সৈকত ভৌমিক

২৩ জুন, ২০১৬ ০১:২১

শুনুন এক অনলাইন প্রতারকের গল্প!

আজ্বরীন ইন্টারন্যাশনালের শরিফুল হাসান যিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ব্যবসায়িক সম্পর্কের মাধ্যমেই। হঠাৎ করেই উনার সাথে পরিচয় হলো অর্থমন্ত্রীর খুব কাছের একজন বলে পরিচয় দেয়া একজন আইসিটি বিশেষজ্ঞের সাথে যিনি পরিচয়ের পর থেকেই আইসিটি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কাজের সাথেও নিজের সম্পৃক্ততা দাবী করে যেতেন। ব্যবসায়িকভাবেই তিনি সম্পর্ক গড়ে তুলেন ও একপর্যায়ে শরিফুল হাসান সাহেবকে আইসিটি মন্ত্রণালয়ের “ডিজিটাল বাংলাদেশ’’ গড়ার প্রজেক্টের কথা বলে নিজের কোম্পানির নামে পাওয়া কাজের নামে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ল্যাপটপ সাপ্লাইয়ের জন্যে অনুরোধ করে ও সরকারী কাজের প্রমাণপত্র হিসেবে দেখায় সরকারী জিওর (GO) অনুলিপি।

এরপর চুক্তি অনুযায়ী শরীফুল হাসান কিছুটা সময় ধরে ল্যাপটপ দিতে থাকলেও বিপত্তি বাধে কিস্তির টাকা পরিশোধের সময় এসে। শুরু হয় নানা রকম টালবাহানা আর টাকা পরিশোধের নামে চলতে থাকে তারিখ। একসময় শরিফুল হাসান জানতে পারেন প্রমাণপত্র হিসেবে দেখানো সরকারী জিওর(GO ) অনুলিপিটি আসলে ছিলো জাল এবং আইসিটি মন্ত্রণালয়ের ওই সম্পর্কিত কোন প্রজেক্টই ছিলো না।

আর প্রতারক উনার কাছ থেকে যত ল্যাপটপ নিয়েছে তার সবই খোলা বাজারে বিক্রয় করে নগদ টাকা উত্তোলন করে হাতিয়ে নিয়েছে বিশাল অংকের টাকা যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা। আর এই ব্যাপারে উনি সে প্রতারকের সাথে যোগাযোগ করতে গেলেই উনাকে দেয়া হয় হত্যার হুমকি। যে কারণে শরিফুল হাসান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শরণাপন্ন হন এবং মামলা করেন (তাং- ১৮-০৫-২০১৬)।

এটা একটা মাত্র উদাহরণ। ঠিক এমন ভাবেই নানা রকম প্রতারণার ফাঁদে ফেলে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ থেকে নানা রকম প্রলোভন দেখিয়ে এই প্রতারক হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা আর ব্যাবহার করেছে কখনো বা বাংলাদেশে বিভিন্ন স্তরের ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের নাম আর কখনোবা খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবীদের নাম।

অভিনব এই প্রতারকের নাম হাসনাত শাহরিয়ার প্রান্ত (৩৪) (স্থায়ী ঠিকানা:-পিতা-মৃত আবদুল হালিম, সানফ-চাচুয়া, থানা-সেনবাগ, জেলা-নোয়াখালী) ও বর্তমান ঠিকানা বাসা নং-২৯(৩য় তলা); রোড-০৮; পিসি-কালচার হাউজিং সোসাইটি, আদাবর, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭। যিনি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রিন লিফ এডুকেশনের স্বত্বাধিকারী বলেও পরিচয় দিয়ে থাকেন।

শুধু মাত্র শরিফুল হাসানই নয় যিনি এই প্রতারকের প্রতারণার শিকার হয়েছে বরং প্রতারিত হওয়ার তালিকাতে আছে আরো অনেক ব্যক্তি।

আমিন হেলালি (প্রোপাইটর-হলোগ্রাম বাংলাদেশ লিমিটেড) যিনি একজন ব্যবসায়ী হিসেবেই পরিচিত অথচ অর্থমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে ও অর্থমন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারি টাকশালের টেন্ডার দেয়ার দেয়ার নাম করে ব্যবসায়িক প্রস্তাবের মাধ্যমে হাতিয়ে নেয় নগদ অর্থ এবং সেই সাথে বিভিন্ন সময়ে গাড়ি ক্রয় করার অজুহাতে বা ধার হিসেবে প্রায় ১,৩৬,৩৫,৫০০ টাকার মতন নিয়ে থাকে। জালিয়াতি যখন ধরা পড়ে তখন প্রতারক হাসনাত শাহরিয়ার প্রান্ত হুমকি দিতে থাকে আমিন হেলালি পরিবারের সদস্যদের খুন করার। প্রতারণার শিকার হয়ে আমিন হেলালি রমনা মডেল থানাতে মামলা করেন (তাং-১৬-০৫-২০১৬)।

মাহমুদ হাসান জনি (প্রোপাইটর-রিগাল অটোজ) একজন গাড়ি ব্যবসায়ী যাকে ৯টি আমদানিকৃত গাড়ি দেয়ার কথা বলা হয়। প্রথমদিকে ৩টি গাড়ির কাগজপত্র সহ সকল কিছু বুঝিয়ে দিলেও এর পর আরো ৮টি গাড়ির কথা বলে প্রায় ১ কোটির উপরে টাকা নিয়ে কোন কাগজপত্র ছাড়া শুধু মাত্র ডেলিভারি চালান দিয়ে ৬টি গাড়ি বুঝিয়ে দেওয়া হয়। প্রায় ৬ মাস অতিবাহিত হলেও কাগজপত্র দিতে পারে নি হাসনাত শাহরিয়ার প্রান্ত। উলটো কাগজ চাইতে গেলেই দেয়া হতো প্রাণনাশের হুমকি। যে কারণে ভীত হয়ে মাহমুদ হাসান জনি পল্টন মডেল থানাতে মামলা করেন (১৯-০৫-২০১৬ তাং; মামলা রেফারেন্স-  এবং নিজের অসহায়ত্বের কথা জানায়। অনুসন্ধানে জানা গেছে গাড়িগুলো প্রায় ২ বছর আগে জাপান থেকে আমদানি করা হয় যার কোন লিগ্যাল কাগজপত্রাদি প্রান্তের কাছেও নেই। যে কারণে ভুক্তভোগীরা প্রতারকের সাথে চোরাই গাড়ি চক্রের সম্পৃক্ততার কথাও আশংকা করছেন।

এছাড়াও বিভিন্ন সূত্র থেকে ৭/৮ কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যবসার নাম করে প্রতারণার মাধ্যমে সংগ্রহ করেছে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে যার মধ্যে আছে অনেক রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, ক্রীড়াবিদ, সাংবাদিক থেকে শুরু করে সরকারী ও বেসরকারিভাবে কর্মরত অনেক ব্যক্তিবর্গের নামও।

প্রশ্ন উঠতে পারে কেনো আসলে সবাই হাসনাত শাহরিয়ার প্রান্তের প্রতারণার শিকার হলেন।  অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায় নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির একজন বলে পরিচয় দেয়া এই প্রতারক নিজের ফেসবুক আইডিতে বিভিন্ন সময় সমাজের বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিদের সাথে ছবি দিতেন। আর এতে করে তিনি অনলাইনে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের একজন লোক বলে নিজেকে জাহির করতে পারতেন।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসভিত্তিক কাজ করার কথা বলে সে পরিচিত হয়ে উঠে কিছু অনলাইন একটিভিস্টদের সাথে যাদের সামনে সে উপস্থাপন করে মুক্তিপিডিয়া ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রোজেক্ট কে যা কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। এভাবেই প্রান্ত নিজের একটা বলয় গড়ে তুলেন সকলের অজান্তেই এবং তা কাজে লাগিয়ে অন্যদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন বিশাল অঙ্কের টাকা।  

কিন্তু উপরে উল্লেখিত ভুক্তভোগীরা যখন প্রানহুমকি পেয়ে ও প্রতারণার শিকার হয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শরণাপন্ন হয় তখন প্রকাশিত হতে থাকে একের পর এক প্রতারণার কাহিনী ও সবাই জানতে পারে এই প্রতারকের সম্পর্কে।

হাসনাত শাহরিয়ার প্রান্ত শুধু প্রতারণা করেই নয় বরং যে প্রক্রিয়াতে সকলকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে থাকতো তা আসলে আরো ভয়ংকর। পাওনাদাররা পাওনা চাইতে গেলেই সে হুমকি দিতো পাওনাদারদের এই বলে যে “বেশি বাড়াবাড়ি করলে তার এক ডাকে মিরপুরের বিহারী পল্লীর ফকির বাড়ির শয়ে শয়ে লোক রাস্তায় নেমে পাওনাদারদের কাচা খেয়ে ফেলবে।’’

আর এভাবেই সে নিজের প্রতারণা চালিয়ে যেতেন প্রান্ত। প্রতারণার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের যখন জিজ্ঞেস করা হয় এতদিন চুপ থাকার তখন উনারাই জানান প্রান্তের ভাষ্যমতে গুলশানে ওরই ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয়ের বাড়িতে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান ফ্লোর লিজ নিয়ে আছে যে বাড়িতে সকল ভাড়াটিয়ারাও পাকিস্তানি নাগরিক আর যদি সে কিছু করে পাকিস্তানে পালিয়ে যায় তবে কেউ আর কোন টাকা পাবে না আর এই টাইপ ভয় দেখিয়েও সে অনেককে চুপ করিয়ে রাখার চেষ্টা করতো। এছাড়াও সে বিভিন্ন সময়ে ওর রাজনৈতিক ক্ষমতার কথা বলতে গিয়ে বলতো ওর খালার জামায়াতের রোকন থাকার কথা যিনি গত বছরের শেষের দিকে মারা যান।

নিজের লেখা কোন ব্লগ না থাকলেও রমনা মডেল থানাতে গ্রেফতারের সময় নিজেকে ব্লগার পরিচয় দেয়া প্রতারক হাসনাত শাহরিয়ার প্রান্ত রিমান্ডে চলাকালীন সময়ে সকল জালিয়াতি ও টাকা আত্মসাতের কথা স্বীকার করলেও টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায়।

এমন অবস্থায় আসলে প্রতারণার শিকার হওয়া ভুক্তভোগীদের শুধু একটাই চাওয়া আর তা হলো যেনো সুষ্ঠুভাবে তদন্তের মাধ্যমে উনাদের টাকা ফিরে পাওয়া সম্ভব হয় এবং সেই সাথে এমন প্রতারণার শিকার যেনো আর কাউকে সমাজে না হতে হয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত