সিলেটটুডে ডেস্ক

১৮ আগস্ট, ২০১৫ ২৩:৪৪

আমাকে চোখ বেধে মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে : প্রবীর সিকদার

ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানায় আনার পর তাকে চোখ বেধে মানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে (আইসিটি) দায়ের করা মামলায় গ্রেফতারকৃত সাংবাদিক প্রবীর সিকদার। এসপি-ওসির উপস্থিতিতে বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিয়ে মামলার সপক্ষে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

প্রবীর সিকদারের অভিযোগ, তিনি পঙ্গু, একটি পা নেই। তাই বেশিক্ষণ বসে বা দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। অথচ ঢাকা থেকে গ্রেফতার করে কোতোয়ালি থানায় আনার পর তাকে বসতে দেওয়া হয়নি। একবার বসার জন্য চেয়ার দিয়েও পরে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে তাকে দাঁড়িয়ে থেকে ব্যথা ও যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতেও দেওয়া হয়নি।

মঙ্গলবার (১৮ আগস্ট) দুপুরে তাকে রিমান্ডে নিতে পুলিশের আবেদনের শুনানি চলাকালে আদালতে এসব অভিযোগ করেন প্রবীর সিকদার। শুনানি শেষে তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ফরিদপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ১নং আমলি আদালতের বিচারক হামিদুল ইসলাম। প্রবীর সিকদারকে দশদিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানিয়েছিল পুলিশ।

রোববার (১৬ আগস্ট) রাতে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করে ফরিদপুরে নিয়ে যাওয়ার পর প্রবীরকে কোতোয়ালি থানায় রাখা হয়েছিল। সোমবার সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায় থানা থেকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। মাঝের কয়েক ঘণ্টায় কোতোয়ালি থানায় মানসিক নির্যাতন চালানোর অভিযোগ তুলে প্রবীর আদালতকে বলেন, এসপি-ওসির উপস্থিতিতে আমাকে বলা হয়েছে, একটি পা নেই, আপনাকে অন্য একটি পাও হারাতে হবে। নিরাপত্তা চেয়েছিলেন, প্রয়োজনে সারা জীবন জেলের ভেতরে রেখে নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

জেলে পচানোর হুমকি দিয়ে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার সপক্ষে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

প্রবীর সিকদার বলেন, আমি জীবনহানির শঙ্কায় আছি। রিমান্ডে দেওয়া হলে শঙ্কা আরও বাড়বে। এ কারণে রাষ্ট্রপক্ষের রিমান্ড আবেদন নামঞ্জুর করে জামিনের আবেদন জানান তিনি। জামিন না হলে প্রয়োজনে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদেরও আরজি জানান। তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট আলী আশরাফ নান্নু ও অ্যাডভোকেট মাসুদ রানাও একই আরজি জানিয়ে রিমান্ড আবেদন বাতিল ও জামিনের আবেদনের সপক্ষে শুনানি করেন।

আদালত অবশ্য এসব আবেদন নামঞ্জুর করে তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। আগামী ২২ সেপ্টেম্বর এ মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে।

অন্যদিকে রিমান্ড আবেদনের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন আদালতের এপিপি অ্যাডভোকেট অনিমেষ রায়, অ্যাডভোকেট জাহিদ বেপারী, কোর্ট পরিদর্শক সুবির দে প্রমুখ।

বেলা সাড়ে এগারটার পর ফরিদপুর জেলা কারাগার থেকে এনে প্রবীর সিকদারকে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) আদালতে হাজির করা হয়।

আদালতকক্ষে উপস্থিত ছিলেন প্রবীর সিকদারের স্ত্রী অনিতা সিকদার ও ছোট ছেলে পুলক সিকদার। অনিতা সিকদার সাংবাদিকদের বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবীরের পরিবারের সদস্যদের অসহনীয় নির্মমতা সহ্য করতে হয়েছে। জীবন দিতে হয়েছে দেশের জন্য। পরিবারের সদস্যদের জীবনের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশে প্রবীরের জন্য এটাই পুরস্কার ছিল?’

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সন্তান ও সন্ত্রাসী হামলায় পঙ্গু সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ জেলগেটেই সম্পন্ন করার আবেদনও জানান তিনি।

শারীরিকভাবে চলাচলে অক্ষম প্রবীরকে আটকের পর কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়নি বলেও দাবি করেন অনিতা। তিনি অভিযোগ করেন, থানা হাজতে বেশিরভাগ সময়ই প্রবীরকে একপায়ের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। এমনকি প্রয়োজনীয়ও ওষুধও তাকে দেওয়া হয়নি।

সুবিচারের মধ্য দিয়ে স্বামীর মুক্তির জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

এর আগে সোমবার (১৭ আগস্ট) সন্ধ্যায় আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। সে সময় তাকে দশদিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানান মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মিরাজুর রহমান। সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ১নং আমলি আদালতের বিচারক হামিদুল ইসলাম প্রবীর সিকদারকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়ে মঙ্গলবার রিমান্ড শুনানির দিন ধার্য করেন।

প্রবীর সিকদার অনলাইন নিউজপোর্টাল উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ, বাংলা দৈনিক বাংলা ৭১ এবং উত্তরাধিকার নামের ত্রৈমাসিক পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। রাজধানীর ইন্দিরা রোডে পত্রিকাগুলোর কার্যালয়।

ফেসবুক স্ট্যাটাসে মন্ত্রীর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অভিযোগে সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনের ৫৭ (২) ধারায় কোতোয়ালি থানায় মামলাটি দায়ের করেছেন ফরিদপুরের আওয়ামী লীগ নেতা, জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের উপদেষ্টা এপিপি অ্যাডভোকেট স্বপন কুমার পাল।

রোববার বিকেলে তিনি ওই মামলা করার পর রাতে প্রবীর সিকদারকে তার রাজধানীর ইন্দিরা রোডের কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করে ফরিদপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ওই মামলায় প্রবীর সিকদারকে গ্রেফতার দেখানো হয়।

লিখিত এজাহারে বাদী অভিযোগ করেন, গত ১০ আগস্ট বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে ‘আমার জীবন শংকা তথা মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী থাকবেন’ শিরোনামে জনসমক্ষে একটি স্ট্যাটাস পোস্ট করেন। এই পোস্টটি পড়ে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয় যে, উক্ত প্রবীর সিকদার ইচ্ছাকৃতভাবে গণমানুষের প্রিয় নেতা মাননীয় মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন এমপি সম্পর্কে মিথ্যা অসত্য লেখা লিখে সেটি তার নিজস্ব ফেসবুকে পোস্ট করে মাননীয় মন্ত্রীর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছেন এবং উক্ত লেখাটি জনসমক্ষে প্রকাশের মাধ্যমে উস্কানি প্রদান করে শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছে মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়কে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন। এর ফলে মাননীয় মন্ত্রীর মানহানি ঘটেছে। যা একটি ফৌজদারি অপরাধ।

মামলার আরজিতে আরও বলা হয়, ওই ফেসবুক স্ট্যাটাসে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন দাবি করে প্রবীর সিকদার বলেন- তার মৃত্যু হলে স্থানীয় সরকার, সমবায় ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, বিতর্কিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসের ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার দায়ী থাকবেন।

তবে পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রাজধানীর শেরেবাংলানগর থানায় নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে ব্যর্থ হয়ে প্রবীর সিকদার ওই স্ট্যাটাস দেন।

পরিবার বলছে, রোববার সন্ধ্যায় প্রবীর সিকদারকে নিয়ে যান আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তার ইন্দিরা রোডের কার্যালয় থেকে শেরেবাংলানগর থানা পুলিশের একটি দল প্রবীর সিকদারকে নিয়ে যায়। পরে তাকে মিন্টো রোডে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হলেও রাতেই তাকে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।

সাংবাদিক প্রবীর সিকদার মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সন্তান। তার বাবাসহ পরিবারের ১৪ জন একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শহীদ হয়েছিলেন। দৈনিক জনকণ্ঠের ফরিদপুরের নিজস্ব সংবাদদাতা থাকাকালে পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সেই রাজাকার’ কলামে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুসা বিন শমসেরের বিতর্কিত ভূমিকার বিবরণ তুলে ধরেন তিনি। এরপর ২০০১ সালের ২০ এপ্রিল সন্ত্রাসী হামলায় গুরুতর আহত হন। বর্তমানে একটি পা হারিয়ে পঙ্গু জীবন যাপন করছেন তিনি।

ফরিদপুরের কানাইপুরের ঐতিহ্যবাহী জমিদার সিকদার বাড়ির সন্তান প্রবীর সিকদার দৈনিক জনকণ্ঠের ফরিদপুরের নিজস্ব সংবাদদাতা ও পরে পদোন্নতি পেয়ে স্টাফ রিপোর্টার পদে কর্মরত ছিলেন দীর্ঘদিন। পরে ঢাকায় এসে দৈনিক সমকাল ও দৈনিক কালের কণ্ঠে কাজ করেছেন তিনি। উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত