সিলেটটুডে ডেস্ক

১৯ জুলাই, ২০১৮ ০১:১৮

‘খেলা দেখতে’ রাশিয়ায় গিয়ে বিপদে হাজারো বাংলাদেশী তরুণ

সক্রিয় দালাল চক্র

গলায় ফ্যান আইডি, ব্যাগে ম্যাচ টিকিট। একটু পরপর তা বের করে দেখছেন। মুখস্থ করার চেষ্টা করছেন টিকিটের গায়ে লেখা ম্যাচ-সংক্রান্ত তথ্য। শারজা থেকে মস্কো দেমোদেদোভো বিমানবন্দরে নেমে সব গুলিয়ে ফেললেন জুনায়েদ মিয়া। ইমিগ্রেশন অফিসারের প্রশ্নে কোনো উত্তরই দিতে পারলেন না। মস্কো হয়ে খেলা দেখতে কোন শহরে যাচ্ছেন, বলতে পারলেন না তাও।

ঘটনাটা ৩০ জুন দুপুর দেড়টার। বিশ্বকাপের ঘণ্টাধ্বনি বেজে ওঠার পর সিলেটের বালাগঞ্জের এ যুবকের মতো হাজারো বাংলাদেশী এভাবে রাশিয়া পাড়ি জমিয়েছেন। কাগজপত্রে তাদের সফরের উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বকাপ, আসল উদ্দেশ্য রাশিয়া হয়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশে পাড়ি জমানো। বিশ্বকাপ উপলক্ষে রুশ সরকারের উদারনীতির সুযোগে দেশের বিভিন্ন জেলার যুবকদের এভাবে রাশিয়ায় নিয়ে গেছে দালাল চক্র, যাদের অনেকেই এখন দিশেহারা।

মস্কোর করপোসদোভা এলাকায় এক বাংলাদেশীর পরিচালিত মেসে এমন ১০-১২ জনের সঙ্গে কথা হয়। তাদের সবাই এসেছেন বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে। ৫ থেকে ৮ লাখ টাকার বিনিময়ে তাদের ইউক্রেন, বেলারুশ, ফিনল্যান্ড পাঠানোর কথা বলে আনা হয়েছে। আদৌ কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছতে পারবেন কিনা জানা নেই এসব যুবকের।

১৭ বছর বয়সী সুমন তাদের অন্যতম। নোয়াখালীর এ তরুণকে ৭ লাখ টাকার বিনিময়ে রাশিয়া এনেছে একই জেলার গাবুয়া বাজার সংলগ্ন রাশিয়ান প্লাজার মালিক শহিদুল ইসলাম। মস্কো আসার পর কাগজপত্র করে দেয়ার নামে তার পাসপোর্ট নিয়ে গেছেন শহিদুল। সঙ্গের ১ হাজার ডলারও। কিন্তু মেসে থাকা অন্য বাংলাদেশীদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনে, চিত্র দেখে ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় সুমন।

২০১৫ সালে এ শহিদুলের হাত ধরেই মস্কো আসেন ফখরুল ইসলাম। তিনি জানান, ১১ লাখ টাকার বিনিময়ে মস্কো আসার পর তার পাসপোর্ট নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কাগজপত্র করে দেয়ার কথা বলে সঙ্গে আড়াই হাজার ডলারও নেয়া হয়। বিভিন্ন অজুহাতে সময়ক্ষেপণের পর অতিরিক্ত ১ হাজার ডলার নিয়েছেন শহিদুল। কিন্তু কাগজপত্র করে দিতে পারেননি, ফেরত দেননি পাসপোর্টও।

করপোসদোভা এলাকার এক পার্কে বসে ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘শহিদুল আমার পাসপোর্ট আটকে রাখায় ভিসা নবায়ন করতে পারিনি। আমি এখন অবৈধভাবে এখানে অবস্থান করছি। আমার মতো এমন হাজারো ব্যক্তিকে এনে বিপদে ফেলেছেন তিনি। বিশ্বকাপ উপলক্ষে অন্তত ৬০-৭০ ব্যক্তিকে এভাবে রাশিয়ায় এনেছেন তিনি।’

নোয়াখালীর মাইজদী এলাকার ২৮ বছর বয়সী এ যুবক আরো বলেন, ‘মোটা অংকের অর্থে লোকজন আনার পর কাগজপত্রের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে আরো অর্থ হাতিয়ে নেন শহিদুল। এটাই তার পেশা। মানুষকে বিপদে ফেলা অর্থ দিয়ে এখানে ভোগ-বিলাস করেন তিনি।’ ফখরুল জানান, বিশ্বকাপ শেষে রুশ সরকার ১০ দিন সময় দেবে অবৈধ অভিবাসীদের দেশ ত্যাগের জন্য। তারপর শুরু হবে অভিযান। ওই অভিযানে অবৈধদের ধরে দেশে ফেরত পাঠানো হবে।

জমি বন্ধক রেখে, সুদে টাকা নিয়ে রাশিয়া এসেছিলেন উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্নে। এসে উল্টো বিপদে পড়েছেন ফখরুল। পরিবার টানছে সুদের ঘানি। ভবিষ্যৎ শঙ্কায় হতাশ এ যুবক জানান, পাশের এক হোটেলে ২০-২৫ জন বাঙালি গাদাগাদি করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের অনেকেই শহিদুলের হাত ধরে এখানে এসেছেন।

বাঙালিদের এনে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নেয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে শহিদুল মোবাইল ফোনে বলেন, ‘আমার কোনো ট্রাভেল এজেন্সি নেই। আমি এখানে লোক আনব কীভাবে?’ ফখরুলকে মস্কোতে কে এনেছে? প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তিনি বিষয়টা এড়িয়ে যান। পরে সাংবাদিক সালেহ বিপ্লবকে নিজের বন্ধু পরিচয় দিয়ে এ প্রতিবেদককে তার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন শহিদুল। মস্কোতে একসঙ্গে বসে আলোচনারও প্রস্তাব দেন শহিদুল।

ফখরুলের মতো উন্নত ভবিষ্যতের আশায় রাশিয়া গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন শহিদুলের স্ত্রীর ফুপাতো ভাই মুস্তাফিজুর রহমান সবুজ। ২০১২ সালে শহিদুলের হাত ধরেই রাশিয়া গিয়েছিলেন নোয়াখালীর এ যুবক। তার সেনজেন ভিসাও ছিল। ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর কথা বলে শ্যালকের কাছ থেকে ১ হাজার ডলার ও পাসপোর্ট নেন শহিদুল। বারবার যোগাযোগ করেও পাসপোর্ট ও অর্থ ফেরত পাননি। ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে আউট পাস নিয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হন সবুজ।

সবুজ জানান, ‘আমি শহিদুল ভাইয়ের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেছি, অনুরোধ করেছি কাজ করে দিতে না পারলে আমার পাসপোর্টটা যাতে ফেরত দেয়া হয়। কিন্তু তিনি আমার কাছ থেকে রীতিমতো পালিয়ে বেড়িয়েছেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘তাকে না পেয়ে আমি বারবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি, এসএমএস দিয়েছি। যার স্ক্রিনশট আমার কাছে রয়েছে। কিন্তু তিনি কোনো ধরনের উত্তর দেননি। বাধ্য হয়েই আমি দেশে ফিরে এসেছি।’ শহিদুলের মতো আরো একাধিক ব্যক্তিকে উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়ে হাজারো যুবককে রাশিয়া এনে বিপদে ফেলেছেন শহীদুল। তাদের অন্যতম মোশাররফ হোসেন ও আবুল বশর।

উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়ে দেশ থেকে মানুষ এনে বিপদে ফেলে অর্থ আদায়ের পাশাপাশি মস্কোর বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী বাংলাদেশীদেরও নানাভাবে জটিলতায় ফেলছেন তারা। এ চক্রের হাতে প্রতারিত এমনই এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘শহিদুলের মাধ্যমে নয়, আমি রাশিয়া এসেছি অন্য মাধ্যমে। অতীতে বিভিন্ন সময় শহিদুল আমাকে নানাভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে অর্থ দাবি করেছেন। নইলে বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেয়ার হুমকিও দেয়া হয়েছে। সক্রিয় এ দালাল চক্র দমনে দূতাবাসের উদ্যোগ নেয়া জরুরি। নইলে আমরা বাংলাদেশীরা এভাবে শান্তিতে বসবাস করতে পারব না।’

বিশ্বকাপ চলাকালে রাশিয়ার প্রতিবেশী একাধিক দেশের বর্ডারে আটক হন বেশ কয়েকজন যুবক, যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়। বিশ্বকাপ উপলক্ষে মস্কো আসার পর বিমানবন্দর থেকেও ফেরত পাঠানো হয়েছে একাধিক ব্যক্তিকে।

মস্কোতে স্থায়ী হওয়া বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনায় এসব প্রতারণার সত্যতা মিলেছে। বগুড়া থেকে এসে মস্কোয় ব্যবসা করা জুয়েল এ সম্পর্কে বলেন, ‘তাদের প্রতারণার কারণে দিন দিন এখানে বাংলাদেশীদের বসবাস ও জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়ছে।’ প্রতারণার অনেক ঘটনা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে রুশদের বিরূপ ধারণা তৈরি হচ্ছে।
সূত্র: বণিক বার্তা

আপনার মন্তব্য

আলোচিত