প্রতিবাদী সমাজ

 প্রকাশিত: ২০১৫-১০-০৭ ১৯:২৫:৩৪

 আপডেট: ২০১৫-১০-০৭ ১৯:২৭:০১

ছবি: সংগৃহীত

মাসকাওয়াথ আহসান:

আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে প্রতিবাদী সমাজ। এই সমাজের মূল বিনোদন প্রতিবাদ করা, ব্যাংকে পয়সা জমানো, একটি বাড়ী বানানো, ছেলে-মেয়েকে সেটল করে দেয়া, বুড়ো বয়েসের জন্য ইউনাইটেডে ও মাউন্ট এলিজাবেথে চিকিতসার সামর্থ্য লুট করা, সম্ভব হলে বুদ্ধিজীবীদের কবরস্থানে সাড়ে তিনহাত জায়গা এনশিওর করা।পথিকৃত বাতেন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়তেন;তার স্ত্রী আকলিমা নদী ইডেনে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় দুজনের প্রেম-পরিণয়। তখন আন্দোলনের ছবি ফেসবুকে আপলোডের সুযোগ ছিল না। তবে লিভিংরুমের পশ ফটো এলবামে সে ছবি আছে।এরশাদ পতনের পর ৯০ এর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পথিকৃত ব্যাংক লোন পায়। সে লোন আর শোধ দিতে হয়নি। কেন দেবে; তার কাছে দেশের এতো ঋণ!পথিকৃতের গার্মেন্টস-এর ব্যবসা। আর নদীর এনজিও ‘পায়ে পড়ি’; বারিধারায় ডুপপ্লেক্স। একটি ছেলে একটি মেয়ে সুখী সংসার। ছেলের নাম অকথ্য আনন্দ ব্যাডেন। মেয়ে পারমিতা ব্যাডেন। ওরা আপ এন্ড ডাউন ইউনিতে বিজনেস স্টাডিজ পড়ছে। অকথ্য এক আওয়ামী লীগের মন্ত্রীর মেয়ের প্রেমে পড়েছে। আর পারমিতা এক জামাতের ব্যারিস্টারের ছেলের খপ্পরে পড়েছে। সেই থেকে জাতীয় ঘটক সাদেক কান নিয়মিত যাতায়াত করছেন ব্যাডেন পরিবারে।

নদী ব্যাডেন নিয়মিত টকশোতে গিয়ে আঙ্গুল ঝাঁকিয়ে পরিবারতন্ত্রের প্রতিবাদ করেন। এভাবে আর কতদিন। আমরা কী এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম। আমরা চেয়েছি সম্পদের সুষম বন্টন,মানবাধিকার, দুবেলা ভাতের অধিকার। তার কথা শুনে ভুরুঙ্গামারির তরুণ বাতেন উজ্জীবিত হয়। ম্যাডামের ফ্যান হয়ে যায়। ম্যাডামের ফেসবুক পেজে ফলোয়ার হয়ে যায়। ম্যাডামের ছবিগুলোকে লাইক দিতে দিতে আঙ্গুল ব্যথা করে ফেলে।পথিকৃত রোজ রাতে একাই এক লিটার ব্ল্যাক লেবেল নাবিয়ে দিয়ে, ড্রাইভার আর দারোয়ানের কোলে চড়ে বেডরুমের বিছানা পর্যন্ত আসে। একটা হাত ডানদিকে ঝুলে টাইলস খামচে পড়ে থাকে। নদী টকশো বা রুপসী বাংলার ডোনার ডিনার থেকে ফিরে হাতখানা ব্যাডেনদার বুকে তুলে দেয়। এরপর নদীকে ফেসবুকে বসতে হয়; জনগণের প্রশ্ন; নদী ম্যাডামের উত্তর সেশনে অংশ নিতে। ভুরুঙ্গামারীর বাতেন উপরোধ করেছে;ম্যাডাম ভুরুঙ্গামারীর দরিদ্র্য শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াবেন কী?


অবশ্যই। তুমি ডেট ফিক্স করো। ব্যাডেন গার্মেন্টস আছে কেন; ফটোগ্রাফার ভিভেক করিমকে ইনবক্সে জানিয়ে দেয় ভুরুঙ্গামারী যেতে হবে। শীতবস্ত্র বিতরণের ফটোসেশন।ছেলে অকথ্য ব্যাডেন ফেসবুকে চ্যাটিং করছে মন্ত্রীর মেয়ে নাবিলা অথৈ-এর সঙ্গে। পারমিতা ডিজুস কিচির মিচির অফারে জামাত নেতার ছেলে আল বেরুনীর সঙ্গে গল্প করছে। বেরুনীর আব্বা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার মামলার সিরিয়ালে; পালিয়ে গিয়ে লন্ডনে বসে। তার ব্যবসা বানিজ্য বেরুনী দেখছে। পাশাপাশি আইন পড়ে দাগন ভুঁইয়া একাডেমীতে। ব্যারিস্টারী পড়তে লন্ডনে যাবে। কিন্তু বাপ লন্ডনে যাওয়ায় তার যাওয়া হচ্ছে না। আল্লাহ যা করেন ভালর জন্যই করেন। পারমিতা থেকে দূরে চলে গেলে লং ডিসটেন্স রিলেশন যদি না টেকে। যদি টেলিফোনে আর মায়াবন বিহারিনী না গায়। যদি ছুটে গিয়ে অনাবিল বোকাসান্দের প্রেমে পড়ে যায়। বোকাসান্দ সেলিব্রেটি। তার পারমিতাকে উদ্ভট সব ইভেন্টে ইনভলভ করার একটা ঝোঁক আছে। বেরুনীর কাছে জিনিসটা সুবিধার লাগেনা।ম্যাডাম নদী একটা শিফনের সি থ্রু শাড়ী পরে উপরে বেখেয়ালী চিলতে শাল ফেলে ভুরুঙ্গামারী পৌঁছে যান। ম্যাডামের প্রাডোর চারপাশে মানুষ ঘিরে ধরে।বাতেন ও স্থানীয় সাংবাদিকেরা ম্যাডামকে ভিএম প্রেসক্লাবে নিয়ে যায়। ভিভেক করিম তার ডিএস এল আর চালু রেখেছে। ম্যাডামের কোডাক মোমেন্টসগুলো ক্যাপচার করছে। পঞ্চাশের নদী দিব্যি মিড থার্টিজের বর্ষানদী হয়ে আছে। সবই মেইনটেনেন্সের ব্যাপার।পারসোনা প্লাটিনাম কার্ড আছে স্পা-নদীর।

বাতেনের স্পর্ধিত ত্রিশ বছর বয়স মুগ্ধতায় প্রায় এনাসথেসিয়া টেবিলের অবশ শরীর নিয়ে শীত-বস্ত্র বিতরণ ইভেন্ট করছে। নদী ম্যাডামের জন্য লেখা মানপত্র পড়তে গিয়ে বারোটা ফাম্বল করে বসে ভিএম বাতেন। নদী হেসে আস্থা দেয়, ঠিকাছে।অনেকে এসে ম্যাডামের অটোগ্রাফ নেয়। সাংবাদিকরা বাইট নেয়। ভিএম কলেজের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটি তনিমা বেগম মুখ বন-পাংশুল করে বসে আছে। পাশের বান্ধবীকে বলে, মাথাটা খুব ধরেছে। আমি চলে যাচ্ছি।ম্যাডামের প্রাডোর ড্রাইভারের পিছের সিটে বসে বাতেন। বাংলাদেশে গাড়ীর মালিক সবসময় ড্রাইভারের বিপ্রতীপ সিটে বসে; বামদিকে। অজানা কারণে দক্ষিণ এশিয়ার লোক এই পিছের সিটের বাম দিকে বসে, কে ভি আইপি বা গাড়ীর মালিক তা জানান দিতে। এতে সন্ত্রাসীদের সুবিধা হয়, মাগিং বা কিলিং-এ বামদিকেরটাকে ঝেড়ে দিলেই হয়।


ভিভেক সামনের সিটে বসে ছবি তুলতে থাকে।গাড়ী এসে পৌঁছে গ্রামের এক প্রায় নদীবর্তী বানভাসি জনপদে। গাড়ী দেখে বাচ্চারা সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ায়। ম্যাডাম সানগ্লাস পরে প্রথম আলো পড়ছেন। বাতেন ম্যাডামের প্রত্ন যাদুঘরটি লুকিয়ে দেখতে থাকে। ম্যাডাম আড় চোখে দেখে খুশী হয়। আমি এখনো ফুরিয়ে যাইনি।শীতবস্ত্র বিতরণ শুরু হয়, গাল ভাঙ্গা বুড়ি, হার জিরজিরে কৃষক, চোখ বসা শীতে কাঁপা শিশু লাইন ধরে দাঁড়িয়ে। ফটোগ্রাফার ভিভেক ভাবে; ছবির যে সাবজেক্ট, পুলিতজার পায়া না যাই আবার। তবে ছবি তুলতে হবে নদী ম্যাডামের। ওদের হাত, অর্ধেক প্রোফাইল আসবে। ছবিতে ভিএম বাতেন যাত্রার বিবেকের মতো দাঁড়িয়ে শীতের কাপড় এগিয়ে দেয়।

ভুরুঙ্গামারীতে ইতিহাস গড়ে নদী ঢাকা মহাসাগরে ফিরে যায়। বাতেন সিদ্ধান্ত নেয়; আর এই ভুরুঙ্গামারীতে থ্যাংকলেস জব নয়।ঢাকায় যেতে হবে। দেখে নিস একদিন আমিও ভিএম ব্যাডেন হবো।ফেসবুকে ছবি আপলোড করার পর লাইকের সুনামী বয়ে যায়; একের পর এক টিভি টকশোর দাওয়াত আসে। ইউরোপ ট্যুরের অফার আসে।ভুরুঙ্গামারীর কয়েকটি ছবি নদী ম্যাডামকে বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণের সঙ্গী করে।গার্মেন্টস বাতেন ঢাকা ক্লাবে ধীরে ধীরে নদীর হাজব্যান্ড হিসেবে পরিচিতি পায়। মায়ের জনপ্রিয়তায় ছেলে অকথ্য ও মেয়ে পারমিতা ফেসবুকে সেমিসেলিব্রেটি হয়। রুখে দাও পরিবারতন্ত্র পেজের এডমিনের চার্জ পায় পারমিতা। এটা জামাতের ছেলে আল-বেরুনীর পেজ।

ভিএম বাতেন ঢাকায় আসে। নদী ম্যাডাম একজন কথা বলার লোক পায়; যার সঙ্গে বসে সমাজ পরিবর্তনের ডিসকোর্সে অংশ নেয়া যায়।ছেলেটা ভাল পড়াশুনা করে; সাং গাঠনিক ক্ষমতা প্রবল।সাদেক কান ভিএম বাতেনের সঙ্গে কথা বলে খুবই ইমপ্রেসড। খুব কড়া দেশপ্রেমিক ছেলেরে বাবা। প্রেস ক্লাবের ভি আইপি লাউঞ্জ ভাড়া নিয়ে শুরু হয় ভিএম বাতেন ব্র্যান্ডিং। রুখে দাও পরিবারতন্ত্র ক্রমশঃ আম আদমীর আকাংক্ষার কোণা স্পর্শ করে। নদী ম্যাডাম আজ মানবাধিকার তো কাল দানবাধিকার প্রটোকলে সাইন করে বেড়াচ্ছে ব্রাসেলসে; স্টকহোমে। গোটা বাঙ্গালী গোলকের লিবেরেল তরুণরা নদী আপ্পির সঙ্গে সেমিনার শেষে ফটোসেশন করছে। ফেসবুকের দুনিয়ায় নদীরকূল-ঢেউ-অববাহিকা, জেগে ওঠা চর তারপর ফুঁসে ওঠা বান দৃষ্টিগোচর হয়। নদী ম্যাডামের একটাই কথা রুখে দাও পরিবারতন্ত্র।

নদী ম্যাডামের লিভিং রুমের গোলাপ কাঠেরসোফা, নানা দেশ থেকে উপহার নেয়া মুখোশ, গ্যারেজের চারটি গাড়ী, প্রশস্ত বাগানের টিউলিপ সবাই হেলে দুলে গাইতে থাকে রুখে দাও পরিবারতন্ত্র।


আপনার মন্তব্য