জাকির আজিজ

০৭ আগস্ট, ২০১৬ ০২:১১

চাপাতির নিচে মুক্তচিন্তা : নিলয় নীল হত্যার ১ বছর

ব্লগার, অনলাইন এক্টিভিস্ট, গণজাগরণ মঞ্চ কর্মী ও বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সংগঠন (Bangladesh Science and Rationalist Association)-এর সদস্য নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয় (নিলয় নীল) হত্যার ১ বছর আজ। ২০১৫ সালের ৭ আগস্ট রাজধানী ঢাকার খিলগাঁও ১৬৭ গোরানের বাসায় ঢুকে অজ্ঞাত পরিচয় ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে হত্যা করে। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি।

নিলয় নীল মুক্তমনা, নবযুগ ও ইস্টিশন ব্লগে লেখালেখির পাশাপাশি ফেসবুকেও সক্রিয় ছিলেন এবং তিনি যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সরব ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের এক বছর পার হয়ে গেলেও বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয় নি।

যা ঘটেছিল ওই দিন
দিনটি ছিল শুক্রবার। জুমুআর নামাজের সময়ে নিলয় নীলদের বাড়ির অন্যান্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা যখন নামাজে তখন খিলগাঁওয়ের উত্তর গোরানে ১৬৭ নম্বর বাসার পঞ্চম তলার বাম পাশের ফ্ল্যাটে ৪/৫জন অজ্ঞাত পরিচয় যুবক বাসা ভাড়ার নাম করে ডুকে। বাসায় ডুকেই আল্লাহু আকবার স্লোগান দিয়ে কোপাতে থাকে। খুনিদের উপর্যুপরি চাপাতির আঘাতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন নিলয় নীল। এরপর খুনিরা নির্বিঘ্নে সেখান থেকে পালিয়ে যায়।

হত্যাকাণ্ডের বর্ণনায় নিলয়ের স্ত্রী
নিলয়ের স্ত্রী আশামনি হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, দুপুর ১২টার দিকে আমার স্বামী বাজার থেকে ফিরে ড্রয়িংরুমে ল্যাপটপ নিয়ে বসেন। এসময় আমি ছাড়াও আমার ছোটবোন তন্বী ছিলাম বাসায়। হঠাৎ করে ২০-২১ বছর বয়সী জিনসের প্যান্ট পরা এক যুবক দরজা খুলতেই বাসায় ঢোকেন। তিনি বাসা ভাড়া নেবেন বলে নিজ থেকেই দু’বার পুরো ফ্ল্যাট ঘুরে দেখেন। তখন আমি বলি, ‘আমরা তো বাসা ছাড়ছি না, বাসা ভাড়া নেবেন কীভাবে? বাড়িওয়ালাকেও তো এ বিষয়ে কিছু বলিনি’ এসময় ওই যুবক বলেন, ‘বাড়িওয়ালাই আমাকে দেখে যেতে বলেছেন’ বলে হাতে মোবাইলেও যেন কী যেন করছিলেন। আমি বিষয়টি ড্রয়িংরুমে আমার স্বামীকে জানাতে যাই। এরমধ্যে আরও তিন যুবক বাসায় ঢোকেন। এরমধ্যে একজনের মুখে দাড়িও ছিল। তারা ভেতরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দেন। তিনজন যুবকের হাতে রামদা ও একজনের হাতে পিস্তল ছিল,’ যোগ করেন আশামনি।

একজন আমার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বারান্দায় রেখে ভেতর থেকে দরজা লক করে দেয়। একইভাবে অন্য রুম থেকে তন্বীকেও এখানে নিয়ে আসে। পরে এক সঙ্গে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে আমার স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা করে চলে যায় তারা। বারান্দায় আমি বারবার ‘বাঁচাও, ‘বাঁচাও’ বলে চিৎকার দিলেও কেউ এগিয়ে আসেনি আমার স্বামীকে বাঁচাতে।

হত্যার দায় স্বীকার আনসার আল ইসলামের
ব্লগার নিলয় নীল হত্যার দায় স্বীকার করে আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের (এআইকিউএস) বাংলাদেশ শাখা আনসার আল ইসলাম। [email protected] ইমেইল ঠিকানা থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে জঙ্গি সংগঠনটি। ইমেইলে বলা হয়, “আনসার আল ইসলাম (আল কায়েদা ভারতীয় উপমহাদেশ, বাংলাদেশ শাখা) এর মুজাহিদিনরা হামলা চালিয়ে আল্লাহ তা'আলা ও তার রাসুলের দুশমন নিলয় চৌধুরীকে হত্যা করেছেন। শুক্রবার দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে ওই অপারেশন সম্পন্ন হয়।” মেইলে আরও বলা হয়, 'আল্লাহর রাসুলের সম্মান রক্ষার্থে প্রতিশোধমূলক ওই হামলা চালানো হয়েছে।' বিবৃতিতে হুমকি দিয়ে বলা হয়, ' আমরা আল্লাহ ও তার রাসুলের নিকৃষ্টতম দুশমনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছি। আমরা এদের ও তাদের সঙ্গীদের ধ্বংস করতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করবো। হে মুসলিম উম্মাহ আমরা আপনাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছি যতক্ষণ পর্যন্ত এই সন্তানদের ধমনীতে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ ও তার রাসুলের শত্রুদের ওপর হামলা চলতেই থাকবে।’

জঙ্গি ফারাবীর হিটলিস্টেও ছিলেন নিলয় নীল
বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অভিযুক্ত সফিউর রহমান ফারাবীর হিটলিস্টেও ছিলেন নিলয় নীল। হত্যাকাণ্ডের ৪ দিন আগে অর্থাৎ ৩ আগস্ট ‘দ্যা ভয়েস অব জিহাদ ফি সুবিলিল্লাহ’ নামের ব্লগের এক পোস্ট শেয়ার করেন নিলয়। ব্লগের লেখাটি ছিল শফিউর রহমান ফারাবীর। ২০১৩ সালের ২৮ আগস্ট ফারাবী পোস্টটি লিখে। সেই পোস্টে ‘ইসলামবিদ্বেষী’ আখ্যা দিয়ে একটি তালিকা দেওয়া হয়। যে তালিকায় ছিলো নিলয় নীলের নাম। পোস্টে নিলয় লিখেন, ‘ফারাবী হুজুরের ইসলামবিদ্বেষী লিস্টে তো আমার নামও আছে, ইয়া মাবুদ, রক্ষা করো।’ ফারাবী বর্তমানে জেলে রয়েছে।

নিলয়কে পুলিশ বলেছিল, ‘দেশ ছেড়ে চলে যান’
হত্যাকাণ্ডের পর অনলাইনে প্রচার হওয়া তাঁর এক স্ট্যাটাসে দেখা যায় নিলয় নীল অনেকবার হত্যার হুমকি পেয়ে থানায় জিডি করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তা তাঁকে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। যদিও পরে পুলিশের পক্ষ থেকে এ ঘটনার তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়, এবং সে কমিটি কোন প্রমাণ পায় নি।

হত্যাকাণ্ডের কয়েক মাস আগে ১৫ মে ২০১৫ নিলয় নীল (নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়) ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে লিখেন- এই ঘটনায় জিডি করতে যেয়ে আরও উদ্ভট পরিস্থিতির সম্মুখীন হই। প্রথমেই এক পুলিশ অফিসার ব্যক্তিগতভাবে জানিয়েছিলো যে এই ধরণের জিডি পুলিশ নিতে চায় না কারণ ব্যক্তির নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যাপারে যে কর্মকর্তা জিডি গ্রহণ করবে তার একাউন্টেবেলিটি থাকবে সেই ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। আর যদি ঐ ব্যক্তির কোন সমস্যা হয়, সেক্ষেত্রে ঐ পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্বে অবহেলার জন্য চাকুরী পর্যন্ত চলে যেতে পারে। থানায় জিডি করতে ঘুরেও একই চিত্র দেখলাম, অনুসরণকালে অনেকগুলো থানা অতিক্রম করার জন্য গতকাল ঘটনাস্থলের আওতায় থাকা একটি থানায় গেলে তারা জিডি নিলো না, তারা বললো আমাদের থানার অধীনে না, এটা অমুক থানার অধীনে পড়েছে ওখানে যেয়ে যোগাযোগ করুন, আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশ ছেড়ে চলে যান।

বিচার বহুদূর, উলটো খুনের যাত্রায় মুক্তচিন্তা
নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয় (নিলয় নীল) হত্যার এক বছর হলেও বিচার কাজ এখনও শুরু হয় নি। উলটো একের পর এক মুক্তচিন্তার মানুষদের খুনের ধারাবাহিকতা চলছে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় আহমেদ রাজীব হায়দারকে (থাবা বাবা) হত্যার পর ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা থেকে ফেরার পথে খুন হন অভিজিৎ রায়। এরপর একই বছর খুন হন ব্লগার ওয়াশিকুর বাবু, এরপর অনন্ত বিজয় দাশ সিলেটে বাসার সামনে ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের চাপাতির কোপে খুন হন। অনন্তের খুনের পর ঢাকায় খুন হন নিলয় নীল। এরপর একে একে খুন হন ফায়সাল আরেফিন দীপন, নাজিমুদ্দিন সামাদ সহ বেশ কয়েকজন মুক্তচিন্তার লেখক। শুধুমাত্র রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডের বিচার নিম্ন আদালতে শেষ হলেও আরও কোন হত্যার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয় নি।

নিলয় হত্যার ১ বছরপূর্তিতে শাহবাগে কর্মসূচি
নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয় (নিলয় নীল) হত্যাকাণ্ডের এক বছরপূর্তিতে বিচারের দাবিতে শাহবাগে সমাবেশ ও প্রতিবাদী গান-এর আয়োজন করেছে মুক্তচিন্তার পক্ষের এক্টিভিস্টরা। রোববার (৭ জুলাই) বিকেল পাঁচটায় শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে এ কর্মসূচি পালিত হবে। মুক্তচিন্তার মানুষদের উপর অব্যাহত আক্রমণ ও বিচারের ধীর গতিতে শঙ্কা প্রকাশ করে আয়োজকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিচারহীন এইসব হত্যাকাণ্ডই দেশের জঙ্গিবাদ উত্থানে প্রভাব ফেলছে।  সচেতন ও উগ্র মৌলবাদ বিরোধী একটি মানবিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্যে সকলের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত