১০ জুলাই, ২০১৬ ১৯:৪৬
ঢাকার গুলশানের জঙ্গি হামলার পর হামলাকারীদের কয়েকজন বিতর্কিত ইসলামী চিন্তাবিদ জাকির নায়েকের বক্তৃতা ও পিস টিভি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন এমন সংবাদ প্রকাশের পর জঙ্গিবাদে উৎসাহ যোগানোর অভিযোগে 'পিস টিভি'র সম্প্রচার বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তার বিভিন্ন বক্তৃতায় নারীবিদ্বেষের প্রমাণ পাওয়া যায়।
রোববার (১০ জুলাই) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ১২ দপ্তরের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে আইন-শৃঙ্খলা সম্পর্কিত মন্ত্রিসভা কমিটির এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয় বলে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানান। এরপর তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সোমবার থেকে এ সংক্রান্ত দাপ্তরিক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন।
জাকির নায়েক পরিচালিত মুম্বাইভিত্তিক ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশনের একটি প্রতিষ্ঠান হল এই পিস টিভি। এ টিভিতে ধর্ম নিয়ে আলোচনায় ইসলামের যে ব্যাখ্যা তিনি দেন, তা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
এরই মধ্যে জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের দাবি করা হয়েছে বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও ইসলামী নেতার পক্ষ থেকে তাকে গ্রেপ্তারের দাবি উঠেছে।
ভারতের বাংলাভাষায় পরিচালিত কলকাতা টোয়েন্টিফোরসেভেন অনলাইন জাকির নায়েকের সাত বিতর্কিত মন্তব্য নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে দাবি করা হয় মূলত এসবের জেরে সমালোচনার মুখে পড়তে হল ভারতের এই ধর্ম প্রচারককে।
ভারতের মহারাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী জাকির নায়েকের পিস টিভির ভারতেও বৈধ কোন লাইসেন্স নেই। কয়েক বছর এ টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ করা হয় বলে এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। বৈধ লাইসেন্স না থাকলেও ভারতের অনেক জায়গায় ক্যাবল অপারেটররা অবৈধভাবে এ টেলিভিশনের সম্প্রচার দেখাচ্ছিলেন বলে অভিযোগ উঠার পর গত কয়েক দিন ধরে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে ভারত সরকার।
এদিকে, বাংলাদেশে জঙ্গি সম্পৃক্ততায় জাকির নায়েক ও তার পরিচালিত পিস টিভির ভূমিকা থাকলে তদন্তসাপেক্ষে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে ভারত সরকার।
এমন অবস্থায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ জাকির নায়েক ও পিস টিভির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। উত্তর প্রদেশে বারেলী এলাকায় ঈদের জামাতের খুৎবায় মুসলিম নেতারা জাকির নায়েককে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন। জাকির নায়েকের ধর্মীয় ব্যাখ্যাকে ভুল আখ্যা দিয়ে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় কওমি মাদরাসা দেওবন্দের আলেমরা ফতোয়াও দিয়েছেন।
সৌদি আরবের পৃষ্ঠপোষকতায় ওহাবি মতবাদ প্রচারকারী হিসেবে জাকির নায়েককে সন্দেহের চোখেও দেখেন অনেক মুসলিম পণ্ডিত। এর প্রমাণ মেলে ‘ইসলামের সেবক’ হিসেবে ২০১৫ সালে সৌদি আরব সরকার ‘বাদশাহ ফয়সাল আন্তর্জাতিক পুরস্কার’ দেয় জাকির নায়েককে।
১৯৬৫ সালে মুম্বাইয়ে জন্ম নেওয়া জাকির নায়েক কিষানচাঁদ চেলারাম কলেজের পর টোপিওয়ালা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে মেডিসিন বিষয়ে পড়ালেখা করেছেন। পরে বিওয়াইএল নায়ার চ্যারিটেবল হাসপাতালেও পড়েন তিনি।
এরপরই নতুন করে আলোচনায় আসেন ভারতের মহারাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া চিকিৎসক জাকির নায়েক, যিনি বিভিন্ন সময় ইসলাম ধর্ম, জঙ্গিবাদ, জিহাদ নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে নিষিদ্ধ হয়েছেন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মালয়েশিয়ায়।
গত বছর উসকানিমূলক কথাবার্তা বলার অভিযোগে ভারতের কর্নাটক রাজ্যে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়৷ এখন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও সেই সিদ্ধান্তের দিকে এগোচ্ছে বলে ইঙ্গিত মিলছে।
জাকির নায়েকের আরও কিছু বিতর্কিত মন্তব্য-
গত ১ জুলাই শুক্রবার ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিসান বেকারিতে সংঘবদ্ধ জঙ্গি হামলার পর থেকে আবারও আলোচনায় আসেন এ ইসলামিক চিন্তাবিদ। হামলাকারীরা তার টুইটার ও তার মতাদর্শ অনুসরণ করতো বলে প্রচারিত হলে জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে তদন্তের ইঙ্গিত দেয় ভারত সরকার। এছাড়াও বাংলাদেশ তথ্য প্রমাণ দিলে ও গুলশান হামলায় জাকির নায়েকের জড়িততা প্রমাণিত হলে তাকে ভারত থেকে নিষিদ্ধ করা হতে পারে বলেও জানায় ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ঢাকা হামলায় নিহত জঙ্গিদের দুজন- রোহান ইমতিয়াজ এবং নিবরাস ইসলাম জাকির নায়েককে অনুসরণ করত। রোহান গত বছর জাকির নায়েকের পিস টিভির একটি অনুষ্ঠান তার ফেসবুক পেজে পোস্ট করেছিল।
৫০ বছর বয়সী জাকির নায়েক মুম্বাইয়ের ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা। অন্য ধর্মকে নিয়ে মন্তব্য এবং ওসামা বিন লাদেনকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে বিভিন্ন সময়ে সমালোচিত হয়েছিলেন তিনি।
২০১০ সালে এক প্রেস কনফারেন্সে জাকির নায়েকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিলো, যুক্তরাজ্য কেন তাকে নিষিদ্ধ করেছে। জবাবে তিনি জানান, সকল মুসলিমকে সন্ত্রাসী হওয়ার অনুপ্রেরণা দেওয়ার কারণে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘আমি মুসলিমদের বলেছিলাম, সকল মুসলিমের সন্ত্রাসী হওয়া প্রয়োজন। টেররিস্ট বা সন্ত্রাসী হলো সেই ব্যক্তি যে অন্যদের টেররাইজ বা ভীত সন্ত্রস্ত করতে পারে। যখন একজন ডাকাত পুলিশকে দেখে তখন সে ভয় পায়। সেকারণে একজন ডাকাতের জন্য পুলিশ একজন সন্ত্রাসী। সেদিক থেকে সব মুসলিমেরই ডাকাতের কাছে সন্ত্রাসী বলে বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন।’
পিস টিভিতে সম্প্রচারিত জাকির নায়েকের এ বক্তব্যটি গত বছর ফেসবুকে শেয়ার করেছিল রোহান। এদিকে নিবরাস ইসলাম জাকির নায়েক ছাড়াও আনজেম চৌধুরী এবং শামী উইটনেসকে ২০১৪ সাল থেকে টুইটারে অনুসরণ করে আসছিল। শামী উইটনেস নামের টুইটারটি চালান ২৪ বছর বয়সী মেহেদি বিশ্বাস। তাকে ২০১৪ সালে ভারত থেকে আটক করা হয়। মেহেদি বিশ্বাসকে আইএসের টুইট একাউন্টের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকার কারণে বিচারের মুখোমুখি করা হয়।
এদিকে ভারতে জাকির নায়েক ও তার চ্যানেল পিস টিভিকে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে ভারত সরকারের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন জাকির নায়েক। তিনি কার্যত সরকারকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশে আমাকে কোটি কোটি লোক চেনে। গুলশানের এই হামলাকারীরাও যদি আমাকে চেনে, তাতে অবাক হওয়ার কী আছে? ক্ষমতা থাকলে সরকার পিস টিভি বন্ধ করে দেখাক’।
আপনার মন্তব্য