানিক বাউল ছিলেন না। সুফীমতের সঙ্গে দেশীয় লোকায়ত মরমীধারা ও নিজস্ব চিন্তা-দর্শনের সমন্বয়ে তাঁর সাধনার পথ নির্মিত হয় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। হাছন রাজার দৌহিত্র দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বলেছেন; "বাউল ভাবনা থাকলেও হাছন রাজা বাউল ছিলেন না। কিন্তু বাউল দর্শন যে তাকে প্রভাবিত করেছিল সেটা তো অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তিনি অস্বীকার করেছিলেন, মোল্লা-মুনশীর বিপক্ষে তিনি অনেক গান'ও রচনা করেছিলেন"  
 
 


হাছন রাজাকে বিভিন্ন কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, সাধু, ভক্ত বিভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯ ডিসেম্বর ১৯২৫ Indian Philosophical Congress-এর প্রথম অধিবেশনে সভাপতি নির্বাচিত হন। সভাপতির অভিভাষণে তিনি প্রসঙ্গক্রমে হাসন রাজার দুটি গানের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে তাঁর দর্শন চিন্তার পরিচয় দেন। ভাষণটি 'Modern Review' ( January 1926 ) পত্রিকায় 'The philosophy of Our People' শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এর অনুবাদ প্রকাশিত হয় 'প্রবাসী' ( মাঘ ১৩২২ ) পত্রিকায়। ভাষণে হাসন রাজা সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে উদ্ধৃত হলোঃ"পূর্ববঙ্গের এক গ্রাম্য কবির (হাছন রাজা) গানে দর্শনের একটি বড় তত্ত্ব পাই সেটি এই যে, ব্যক্তিস্বরূপের সহিত সম্বন্ধ সূত্রেই বিশ্ব সত্য। তিনি গাহিলেন-"মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিনশরীরে করিল পয়দা শক্ত আর নরমআর পয়দা করিয়াছে ঠান্ডা আর গরমনাকে পয়দা করিয়াছে খুসবয় বদবয়। ”এই সাধক কবি দেখিতেছেন যে, শাশ্বত পুরুষ তাঁহারই ভিতর হইতে বাহির হইয়া তাঁহার নয়নপথে আবির্ভূত হইলেন। বৈদিক ঋষিও এমনইভাবে বলিয়াছেন যে, যে পুরুষ তাঁহার মধ্যে তিনিই আধিত্যমন্ডলে অধিষ্ঠিত।"রূপ দেখিলাম রে নয়নে, আপনার রূপ দেখিলাম রে।আমার মাঝত বাহির হইয়া দেখা দিল আমারে।। ”১৯৩০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে 'হিবার্ট লেকচারে' রবীন্দ্রনাথ 'The Religion of Man' নামে যে বক্তৃতা দেন তাতেও তিনি হাসন রাজার দর্শন ও সঙ্গীতের উল্লেখ করেছিলেন।       
 
 



ইতি কথায় বলা যায়, নিরালায় ধ্যান মগ্ন হয়ে হাছন রাজার ভাব দর্শন নিয়ে চিন্তা করলে মাটির পিঞ্জিরার গৌরব নিমিষেই চূর্ণ বিচূর্ণ হয়। না ফেরার দেশে চলে গেলেই গৌরব, অহমিকা, দম্ভ সব'ই নিমজ্জিত হবে সুরমার জলে।
 

আপনার মন্তব্য