নিউজ ডেস্ক

২৩ ডিসেম্বর, ২০১৪ ২২:০৭

বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুরা জাতীয় বীর: ট্রাইব্যুনাল

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় দিতে গিয়ে এভাবেই রাষ্ট্রকে জাগতে বলল আদালত; একাত্তরের বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের সম্মান আর স্বীকৃতি দিয়ে ‘৪২ বছরের অমানবিক ভুল’ শুধরে নিতে বলল বাঙালি জাতি ও সমাজকে।

হবিগঞ্জের কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের যুদ্ধাপরাধ মামলার রায়ে আদালতের এই পর্যবেক্ষণ এসেছে।

একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাতে নির্যাতিত আড়াই লাখ বীরাঙ্গনা ও তাদের গর্ভে জন্ম নেওয়া যুদ্ধশিশুদের আদালত উল্লেখ করেছে ‘জাতীয় বীর’ হিসাবে।

“যুদ্ধের সময় ধর্ষণের শিকার নারীরা অবশ্যই এ মাটির মহীয়সী মা ও বোন। তারা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা আমাদের গর্ব। নিজেদের সর্বোচ্চ সম্মান বিসর্জন দিয়ে সাহসের সঙ্গে তারাও আমাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। জাতি তাদের এবং তাদের এ ত্যাগকে স্যালুট জানায়।”

বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মঙ্গলবার এ রায় ঘোষণা করে, যাতে সাত অভিযোগে কায়সারকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

এই সাত যুদ্ধাপরাধের মধ্যে হত্যা, গণহত্যা ছাড়াও হীরামনি ও মাজেদা বেগম নামের দুই নারীকে ধর্ষণের ঘটনা রয়েছে, যাদের কায়সার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন।

এই দুই বীরাঙ্গনার মধ্যে মাজেদা এবং তার গর্ভে জন্ম নেওয়া যুদ্ধশিশু শামসুন্নাহার এ মামলায় সাক্ষ্যও দিয়েছেন।

এই প্রথমবারের মতো অন্য অপরাধের পাশাপাশি ধর্ষণের দায়ে কোনো যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দিল ট্রাইব্যুনাল। ৪৮৪ পৃষ্ঠার এই রায়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিকে ‘দমনের অস্ত্র হিসাবে’ ধর্ষণের ব্যবহার এবং সেই পাশবিকতার শিকার নারীদের দুর্দশার কথা বার বার এসেছে।

বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের প্রাপ্য সম্মান দেখাতে তাদের দুর্দশা কমানোর জন্য সরকার দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলেও রায়ে আশা প্রকাশ করেছে ট্রাইব্যুনাল।

ক্ষতিপূরণ স্কিম চালুর পাশাপাশি বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের তালিকা করে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে তাদের পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করা এবং যারা ইতোমধ্যে মারা গেছেন, তাদের মরণোত্তর সম্মান জানিয়ে স্বজনদের শোক ও দুর্দশা লাঘবের ব্যবস্থা নিতে রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হতে বলেছে আদালত।

“তাদের এ আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতে, তাদের ক্ষত সারাতে, যে অমানবিক ভুল তাদের প্রতি করা হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ আদায় করতে জাতি ও সমাজকে  এগিয়ে আসতে হবে।”

রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “সমাজ ও জাতিকে আরো মনে রাখতে হবে যে, বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুরা যুদ্ধে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত, মুক্তিযোদ্ধারা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সমাজ ও জাতির কোনো স্বীকৃতি ছাড়াই এখনো সেই আত্মত্যাগের জন্য মানসিক ক্ষত বয়ে চলেছেন বেঁচে থাকা বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুরা। ধর্ষণের শিকার এসব নারীদেরও মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দেওয়া উচিৎ, তাদের অব্যক্ত বেদনাকে আর অবহেলা করা যায় না।”

নির্যাতিত এই নারীদের অনেকেই সে সময় গর্ভবতী হয়ে পড়েন, জন্ম নেয় অনেক যুদ্ধশিশু। অনেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই নারীদের সম্মান জানান তাদের বীরাঙ্গনা বলে। চলতি বছর নির্যাতিত এই নারীদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার।

রায়ে বলা হয়, “স্বাধীনতার পর চার দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। কিন্তু যুদ্ধের সময় ধর্ষণের শিকার নারী ও যুদ্ধশিশুরা দীর্ঘমেয়াদী মানসিক অসুস্থতা, সম্মানহানী ও লজ্জার অভিজ্ঞতা আর নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি নিয়ে বেঁচে আছেন, যা তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনকে ব্যাহত করছে। সারাজীবন ধরেই তাদের এ ক্ষত বহন করতে হচ্ছে, কারণ সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকেও তারা কোনো সহযোগিতা পান না।

“শত হাজার ধর্ষণের শিকার নারী এখনো সামাজিকভাবে অপাঙক্তেয় এবং তাদের খবর রাখে না কেউ। বীরাঙ্গনাদের বিষয়ে সম্মিলিতভাবে উচ্চকণ্ঠ হতে হবে জাতিকে। তারাও সাহসী মুক্তিযোদ্ধা, যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজেদের সম্ভ্রম বিসর্জন দিয়েছেন। স্বাধীনতার পরপরই তাদের ‘বীরাঙ্গনা’ অভিহিত করে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের তাদের আত্মত্যাগকে সম্মান জানানোয় আমরা সাধুবাদ জানাই।”

প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে সৈয়দ কায়সারের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে হীরামনি, মাজেদা ও শামসুন্নাহারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছিল।

রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছে, সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন বেসরকারি ও সামাজিক সংগঠন বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের সম্মান দেখাতে তাদের দুর্দশা কমানোর জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলে আদালত আশা করে।

“তারা যে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছেন, তার ভয়াবহতা হ্রাস করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু তার পরও তাদের অবহেলা ও অযত্নে ফেলে রাখার কোনো অবকাশ নেই, কারণ তা হবে সমাজ, জাতি এবং আমাদের বিবেকের মারাত্মক অপমান।

“শুধু ধর্ষণের শিকার নারীদের ক্ষত দূর করার জন্য নয়, বরং আমাদের সমাজ ও জাতির ক্ষত সারিয়ে তোলার জন্যও এটি করা প্রয়োজন। তাই, তাদের মানসিক-সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য বিস্তৃত ও সুশৃঙ্খল মনোযোগ ও ব্যবস্থার ওপর জোর দিচ্ছি আমরা।”

 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত