সিলেটটুডে ডেস্ক

২৭ নভেম্বর, ২০১৮ ১২:০৬

বাংলাদেশে অস্বাভাবিক গর্ভপাতের কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন

বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়া, কৃষি উৎপাদন হ্রাস, স্বাস্থ্য-সমস্যা ও বাস্তুচ্যুতিসহ বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে বাংলাদেশকে।

শুধু তাই নয়, বিবিসির এক প্রতিবেদন বলছে, এই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের পূর্বাঞ্চলের উপকূল এলাকাগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হারে গর্ভপাতের ঘটনা ঘটছে।

সোমবার (২৬ নভেম্বর) বিবিসির ওই প্রতিবেদনে কক্সবাজারের চকোরিয়া এলাকার বেশকিছু ভুক্তভোগীর কথাও তুলে ধরা হয়। তাদের একজন চকোরিয়ার ফেইল্লাপাড়া গ্রামের আল-মুন্নাহার। তিনি তিন ছেলে সন্তানের জননী। তিনি একটি মেয়ের আশায় ছিলেন, কিন্তু তার গর্ভপাত ঘটে।

আল-মুন্নাহারের মতো ফেইল্লাপাড়ার গ্রামের অনেক নারীই এ ধরনের দুর্ঘটনার শিকার। তিনি জানান, নব্বইয়ের দশকে গ্রামে প্রায় সবই ছিল ধানি জমি। কিন্তু জমির লবণাক্ততার ফলে এখানকার সবাই এখন চিংড়ি ঘের অথবা লবণ উৎপাদনে জড়িয়ে পড়ছেন। এখানে কৃষিজ কিছুই জন্মায় না।

ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশর (আইসিডিডিআর,বি) বিজ্ঞানী ড. এস এম মনজুর হানিফি বলেন, এখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। জমিগুলোর ক্ষতি দৃশ্যমান। তবে শরীরের ক্ষতিটা আমরা এখনও দেখতে পাই না।

চকোরিয়ায় আইসিডিডিআর,বি‘র বিজ্ঞানীরা সেখানে একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক এলাকার মানুষদের পর্যবেক্ষণ করছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গত ৩০ বছরে যেসব ছোট ছোট পরির্ব্তন এসেছে, সেগুলোও তারা বুঝতে পারছেন তাদের গবেষণায়।

আইসিডিডিআর,বি’র গবেষণায় তালিকাভুক্ত ছিলেন ১২ হাজার ৮৬৭ জন গর্ভধারিণী। ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পরিচালিত এই গবেষণায় দেখা যায়, সমুদ্র উপকূলের ২০ কিলোমিটার এলাকা এবং সমুদ্র তটরেখা থেকে সাত মিটার উচ্চতায় যারা বসবাস করেন, তাদের গর্ভপাতের ঝুঁকি অন্যদের চাইতে ১ দশমিক ৩ গুণ বেশি। একই সময়ে চাঁদপুরের মতলবেও একই বিষয়ে গবেষণা চালান বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, এই গবেষণায় সমতল এলাকা হিসেবে চাঁদপুরের সঙ্গে উপকূলীয় এলাকা হিসেবে চকোরিয়ার পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। মতলবে যেখানে ৮ শতাংশ নারীর গর্ভপাত ঘটে, সেখানে চকোরিয়ায় এর পরিমাণ ১১ শতাংশ।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, গর্ভপাত কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। তবে লবণের আধিক্য এই সমস্যাকে প্রকট করে তুলেছ। খাবার পানির সঙ্গে যে পরিমাণ লবণ নারীদের দেহে যাচ্ছে, তাই অতিরিক্ত গর্ভপাতের কারণ।

এসব অঞ্চলে জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। সাগরের লোনা পানি নদী ও অন্যান্য জলাধারে মিশে নষ্ট করেছে মাটির উর্বরতা। একইসঙ্গে নষ্ট করছে মাটির নিচে পানির স্তর বা অ্যাক্যুইফায়ার। টিউবওয়েলের সাহায্য সেসব স্তর থেকেই পান করার জন্য পানি তোলা হয়ে থাকে।

ফেইল্লাপাড়া গ্রামে টিউবওয়েলের পানি লালচে রঙ ধারণ করেছে এবং তা লবণাক্ত। কিন্তু তারপরেও সে গ্রামের লোকেরা ধোয়া-মোছা, রান্না-বান্না বা গোসলের জন্য সেই পানিই ব্যবহার করছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য-সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, একজন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দেহে দৈনিক ৫ গ্রামের বেশি লবণ প্রবেশ করা উচিত নয়। চকোরিয়ায় যারা উপকূলীয় অঞ্চলে বাস করছেন, তাদের শরীরে দৈনিক ১৬ গ্রাম লবণ প্রবেশ করছে পানীয় জলের মাধ্যমে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে তিন গুণ বেশি।

দেহে অতিরিক্ত লবণের ফলে, দুশ্চিন্তা, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ (স্ট্রোক), হার্ট অ্যাটাক ও গর্ভপাতসহ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হয়। যদিও স্থানীয়দের এ নিয়ে কিছুই করার নেই এবং তাদের ধারণাও নেই তারা কী ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ভুগছেন।

স্থানীয় আরেক বাসিন্দা জানতারা (৫০) বলেন, তিনি এ গ্রামেই জন্মেছেন। কখনও গ্রাম ছেড়ে যাননি এবং ফেইল্লাপাড়া গ্রাম ছাড়ার কোনো ইচ্ছাই তার নেই। তিনি বলেন, এখানে আমার জীবন কেটেছে। কোথায় যাব? আমাদের সেই সামর্থ্য নেই।

তবে অনেক পরিবারই নিম্নাঞ্চল ছেড়ে পাহাড়ি এলাকায় আশ্রয় নিচ্ছেন। এজন্য তাদের ঘুষও দিতে হচ্ছে। কাজল রেখা নামে এক নারী বলেন, বনরক্ষীদের ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে তিনি পরিবার নিয়ে তিন বছর আগে পাহাড়ে বসতি গড়েছেন।

তিনি বলেন, পানির কারণে আমার ছেলেমেয়েরা জ্বরে ভুগত। বন্যার পরপরই এ সমস্যাটা বেশি হতো। এখন তিনি ভালো আছেন বলে জানান।

ড. হানিফি চকোরিয়ার পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, দিনকে দিন এসব খারাপ হবে। সবাই পরিবেশের ঝুঁকির কথা ভাবে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে অনেক অর্থও ব্যয় হচ্ছে। তবে জনস্বাস্থ্যের বিষয়ে কেউ ভাবছে না।

তথ্যসূত্র: বিবিসিডটকম বাংলা।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত