বড়লেখা প্রতিনিধি

০৫ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:২২

বড়লেখায় কলেজছাত্রকে হত্যার অভিযোগ, শিক্ষার্থীদের ক্লাস বর্জন

মৌলভীবাজারের বড়লেখায় কলেজ ছাত্র প্রান্ত দাসকে (১৮) হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে তার পরিবার ও সহপাঠীরা। গত বুধবার (৩১ অক্টোবর) সকালে পিসির বাড়ির পরিত্যক্ত রের জানালার গ্রিলের সাথে মুখ বাঁধা ও দন্ডায়মান অবস্থায় তাঁর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

বড়লেখার বর্ণি এম মন্তাজিম আলী কলেজের একাদশ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র প্রান্ত উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নের বাঘমারা গ্রামের সনত দাসের ছেলে। পরিবারের অনটনের কারণে বর্ণি ইউনিয়নের মিহারী নয়াগ্রামের পিসির বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করত সে।  

পিসির বাড়ির লোকজনের দাবি, গত সোমবার (২৯ অক্টোবর) রাত থেকে থাকে পাওয়া যাচ্ছিল না। হঠাৎ সে নিখোঁজ হয়ে যায়।

এদিকে, এই মত্যুকে কোনোভাবেই আত্মহত্যা মানতে নারাজ তাঁর পরিবার, সহপাঠী ও এলাকার লোকজন। তাঁদের দাবি পিসির বাড়ির লোকজন তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে আত্মহত্যার নাটক সাজিয়েছে।

অন্যদিকে বুধবার ভোররাতের দিকে প্রান্তের মুঠোফোন থেকে বন্ধু ও স্বজনদের কাছে পাঠানো কয়েকটি ক্ষুদেবার্তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে রহস্য। প্রান্তের কলেজের সহপাঠীরা জানিয়েছে, সে সব সময় ইংরেজিতে এসএমএস করত। কিন্তু ওই রাতে তাঁদের কাছে আসা এসএমএসগুলো বাংলাতে। এতে করেই তাঁদের সন্দেহটা আরো গভীর হয়। যে এটা হত্যাকান্ড।

বুধবার ভোররাতে প্রান্তের মুঠোফোন থেকে সহপাঠী অনিকের মুঠোফোনেও একটি ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হয়। তাতে এভাবে লেখা ছিল, “বন্ধুরা তরা সবাই ভালো থাকিছ। হয়তো তোদের সাথে আমার আর দেখা হবে না। কিন্তু তোদের সাথে কাঠানো সময়গুলো পরকালে আমার মনে থাকবে।” একই রকম একটি ক্ষুদেবার্তা যায় তাঁর কলেজের সহপাঠীদের নিয়ে তৈরি করা গ্রুপ “বন্ধুদের ক্যাম্পাস” এ। এই ক্ষুদেবার্তর শেষে লেখা ছিল “বিদায়”।

এদিকে প্রান্ত আত্মহত্যা করেনি, তাকে হত্যা করা হয়েছে- এমনটা দাবি করে তাঁর সহপাঠীরা ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন এবং এর সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির দাবিতে গত চারদিন ধরে ক্লাস বর্জন করে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।

সরেজিমনে গত শনিবার (০৩ নভেম্বর) কথা হয় প্রান্তের সহপাঠী এম মন্তাজিম আলী কলেজের শিক্ষার্থী অনিক দাসের সাথে। অনিক বলেন, ‘প্রান্ত আর আমি একসাথে ক্লাস সেভেন থেকে পড়েছি। বুধবার ভোররাতে ৩টা ১৩ মিনিটের দিকে আমার কাছে একটি মেসেজ আসে। এটা বাংলায় লেখা ছিল। কিন্তু সে সবসময় ইংরেজিতে মেসেজ লিখত। এটা তার লেখা নয়। নিশ্চই খুনিরাই মেসেজ পাঠিয়েছে। সে খুব ভালো ছেলে ছিল। সবসময় হাসিখুশিতে থাকত। কারো সাথে তার কোনো শত্রুতা নাই। এরকম ছেলে আত্মহত্যা করতে পারে না। তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এঘটনার উপযুক্ত বিচার চাই।’

স্থানীয় ফকিরবাজারে কথা হয় জবলু হোসেন নামে এক কলেজ শিক্ষার্থীর সাথে। তিনি বলেন, ‘জীবনে অনেক আত্মহত্যা দেখেছি। কিন্তু এটা আত্মহত্যা মানতে পারছি না। কোনো মানুষই আত্মহত্যা বলে মানতে পারছে না। মুখে বাঁধা। এটা পরিকল্পিত হত্যা মনে হচ্ছে। সুষ্ঠু তদন্ত হলেই প্রকৃত সত্য বের হয়ে আসবে।’

একই রকম বক্তব্য স্থানীয় মন্তাজিম আলী কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি তানভীর আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক সাহেদ আহমদ জিসানের।

শনিবার (০৩ নভেম্বর) বিকেলে প্রান্তের বাড়ি উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নের বাঘমারা গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, প্রান্তের বাবা-মা বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে আছেন। ছেলে প্রান্তের এমন মৃত্যুতে তাঁরা ভেঙে পড়েছেন। এসময় কথা হয় প্রান্তের মা চঞ্চলা রানী দাস এর সঙ্গে।

কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, আমাদের অভাবের সংসার। স্বামী (সনত দাস) স্ট্রোক করেছেন। চলতে পারেন না। আগে শীতলপাটি বিক্রি করে সংসার চালাতেন। পরিবারের ৫ ছেলেমেয়ে রয়েছে। এরমধ্যে প্রান্ত তৃতীয়। বাড়িতে থেকে প্রান্ত সিক্স পর্যন্ত পড়েছে। পরিবারে অস্বচ্ছলতার কারণে আমার ভাগ্নেরো (প্রান্তের পিসতুতো ভাই) তাকে পড়ানোর কথা বলে তাদের বাড়িতে নিয়ে যান। প্রান্ত পড়াশোনার পাশাপাশি আমার ভাগ্নের দোকানও দেখাশোনা করতো। গত সোমবার সুমনের ভাই সুজন ফ্রান্স থেকে ফোন করে বলে, মামি প্রান্তকে নিয়েছিলাম ভালোর জন্য, পড়াশোনা করবে বলে। এখন তার স্বভাব চরিত্র খারাপ হয়ে গেছে। আমার বড় ভাইয়ের (সুমনের) বউয়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে। আমি তাকে বললাম আগামীকাল সকালে প্রান্তকে বাড়িতে নিয়ে আসবো। তখন সুজন বলে, আমি প্রান্তের সঙ্গে গত রোববার কথা বলেছি। তাকে বকাবকি করেছি। বলেছি যদি আমি বাড়িতে থাকতাম তাহলে “কেটে বস্তায় ভরে নদিতে বাসিয়ে দিতাম।” ওইদিন রাতে আমার বড় ছেলে ঘটনাটা জেনে প্রান্তকে আনতে যায়। এরপর থেকে প্রান্তের কোনো খোঁজ মেলেনি। খোঁজে না পেয়ে পরদিন মঙ্গলবার আমার ছেলে শুভ থানা পুলিশকে জানাতে চেয়েছিল। কিন্তু সুমন তাকে জানাতে বারণ করে বলেছে এটা পারিবারিক সমস্যা। আত্মীয়-স্বজন আর লোকজনে শুনলে শরম (লজ্জা)। পরে আমার ছেলে থানায় আর জানায়নি।

মঙ্গলবার রাতে আমার ভাগনি (সুমনের বোন) ফোনে শুভকে জানায়, প্রান্ত তার মোবাইলে মেসেজ ‘বিদায়’ লিখে পাঠিয়েছে। এরপর তার মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল।

বুধবার সকালে সুমন আমার ছেলে শুভকে ফোন করে জানায়, প্রান্ত গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। খবর পেয়ে আমার ছেলে দ্রুত সেখানে গিয়ে দাঁড়ানো অবস্থায় তাকে পায়। তারা নিরপরাধ ছেলেটা হত্যা করেছে। আমি এর বিচার চাই।’

প্রান্তের বড়ভাই শুভ দাস বলেন, ‘আমার ভাইকে পিসিতো ভাইয়েরা মিলে খুন করেছেন। এটা এখন সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। তারা পরিকল্পিতভাবে আমার ভাইকে খুন করেছে।’

তবে প্রান্তের পিসিতো ভাই মিহারী নয়াগ্রামের বাসিন্দা সুমন দাস বলেন, ‘একজনের ছেলে মারা গেছে। স্বাভাবিকভাবে প্রথম অবস্থায় অনেক অভিযোগ উঠানো হবে। ঈশ্বর ছাড়া কেউ জানে না। প্রকৃত ঘটনা টা কি। সপ্তম শ্রেণী থেকে সে আমার বাড়িতে। ওখানে থেকেই লেখাপড়া করত। হঠাৎ সে ঘর থেকে নিখোঁজ হয়। বিষয়টি মামার বাড়িতে জানাই। এরপর বুধবার তাঁর লাশ পাওয়া যায়। সে আত্মহত্যা করেছে না কেউ তাকে খুন করেছে এটা আমরা জানি না। যদি তাকে কেউ হত্যা করে তাকে তবে আমরা তার বিচার চাই। পুলিশ তদন্ত করছে।’

প্রান্তের কলেজের অধ্যক্ষ আসুক আহমদ রবিবার (০৪ নভেম্বর) মুঠোফোনে বলেন, ‘প্রান্ত কখনও আত্মহত্যা করতে পারে না। লাশ দেখে এলাকার অনেকেই বলেছেন, তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার চাই। ঘটনার রহস্য উদঘাটনের দাবিতে শিক্ষার্থীরা চারদিন ধরে ক্লাস বর্জন করে যাচ্ছে। তাদের কোনোভাবেই ক্লাসে ফেরানো যাচ্ছে না।’

বড়লেখা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. ইয়াছিনুল হক বলেন, ‘লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়। প্রান্তের পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে অপমৃত্যু মামলা রজু হয়েছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেলে পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

ছাত্রলীগের মানববন্ধন :
প্রান্ত দাসের মৃত্যু রহস্য উদঘাটনের দাবিতে মানববন্ধন করছে এম মন্তাজিম আলী কলেজ ছাত্রলীগ। শনিবার (৩ নভেম্বর) দুপুরে কলেজ ছাত্রলীগের আয়োজনে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

এতে বক্তব্য দেন স্থানীয় বর্ণি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান এনাম উদ্দিন, উপাধক্ষ্য হেলাল উদ্দিন, আওয়ামী লীগের সভাপতি নিজাম উদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক জুবায়ের হোসেন, জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সুমন আহমদ, বড়লেখা সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি এমরান হোসেন, ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি সুমন দাস, সাধারণ সম্পাদক নাজমুল ইসলাম, মন্তাজিম আলী কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি তানভীর আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক সাহেদ আহমদ জিসান, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক নাহিদ আহমদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাবের হোসেন, জাহেদ আহমেদ, মিজানুর রাহমান মিজান, এস এম সামাদ প্রমুখ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত