নিজস্ব প্রতিবেদক

১২ জুন, ২০১৫ ১৭:১১

তুরিন আফরোজকে হুমকি: নাম ব্যবহার করায় আনু মুহাম্মদের বিস্ময়

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনজীবি ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকে দেওয়া হুমকিতে আনু মুহাম্মদের নাম ব্যবহার করায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তিনি। এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে আনু মুহাম্মদ লিখেন- ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকে হুমকি দেয়া চিঠি এবং তাতে আমার নাম ব্যবহারের খবর দেখে আমি বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ।

উল্লেখ্য, গত বুধবার ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকে হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠানো হয় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানায়। এরপর ব্যারিস্টার তুরিন নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করেন। এ সম্পর্কে অন্যান্য মিডিয়ার পাশাপাশি সংবাদ প্রকাশ করে সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম-এ আদালত অবমাননাকারী ‘বিশিষ্ট নাগরিকদের’ পক্ষ নিয়ে তুরিন আফরোজকে হুমকি, থানায় জিডি’ শিরোনামে। 

হুমকিসম্বলিত চিঠিতে বলা হয়- "তুরিন আফরোজ তুমি ট্রাইব্যুনাল-২ এ আনু মুহাম্মদ ও অন্যদের বিপক্ষে লড়াই করেছ। তারা দেশের ক্রিম, তুমি আনু মুহাম্মদ ও জাফরুল্লাহ'র পায়ের ধূলোর সমানও নও। তোমার খারাপ দিন আসছে"।

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকে হুমকি সম্বলিত চিঠির প্রতিক্রিয়া এবং ট্রাইব্যুনালে সেদিনের বর্ণনা দিয়েছেন তিনি তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে। উল্লেখ করেছেন ডেভিড বার্গম্যানের লেখা না পড়ার কথাও। সিলেটটুডে’র পাঠকদের জন্যে আনু মুহাম্মদের স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো:

“ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকে হুমকি দেয়া চিঠি এবং তাতে আমার নাম ব্যবহারের খবর দেখে আমি বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজে তুরিন যে ভুমিকা পালন করছেন তাতে তাঁকে আমি সম্মান করি। আদালত অবমাননা মামলায় তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি আমাকে কখনও অসম্মান করেননি। আমাদের মধ্যে আদালতেও একাধিকবার সৌহার্দ্যপূর্ণ কথাবার্তা হয়েছে। আমি মনে করি আদালত যে বিষয়টি নিষ্পত্তি করেছেন সে বিষয় নিয়ে জল ঘোলা করবার অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কেউ এই হুমকি ও গালি দেবার ঘটনা ঘটিয়েছে। আমি এর তীব্র নিন্দা জানাই।

২.
একটা গল্প ফেসবুকে ছড়ানো হচ্ছে এই বলে যে, আদালত অবমাননা মামলায় আমাকে সহ কয়েকজনকে ট্রাইব্যুনাল জিজ্ঞাসা করেছেন, বার্গম্যানের লেখা পড়েছেন? আর আমরা সবাই চুপ ছিলাম। ‘লজ্জা, লজ্জা...’বলে এখানে রায়ের যে সূত্র দেয়া হয়েছে তা যে কেউ পরীক্ষা করে দেখলে দেখবেন, ভুল ও অন্যায়ভাবে এই গল্পে আমার নাম জড়ানো হয়েছে। আর এর ওপর ভিত্তি করেই কিছু লোক মহানন্দে আমার বিরুদ্ধে তাদের অভ্যাসবশত কুৎসা রটনা করে যাচ্ছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনালে শুনানীকালে আমার বিষয়ে মাননীয় বিচারকদের কথা ও প্রশ্নোত্তর সবাইকে জানানো প্রয়োজন মনে করি।

আদালতে আমার নাম ধরে মাননীয় বিচারক কথা বলেছেন এবং সুনির্দিষ্ট বিষয় জানতেও চেয়েছেন। আমিও তাঁর জিজ্ঞাসার উত্তর দিয়েছি। প্রথম গত ৬ মে শুনানী কালে ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান কথা প্রসঙ্গে বলেন, ‘যারা অভিযুক্ত তারা সকলেই দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি, অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তাঁরা পালন করছেন। যেমন এখানে আছেন প্রফেসর আনু মুহাম্মদ। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন, রামপাল নিয়ে কথা বলেন আমরা সেটা এপ্রিশিয়েট করি।..’

এরপর গত ১১ মে বিচারপতি হাসান আমাকে সামনে ডাকেন এবং বলেন, ‘প্রফেসর আনু মুহাম্মদ, আপনি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে কথা বলেন আমরা শুনি শুনতে চাই। আপনার ওপরে পুলিশ নির্যাতন হয়েছিলো সেটা আমরা পছন্দ করি নাই। আপনিও এই বিবৃতিতে সই করেছেন। এখন এই বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?’ আমি উত্তরে যা বলি মোটামুটি তার বিবরণ এখানে দিচ্ছি:

‘মাননীয় আদালত, যুদ্ধাপরাধী বিচার নিয়ে দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল এই ট্রাইব্যুনাল। যারা আজ অভিযুক্ত তাদের মধ্যে আছেন বেশ কয়েকজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা। অনেকেই এই যুদ্ধাপরাধী বিচার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, আমি নিজে প্রথম থেকেই এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আছি।

বিচারপতি হাসান: আমরা সেটা জানি।
আমি: আমাদের আন্দোলনের ফসল এই ট্রাইব্যুনাল জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে, অনেক বাধাবিপত্তির মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ এগিয়ে নিচ্ছে। আমরা কোনভাবেই এই ট্রাইব্যুনালের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা সমর্থন বা অনুমোদন করতে পারি না। আমরা চাই এই ট্রাইব্যুনাল মর্যাদা ও দক্ষতার সাথে এই বিচারকাজ সম্পন্ন করুক। আমাদের বিবৃতির উদ্দেশ্য কোনভাবেই ট্রাইব্যুনালকে প্রশ্নবিদ্ধ বা অবমাননা নয়, এটা শুধু মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যাতে খর্ব না হয় তার বিষয়ে আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করা। কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির বিষয় নয়।

বিচারপতি হাসান: বাংলা ও ইংরেজি বিবৃতির মধ্যে পার্থক্য দেখা যাচ্ছে? এই বিষয়ে কী বলবেন?
আমি: আমি বাংলা দেখে সম্মতি দিয়েছি। ই্ংরেজি বিবৃতিতে একটি বাড়তি বাক্য আছে যার সাথে আমি একমত নই।

বিচারপতি হাসান: ডেভিড বার্গম্যান সম্পর্কে আপনার কী ধারণা? তিনি ব্লগে লেখালেখি করেন দেখেছেন?
আমি: ডেভিড বার্গম্যানের সব লেখা সম্পর্কে আমি বলতে পারবো না। তাঁর সাথে আমার পরিচয় যখন তিনি লন্ডনে বসবাসরত ৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধ চিহ্নিত করে, তাদের মুখোশ উন্মোচন করে ঢাকায় একটি তথ্যচিত্র বানাচ্ছিলেন তখন। তথ্যচিত্রের নাম, ‘ওয়ার ক্রাইমস ফাইল’। ঘটনাক্রমে জীবনের প্রথম এবং শেষ অভিনয়ও করি আমি এই তথ্যচিত্রে।

বিচারপতি হাসান: কোন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন?
আমি: একজন শহীদ বুদ্ধিজীবী, যাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়েছিলো আলবদর মঈনুদ্দীন। আমার মনে হয়েছে এই তথ্যচিত্র যিনি বানিয়েছেন তিনি অবশ্যই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষের লোক। তাঁর লেখালেখিতে সমালোচনা থাকলে সেটা নিশ্চয়ই এই বিচারকাজকে সহায়তা করতেই।

বিচারপতি হাসান: তার মানে ঐ তথ্যচিত্র থেকে আপনার যে ইমপ্রেশন তৈরি হয়েছে তার ভিত্তিতেই আপনি বিবৃতিতে সই করেছেন তাই তো?
আমি; জ্বী।’

আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ে আমার এই বক্তব্যের অংশবিশেষ উল্লেখ করা হয়েছে”।

উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ডেভিড বার্গম্যান একের পর এক ব্লগ লিখে চলেছেন। উল্লেখিত ব্লগের একটি আদালত অবমাননার আওতায় পড়ে বলে তা আমলে নিয়ে ট্রাইব্যুনাল বার্গম্যানকে দণ্ড দিয়েছিলেন। এরপর সে দণ্ডের বিপক্ষে আদালতকে সমালোচনা করে দেশের ৪৯জন ‘বিশিষ্ট নাগরিক’ বিবৃতি দিয়েছিলেন।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা. জাফরুল্লাহ ছাড়া আনু মুহাম্মদসহ অনান্যরা ক্ষমা প্রার্থনা করে বিবৃতিজনিত আদালত অবমাননা থেকে রেহাই পেয়েছিলেন। ক্ষমা প্রার্থনা না করায় জাফরুল্লাহ’র এক ঘণ্টার আদালতে দাঁড়িয়ে থাকার দণ্ড এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য করেছিলেন আদালত। ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ছিলেন এই আদালত অবমাননার শুনানির রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত