সিলেটটুডে ডেস্ক

২৭ এপ্রিল, ২০১৬ ০৯:৩৪

চাঁচের বেড়া ও টিনের ছাউনির গানের স্কুলই কাল হলো তাঁর

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী নিজ গ্রাম দরগামাড়িয়ায় শিশুদের জন্য একটি গানের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিষয়টি ভালোভাবে নেননি এলাকার কিছু লোক। সেখানকার একটি মাদ্রাসা থেকে ওই গানের স্কুলে যেতে নিষেধ করা হয়েছিল।

স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা নিয়ে কোনো ধর্মীয় উগ্র গোষ্ঠী রেজাউল করিমকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে—এমন সন্দেহ তাঁর পরিবার ও তদন্তসংশ্লিষ্ট সংস্থার। কারণ, গ্রামটি নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবরি শুরুর দিকের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বাগমারা এলাকায় অবস্থিত।

এদিকে গতকাল মঙ্গলবার ভোরে পুলিশ দরগামাড়িয়া ফোরকানিয়া ও হাফেজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক মোহাম্মদ রায়হানুল ইসলাম (৩২) এবং গোপালপুর ইসলামিয়া আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক মুনসুর রহমানকে (৪৮) আটক করেছে। রায়হানুল গানের স্কুলে যেতে তাঁর ছাত্রছাত্রীদের নিষেধ করেছিলেন। এ ছাড়া গত শনিবার দিবাগত রাতে পুলিশ হাফিজুর রহমান নামে শিবিরের এক নেতাকে আটক করে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকপ্রশাসন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।

রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ সামসুদ্দিন বলেন, গানের স্কুল নিয়ে এলাকায় অসন্তোষ বা দ্বন্দ্বের বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই সন্দেহভাজন হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁদের আটক করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী একজনের সন্ধান পুলিশ পেয়েছে বলে জানান তিনি।

দরগামাড়িয়া গ্রাম থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে বাগমারা থানারই সৈয়দপুর চকপাড়া আহমদিয়া জামে মসজিদে গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর একটি আত্মঘাতী বোমা হামলা হয়। এতে হামলাকারী নিহত হন। আহত হন শিশুসহ আরও ছয়জন। ওই ঘটনার দায়ও তখন আইএস স্বীকার করে। পুলিশ তখন ঘটনাটি ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা ঘটিয়েছে বলে জানায়। তবে এখনো তারা নিহতের পরিচয় বের করতে পারেনি।

অধ্যাপক রেজাউল করিমের গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার ভবানীগঞ্জ পৌরসভার দরগামাড়িয়ায়। রাজশাহী সদর থেকে প্রায় ৪৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ওই গ্রামে আমবাগানের পাশে গড়ে তোলা হয়েছে গানের স্কুল। স্কুলটি রেজাউল করিমের বাড়ি থেকে মাত্র দু-তিন মিনিটের হাঁটা পথ। চাঁচের বেড়া ও টিনের ছাউনি দেওয়া স্কুলটির মেঝেও কাঁচা।

গত সোমবার কথা হয় ওই গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে। তাঁরা জানান, গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন রেজাউল করিম। স্কুলে কোনো নামফলক না থাকলেও স্থানীয়ভাবে এটি দরগামাড়িয়া সংগীত বিদ্যালয় নামে পরিচিত। প্রতি শুক্রবার একজন শিক্ষক এসে বিকেল চারটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গান শেখান। স্কুলটিতে এখন ১০ জন মেয়েশিশু গান শিখছে। এর মধ্যে মাত্র দুজন দরগামাড়িয়া গ্রামের। বাকি আটজনই পাশের গাঙপাড়া গ্রামের। গান শেখাতে স্কুলটিতে বাদ্যযন্ত্র বলতে শুধু একটি তবলা ও একটি হারমোনিয়াম ব্যবহার করা হয়। স্কুলে নজরুলসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, দেশাত্মবোধক গান শেখানো হয়।

গানের স্কুলের শিক্ষক মো. ইবরাহিম আলী সরদার থাকেন দরগামাড়িয়া থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে বাসুপাড়া গ্রামে। তিনি রাজশাহী বেতারের একজন তালিকাভুক্ত গায়ক এবং বাসুপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকও। স্কুলটির প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কথা হয় ইবরাহিম আলীর সঙ্গে। ইবরাহিম বলেন, গত বছর রেজাউল করিমের অনুরোধ পেয়ে কাজ করতে রাজি হন। প্রথম দিন স্কুলে ১৫-১৬ জন শিশুকে দেখতে পান। পরের শুক্রবারই সেই সংখ্যা কমে দু-তিনজনে নেমে আসে।

ইবরাহিম বলেন, শিশু কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে এক ছাত্রী জানায়, মাদ্রাসার হুজুর গান শিখতে আসতে মানা করে দিয়েছেন। বিষয়টি রেজাউল করিমকে জানালে তিনি তাঁকে ধৈর্য ধরে ক্লাস চালিয়ে যেতে বলেন। ইবরাহিম বলেন, এর কয়েক দিন পর রেজাউল করিম গ্রামে আসেন এবং পার্শ্ববর্তী গাঙপাড়া গ্রামে গিয়ে আট-দশজন ছাত্রী সংগ্রহ করেন। তাদের নিয়েই মূলত স্কুলটি চলছে।

সোমবার ওই স্কুলে গেলে গ্রামের ১০-১৫ জন নারী-শিশু-তরুণের সঙ্গে কথা হয়। প্রত্যেকর মুখেই শিক্ষক রেজাউল করিমের প্রশংসা। মহিমা হক নামে এক গৃহিণী বলেন, শিশুরা যখন গায়, তখন খুব সুন্দর লাগে। নিজের বাচ্চাকে স্কুলে পাঠান কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার মেয়েটা মাদ্রাসায় যায়। হুজুর বলেছেন গান শিখতে এই স্কুলে আসা যাবে না, তাই তাকে পাঠাতে পারছি না।’

মাদ্রাসাশিক্ষক রায়হানুল ইসলাম আটক হওয়ার আগে, গানের স্কুলে যেতে শিশুদের নিষেধ করার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, যে মাদ্রাসায় পড়তে আসে, সে গানের স্কুলে গান শিখতে যেতে পারে না, তাই তিনি মানা করেছেন। কেন পারে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কারণ বলতে পারব না। আমার হুজুররা আমাকে না করেছেন। আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের না করেছি।’ কোন হুজুর, তার কোনো জবাব তিনি দেননি।

শিক্ষক রেজাউল করিমের মেয়ে রিজওয়ানা হাসিন এ প্রসঙ্গে  বলেন, বাবা চেয়েছিলেন ওই এলাকার পিছিয়ে পড়া শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য কাজ করবেন। তাই তিনি স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হয়তো কখনো তিনি শিশুদের জন্য চকলেট, কখনো মিষ্টি নিয়ে যেতেন। তাদের ক্রিকেট ব্যাট কিনে দিয়েছিলেন। তাদের জন্য ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা করতেন। ওই স্কুলটাকে টার্গেট করার কোনো কারণ আছে বলে মনে করেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিভিন্ন মতের মানুষ রয়েছে। হয়তো কারও খারাপ লাগতেও পারে। প্রকাশ্যে বাবাকে মুখের ওপর কিছু বলতে পারেনি। এটাকেই একটা অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

এর আগে গতকাল পুলিশ জানিয়েছে, শিক্ষক রেজাউলের হত্যাকারীকে দেখেছেন এমন এক ব্যক্তির সন্ধান পেয়েছে তারা। হত্যাকারীর চেহারার বিবরণ ওই ব্যক্তি পুলিশকে দিয়েছেন। এ বিষয়ে রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. শামসুদ্দিন বলেন, ওই ব্যক্তি বলেছেন, জিনসের প্যান্ট পরা লম্বা-চওড়া একজন লোক খুন করে পালিয়ে গেছে। এ ব্যাপারে তিনি আর বিস্তারিত বলতে চাননি। তিনি বলেন, সবই বলে দিলে তো আর আসামি ধরা যাবে না।

সূত্র: প্রথম আলো।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত