সিলেটটুডে ডেস্ক

১১ জানুয়ারি, ২০১৮ ১৬:১৬

নিজস্ব অর্থায়নেই হবে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের চার লেন

চীনা কোম্পানিকে বাদ

প্রাক্কলিত ব্যয়ের তুলনায় অস্বাভাবিক অর্থ দাবি করায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেন প্রকল্প থেকে চীনা কোম্পানিকে বাদ দিয়েছে সরকার। কিন্তু এরই মধ্যে এ কোম্পানির সঙ্গে ব্যয় নির্ধারণে দরকষাকষিতে প্রায় এক বছর কেটে গেছে।

চীনা প্রতিষ্ঠানটিকে বেশি ব্যয়ে কাজ দিতে একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর সুপারিশ থাকলেও নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এ মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে উন্নয়ন প্রকল্প পরিকল্পনা (ডিপিপি) ইতিমধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

গত ২১ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) প্রতিনিধি জানান, চীনের মনোনীত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের (সিএইচইসি) সঙ্গে দরকষাকষি ব্যর্থ হয়েছে। সভার কার্যবিবরণী থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

এতে বলা হয়েছে, জিটুজি ভিত্তিতে চায়না হারবার কোম্পানি লিডিটেডের মাধ্যমে বাস্তবায়নের জন্য চলমান দরকষাকষি ফলপ্রসূ না হওয়ায় জিওবি (সরকারি তহবিল) অর্থায়নে বাস্তবায়নে ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদনের লক্ষ্যে দ্রুত প্রক্রিয়া শুরু করতে মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা উইংকে এ দায়িত্ব দিতে সভায় সিদ্ধান্ত হয়।

এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন সচিব নজরুল ইসলাম সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বলেন, দরকষাকষি ফলপ্রসূ হয়নি। এ কারণে চায়না হারবারকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

চীনা কোম্পানিকে বাদ দিলেও, দরকষাকষিতে প্রায় এক বছর কেটে যাওয়ায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা ২০২২ সালের আগস্টের মধ্যে শেষ হবে কি-না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় সংস্থানের বিষয়টিও এখনও নিশ্চিত নয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্বে ব্যয় বাড়ারও শঙ্কা রয়েছে।

২০১৪ সালে রাজধানীর কাঁচপুর থেকে সিলেট পর্যন্ত দুই পাশে ধীরগতির যান চলাচলের জন্য পৃথক সার্ভিস লেনসহ ২২৬ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ২০১৬ সালে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায়। চীনের ঋণে জিটুজি শর্তে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ছিল। ঋণের শর্তানুযায়ী, চীনের মনোনীত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চায়না হারবার বিনা দরপত্রে কাজ পায়।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করতে সওজ প্রথমে সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারণ করে ১০ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণ, ভূগর্ভস্থ পরিসেবা স্থানান্তর, পুনর্বাসন ও পরামর্শক ব্যয় ধরা হয়নি। গত ৯ মার্চ প্রথম প্রস্তাবে চায়না হারবার ১৬ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা দর প্রস্তাব করে। সওজের নেগোসিয়েশন কমিটি তাতে রাজি না হওয়ায় ২৮ মার্চ দ্বিতীয় প্রস্তাবে ১৪ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা দর প্রস্তাব করে এ প্রতিষ্ঠানটি।

এ প্রস্তাবেও রাজি না হয়ে সওজ ব্যয় বাড়িয়ে ১২ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা প্রস্তাব করে। ১৩ শতাংশ ভ্যাট, শুল্ক্কসহ সওজের দর ছিল ১৪ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। চায়না হার্বারের বাংলাদেশ কার্যালয়ের প্রতিনিধি হুয়াং দাওজুন স্বাক্ষরিত সর্বশেষ প্রস্তাবে ব্যয় কিছুটা কমিয়ে ১৪ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা দর প্রস্তাব করা হয়। পরে চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবে ভ্যাট, শুল্ক্কসহ ব্যয় দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৪১২ কোটি। সওজ ও চায়না হার্বারের প্রস্তাবে ব্যয়ের ব্যবধান ছিল এক হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা।

তবে চায়না হারবারের প্রস্তাব করা ১৪ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকায় প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দিতে একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর চাপ ছিল। তার ভাই প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ পাইয়ে দিতে তদবির করেন। সাবেক সড়ক পরিবহন সচিব এম. এ. এন. ছিদ্দিককে ই-মেইলও করেন। চায়না হারবারের পক্ষ নিয়ে দ্রুত দরকষাকষি শেষ করতে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে চিঠি দিয়েছিলেন ওই প্রভাশালী মন্ত্রী। তবে শেষ পর্যন্ত মন্ত্রণালয় প্রভাবশালীদের তদবির অগ্রাহ্য করে।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও সওজের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, চীনের জিটুজি ঋণের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। এ কারণেই বাংলাদেশ উচ্চ সুদের এ ঋণে প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহী নয়। জিটুজি ঋণের শর্তানুযায়ী, চীনের মনোনীত ঠিকাদারকে বিনা দরপত্রে কাজ দিতে হয়। এতে ব্যয় বৃদ্ধি পায়। আবার ঋণ চুক্তি করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। টাকা ছাড়ে বিলম্বে প্রকল্প বাস্তবায়ন পিছিয়ে যায়। অতীতের এ তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে বাংলাদেশ আর জিটুজি ঋণে আগ্রহী নয়।

পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প চীনের জিটুজি ঋণে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সরকারের ঘোষণা ছিল, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের প্রথম দিন থেকেই এ পথে ট্রেন চলবে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের সঙ্গে এ প্রকল্পের সমঝোতা স্মারক সই হলেও এখনও ঋণ চুক্তি হয়নি। কবে হবে- তাও নিশ্চিত নয়। চুক্তির পর পরই টাকা পাওয়া যাবে, এমন নিশ্চিয়তাও নেই। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণে ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের সঙ্গে ঋণচুক্তি হয়। ঋণের টাকার প্রথম কিস্তি পাওয়া গেছে গত মাসে। জিটুজি ঋণে চীন শর্ত জুড়ে দিয়েছে, প্রকল্প ব্যয়ের ১৫ শতাংশ বাংলাদেশকে জোগান দিতে হবে। এসব কারণে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে চীনা প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়েছে সরকার।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক প্রকল্পে সওজ এবং চায়না হারবারের সর্বশেষ দর প্রস্তাবে ব্যবধান এক হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা হলেও চীনা প্রতিষ্ঠানটি শুল্ক্ক ও ভ্যাটের টাকা পরিশোধে রাজি ছিল না। তাদের দাবি ছিল, বাংলাদেশকে এ ব্যয় বহন করতে হবে।

সওজের প্রাক্কলিত ব্যয়ে ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরামর্শক ব্যয় ধরা হয়নি। এর আগে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ঢাকা-সিলেট চার লেন নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই ও বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন করা হয়। জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, ভূগর্ভস্থ পরিসেবা লাইন সরানো ও পরামর্শক ফিসহ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১২ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় ১৬ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। চীনের প্রস্তাবে রাজি হলে এ ব্যয় ১৯ হাজার কোটি ছাড়িয়ে যেত।

২২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে সোয়া চার কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ৭০টি সেতু নির্মাণ করা হবে। চার হাজার ৩৫৮ মিটার দীর্ঘ চারটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে ভৈরব, সিলেটের গোয়ালাবাজার, তাজপুর ও দয়াময়ী বাজার এলাকায়। নরসিংদী, ভৈরব, ওলিপুর, লস্করপুর ও সিলেটে নির্মাণ করা হবে রেল ওভারপাস। এ মহাসড়ক হবে এশিয়ান হাইওয়ে-১ এবং এশিয়ান হাইওয়ে-২-এর অংশ।
সূত্র: সমকাল

আপনার মন্তব্য

আলোচিত