একুশ তাপাদার

২৬ এপ্রিল, ২০১৬ ১৮:৪২

‘ধর্মীয় মত’ না মেলায় ১৪ মাসে ১৪ খুন, সরকারের ভূমিকা ‘প্রশ্নবিদ্ধ’

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ১৪ মাসে অন্তত ১৪ জন ব্যক্তিকে ধর্মীয় মতবাদের বিরোধের সূত্র ধরে হত্যা করা হয়েছে। খুনের ধরন, হত্যার শিকার ব্যক্তিদের জীবনাদর্শ এবং দায় স্বীকার করে বার্তা দেয়ার খবরের তথ্য যাচাই করে এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া গেছে।

এসব ঘটনায় নিহত হয়েছেন বিজ্ঞান লেখক ও ব্লগার, অনলাইন এক্টিভিস্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, পুরোহিত, শিয়া সম্প্রদায়ের মুয়াজ্জিন, ধর্মান্তরিত মুক্তিযোদ্ধা, অধিকারকর্মীসহ ১৪ জন।

একই কায়দায় ঘটে এরকম হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধে সরকার আন্তরিক কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। হত্যার শিকার ব্যক্তিদের মতাদর্শ নিয়ে মন্তব্য করে খুনিদের অপরাধকে 'খাটো' করার অভিযোগ উঠেছে সরকারের বিরুদ্ধে।

৬ এপ্রিল অনলাইন এক্টিভিস্ট ও গণজাগরণ আন্দোলনে যুক্ত নাজিমুদ্দিন সামাদ হত্যার প্রতিক্রিয়ায় ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন- "ধর্মীয় অনুভূতিতে আহত হয় এমন লেখালেখির কারণে কোন অঘটন ঘটলে তার দায় সরকার নেবে না"।

তাঁর এই বক্তব্যের পর নিহত ব্লগার ও বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী বন্যা আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের কারণে খুনিরা আরও আস্কারা পেল। অভিজিৎ রায়কে হত্যার সময় বন্যা আহমেদ নিজেও গুরুতর আহত হয়ে কোন রকমে প্রাণে বেঁচে যান।

কথা সাহিত্যিক স্বকৃত নোমান এ ব্যাপারে সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্য উস্কানি ছাড়া আর কী! যার কারণে খুনিরা আরো বেশি উৎসাহিত হচ্ছে। কারা এসব হত্যাকাণ্ড করছে রাষ্ট্র নিশ্চয়ই জানে।"

২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ গণজাগরণ আন্দোলন চলাকালীন সময়ে আহমেদ রাজীব হায়দারকে ইসলাম ধর্মীয় উগ্রবাদীরা কুপিয়ে হত্যা করলেও বছর দুয়েক ঐরকম কোন ঘটনা আর ঘটেনি। যদিও ২০১৪ সালের ১৫ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম শফিউল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তবে এই ঘটনা নির্দিষ্ট কোন গোষ্ঠী দায় স্বীকার করেনি।

দুই বছর পর ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলায় অভিজিৎ রায়কে দিয়েই শুরু হয় ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড। এরপর একে একে ২০১৫ সালের ৩০ মার্চ ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে অফিস যাওয়ার পথে ঢাকার তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের বেগুনবাড়িতে কুপিয়ে হত্যা করে তিন জঙ্গি। পালিয়ে যাওয়ার সময় জিকরুল্লাহ ও আরিফুল নামে দুজনকে ধরে ফেলে স্থানীয় জনতা। এই ঘটনার মাস দেড়েকের মধ্যেই ১২ মে সিলেট নগরীর সুবিদ বাজার এলাকায় ব্লগার ও বিজ্ঞান লেখক অনন্ত বিজয় দাশকেও অফিস যাওয়ার পথে নিজ বাসার অদূরে কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায় খুনিরা। মাস তিনেক পর ৮ আগস্ট রাজধানীতে নিজ বাসায় ঢুকে হত্যা করা হয় ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়কে।

২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর অভিজিৎ রায়ের বইয়ের দুই প্রকাশনীতে একই দিনে হামলা চালানো হয়। শুদ্ধস্বর  প্রকাশনীতে হামলায় গুরুতর আহত হয়ে প্রাণে বেঁচে যান প্রকাশক আহমেদুর রশিদ টুটুল, লেখক রণদীপম বসু ও কবি তারেক রহিম। তবে শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে নিজ অফিসেই উগ্রবাদীদের চাপাতির কোপে নিহত হন জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সাল আরেফিন দীপন।

২০১৬ সালের শুরুর দিকে এরকম কোন ঘটনা না ঘটলেও গত ৬ এপ্রিল (বুধবার) রাজধানীর পুরান ঢাকায় চাপাতির আঘাতে খুন হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমুদ্দিন সামাদ। তাকে খুন করার সময় "আল্লাহু আকবর" বলে স্লোগান দেয় খুনিরা বলে জানান স্থানীয়রা।  

সিলেটের বিয়ানীবাজারের ছেলে নাজিমুদ্দিন ২০১৩ সালে গণজাগরণ আন্দোলন চলাকালীন সিলেটের কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতেন। 'আওয়ামীলীগ সমর্থক' সামাদের কোন ব্লগ একাউন্ট না থাকলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক বিভিন্ন ইস্যুতে সোচ্চার ছিলেন তিনি।

বিজ্ঞান লেখক, ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট হত্যার প্রতিটি ঘটনার পরেই অনলাইনের বিভিন্ন মাধ্যমে ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠি আল-কায়েদার উপমহাদেশীয় শাখার সাথে যুক্ত বলে দাবি করা 'আনসার আল ইসলাম' এর পক্ষ থেকে দায় স্বীকার করে বার্তা দেয়া হয়।

ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হত্যা:
ঢাকায় শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির সময় বোমা হামলার পর রেশ থাকতেই বগুড়ার শিবগঞ্জে শিয়া মসজিদে হামলা চালানো হয়। ২০১৫ সালের ২৭ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার)  মাগরিবের নামাজের সময় দুর্বৃত্তদের গুলিতে ওই মসজিদের মুয়াজ্জিন মোয়াজ্জেম হোসেন (৬০) নিহত হন। এই ঘটনায়  ইমাম ও মুসল্লিসহ আরও ৩ জন গুলিবিদ্ধ হন। এই ঘটনার পর আইএস এর দায় স্বীকারের খবর দেয় সাইট ইন্টিলিজেন্স।


২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে নিজ বাসায় জবাই করে খুন করা হয় ইসলামি চিন্তাবিদ মাওলানা শায়খ নূরুল ইসলাম ফারুকীকে। এই ঘটনাও ধর্মীয় বিষয়ে মতবিরোধের কারণে হয়ে থাকতে পারে বলে পুলিশ জানিয়েছিল

এরপর গত ১৬ মার্চ  কালীগঞ্জে আবদুর রাজ্জাক (৪৮) নামের এক শিয়া সম্প্রদায়ের হোমিও চিকিত্সককে কুপিয়ে হত্যা করে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা।

ইসলাম ধর্মের দুই ধারা শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবেদ নিয়ে পাকিস্তান, ইরাক ও ইরানে বিভিন্ন সময়ে সংঘাতের খবর পাওয়া গেল বাংলাদেশ এর আগে এমন কিছু ঘটেনি। ইসলাম স্টেট (আইএস) নিজেদের খাঁটি সুন্নিপন্থী মুসলিম দাবি করে শিয়াদের মুসলিম বলে অস্বীকার করে আসছে।

এ বছরের  ২১ শে ফেব্রুয়ারি উত্তরাঞ্চলীয় জেলা পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার করতোয়া সেতুর পশ্চিম পাশের মঠ সন্তগৌরীয় এর পুরোহিত মহারাজ যজ্ঞেশ্বর রায়কে (৫০) গলা কেটে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায়ও আইএসের দায় স্বীকারের খবর জানায় সাইট ইন্টিলিজেন্স।

ধর্মান্তরী মুক্তিযোদ্ধা খুন:
গত ২২ মার্চ (২০১৬) সকালে কুড়িগ্রাম শহরের গাড়িয়াল পাড়ায় হোসেন আলী (৬৮) নামে এক ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানকে জবাই করে হত্যা করা হয়। যিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

মাজারে জোড়া খুন:
২০১৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর শুক্রবার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরীর আকবর টিলা এলাকায় ‘ল্যাংটা ফকিরের মাজার’ নামে পরিচিত এক কক্ষের একটি ঘরে গলা কেটে হত্যা করা হয় রহমত উল্লাহ ওরফে ল্যাংটা ফকির ও খাদেম আবদুল কাদেরকে। এই ঘটনার পর প্রাথমিকভাবে পুলিশ জানিয়েছিল ধর্ম মতের বিরোধের সূত্র ধরেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকতে পারে।

ইসলামী কট্টরপন্থীরা মাজারকে পৌত্তলিকতা বলে এর বিরোধিতা করে আসছে।  ২০০৪ সালে সিলেটের হযরত শাহজালাল (র) এর মাজারের হামলায় কয়েকজন হতাহত হন। এ সময় মাজারে প্রার্থনারত তৎক্ষালিন  ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী  প্রাণে বেঁচে যান। সম্প্রতি এই মামলায় হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নেতা মুফতি হান্নান তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড ও দুইজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক খুন:
গত শনিবার (২৩ এপ্রিল) সকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে (৫৮) নিজ বাসার অদূরে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এই ঘটনায়ও ইসলামিক স্টেটের দায় স্বীকারের বার্তা দেয় সাইট। আত-তামকিন নামক এক ওয়েবসাইটে "দাওলাতুল ইসলাম" নামক এক সংগঠনের বরাত দিয়ে বলা হয় অধ্যাপক রেজাউল নিরীশ্বরবাদের দিকে আহবান করতেন বলে তাকে হত্যা করেছে মুজাহিদরা।  
 
সমকামী পত্রিকার সম্পাদক খুন:
সর্বশেষ সোমবার (২৫ এপ্রিল) শেষ বিকেলে রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় নিজ বাসায় খুন হন সমকামী ও তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার বিষয়ক পত্রিকা 'রূপবান' এর সম্পাদক জুলহাজ মান্নান ও তাঁর বন্ধু মাহমুব তনয়। খুন করে চলে যাওয়ার সময় খুনিরা "আল্লাহু আকবর" বলতে বলতে চলে যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।  

জুলহাজ মার্কিন দূতাবাসের সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপু মনির খালাত ভাই। মঙ্গলবার এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে টুইটার একাউন্ট থেকে বার্তা দিয়েছে আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের (একিআইএস) কথিত বাংলাদেশ শাখা ‘আনসার আল ইসলাম’।

ধর্মীয় উগ্রগোষ্ঠির এরকম ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড বিষয়ে কথা সাহিত্যিক স্বকৃত নোমান বলেন, " সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র যেহেতু গণতান্ত্রিক, তাই এই দেশে আস্তিক নাস্তিক হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টান সবাই সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করবে। অথচ রক্তের বিনিময়ে অর্জিত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে শুধুমাত্র ধর্মের কারণে ধারাবাহিক হত্যার ঘটনা ঘটছে। খোদ রাষ্ট্র এসব হত্যাকাণ্ডে উস্কানি দিচ্ছে।"  

তিনি বলেন, "অপরাধীদের কেন বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে না? তাহলে কি আমরা বলব, এসব হত্যার পেছনে সরকারের কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে? যদি থাকে, তবে তা হবে আত্মঘাতী। এর খেসারত একদিন ক্ষমতাসীন দলকে দিতে হবে।"  

উগ্রবাদী হামলায় আহত হয়ে ইউরোপে আশ্রয় নেয়া শুদ্ধ্বস্বর প্রকাশনীর কর্ণধার আহমেদুর রশিদ টুটুল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, " আবার!মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি দায়িত্ব নিতে পারবেন না বলার পর আজ রূপবান গোষ্ঠীর তনয় ও জুলহাসকে হত্যা করা হলো। ইচ্ছে করে না আর আপনাকে সম্বোধন করে কিছু বলি। কিন্তু দেশতো আমাদেরও। তাই বাধ্য হয়েই বলতে হয়। আপনার কাছে বিচার চাই না। আপনি শুধু রাষ্ট্রের অধিকর্তা হিসাবে সব মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। এটা করতে আপনি সাংবিধানিকভাবে বাধ্য।"

উল্লেখ্য, সম্প্রতি ২০১৩ সালে নিহত ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় বিচার শেষ হয়ে রায় রয়েছে। এছাড়া আর কোন মামলারই তেমন কোন অগ্রগতির খবর জানাতে পারেনি প্রশাসন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত