দেবকল্যাণ ধর বাপন

২৩ জুলাই, ২০১৯ ১৮:৫৪

উপেক্ষা আর বঞ্চনাই নিত্যসঙ্গী ব্যাডমিন্টন তারকাদের

নানা ক্ষেত্রে এগিয়ে চলছে দেশের ক্রীড়াঙ্গন। আসছে সাফল্যও। আর্থিক সচ্ছলতা আসছে খেলোয়াড়দেরও। এ ক্ষেত্রে যেন ব্যতিক্রম ব্যাডমিন্টন। ব্যাডমিন্টন তারকারা থেকে যাচ্ছেন উপেক্ষিত। জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হলেও অর্থ কষ্টে ভুগতে হচ্ছে তাদের।  জাতীয় ব্যাডমিন্টন তারকারাও গাঁটের টাকা দিয়ে অনুশীলনের ব্যয় মিটাতে হয় বলে জানা গেছে।

ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়রা জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যে প্রাইজমানি পান   তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি খরচ হয় তাদের অনুশীলনে। এমন কি কয়েক বছর ধরে সম্মানীও পাচ্ছেন না জাতীয় দল থেকে।  জাতীয় পর্যায়ের শীর্ষ নারী ও পুরুষ বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হওয়া শাটলার মো. সালমান খান ও শাপলা আক্তার জানিয়েছেন এমন অপ্রাপ্তি আর বঞ্চনার কথা।

২০১৭ সালে ক্লিক ইন্টার ইউনিভার্সিটি চ্যাম্পিয়নশিপে সিঙ্গেলস ও ডাবলসে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ব্যাডমিন্টন যাত্রা শুরু হয় শাটলার সালমান খানের। তিনি সবশেষ ২০১৯ সালে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত মেয়র-৩৬তম জাতীয় ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপের পুরুষ একক ইভেন্টের চ্যাম্পিয়ন হন। অন্যদিকে ২০০৩ সালে শিশু একাডেমির আয়োজনে ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতায় শিরোপা জিতে শুরু শাপলা আক্তারের। তিনিও সবশেষ এ বছর মেয়র-৩৬তম জাতীয় ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপের নারী ইভেন্টের ত্রিমুকুট (একক, দ্বৈত ও মিশ্র) বিজয়ী।

দুইজনই খেলছেন জাতীয় দলেন হয়ে। এ সুবাদে দুইজনেরই রয়েছে অগণিত ভক্ত-শুভানুধ্যায়ী। রয়েছে নিজ নিজ এলাকায় পরিচিতি ও সম্মান। কিন্তু নিজ এলাকার লোকজন তাদেরকে মূল্যায়ন করলেও উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছেন জাতীয় পর্যায়ে। এনিয়ে আক্ষেপেরও কমতি নেই দুইজনের মধ্যে।

এ ব্যাপারে সালমান খান বলেন, “বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর এবং জাতীয়  দলে খেলার পরও মায়ের কাছে টাকা চাইতে হয় যে আম্মু টাকা দাও শাটেল/খেলার জুতো কিনবো। কেনো না গত ২ বছর থেকে সরকারিভাবে সম্মানী দেয়া হয়নি জাতীয় দল থেকে। নিজের জেলা দলের হয়ে অংশগ্রহণ করলাম জাতীয় টুর্নামেন্ট এ। চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় পর জেলার সংবর্ধনা পেলাম। পেলাম বুকভরা ভালোবাসা আর একটা ক্রেস্ট। ঐ ভালোবাসা আর ক্রেস্ট দিয়ে কি চলে?”

তিনি আরও বলেন, “২০১৮ সালে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য ২০ হাজার টাকা ও ২০১৯ সালে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা প্রাইজমানি দেয়া হয়। দুইবারই টাকার সাথে দেয়া হয় ছোট একটা ক্রেস্ট। কিন্তু আমি এইবার যে প্রাইজমানি পেয়েছি তার থেকেও বেশি  টাকায় নিজের মোবাইল বিক্রি করে শাটল কিনে ট্রেনিং করছি ঐ টুর্নামেন্টের জন্য। আমি সেই ২০১২ সাল থেকে ট্রেনিং করছি। সাত বছর ধরে ট্রেনিং করছি।”

তিনি আক্ষেপ করে আরও বলেন, “ব্যাডমিন্টনে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর পত্রিকার ছোট একটা ছবি দিয়ে কোনোরকমে একটা নিউজ আসে। কিন্তু একটা মাডার মামলার আসামির নিউজ বড় ছবি দিয়ে পত্রিকার প্রথম পেজে আসে। কিন্তু কেনো? ব্যাডমিন্টন খেলাধুলা কি এতই খারাপ ?”

কিন্তু এতকিছুর পরও কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুলেন নি দুইবারের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ বিজয়ী সালমান খান। তিনি জাতীয় দলের ও আঞ্চলিক ব্যাডমিন্টন একাডেমির সতীর্থদের ধন্যবাদের পাশাপাশি পরিবার ও তার কোচ শিব্বির স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন।

এদিকে শীর্ষ নারী শাটলার শাপলা আক্তার বলেন, “২০০৩ সালে শিশু একাডেমির আয়োজনে ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতায় শিরোপা জেতা দিয়ে শুরু আমার। ২০০৭ ও ২০০৯ সালে পাই ত্রিমুকুট (একক, দ্বৈত ও মিশ্র)। কিন্তু ২০১০ সাল আমার জন্য খারাপ যাচ্ছিল। ভালো ফল হচ্ছিল না। তখন ফেডারেশনের কয়েকজন কর্মকর্তা ও সতীর্থদের আচরণ অনেক খারাপ ছিল। আমার উদ্দেশ্যে কটু মন্তব্য করছিলেন তারা। অথচ আগের বছর সাফল্য পাওয়ার পর আমাকে নিয়ে তখন উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মতো। এক বছরের মধ্যে তাদের আচরণ পাল্টে যেতে দেখে আমি খুব কষ্ট পাই। তখন ব্যাডমিন্টন ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলাম। কিন্তু এই কঠিন সময়ে পাশে পাই ফেডারেশন কর্মকর্তা অহিদুজ্জামান রাজুকে। তাই আমাকে আর ব্যাডমিন্টন ছাড়তে হয়নি।”

শাপলা বলেছেন, “সমালোচনা সহ্য করা যায়, কিন্তু কটু কথা না। তখনকার কর্মকর্তা ও বর্তমানে আমার স্বামী আমাকে নতুন করে প্রেরণা না জোগালে হয়তো আজ আমি ক্রীড়াঙ্গনেই থাকতাম না। তখনই সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলে ব্যাডমিন্টন কোর্টে থেকে যাই। এখনও আছি বলেই আজ এত সাফল্যের দেখা পাচ্ছি।

ক্যারিয়ারে সিনিয়র ইভেন্টে ত্রিমুকুট জেতার রহস্য নিজেই জানালেন এই শাটলার, “কঠোর পরিশ্রমের কারণে আজ আমি এই পর্যন্ত এসেছি, একের পর এক সাফল্য পাচ্ছি। আমি মনে করি ভালো কিছু করতে হলে সাধনার বিকল্প নেই। এছাড়া আমার স্বামী নিজেও একজন জাতীয় পর্যায়ের কোচ। তার কোচিংই মূলত আমাকে এই পর্যন্ত উঠে আসতে সহায়তা করেছে।”

পরিশ্রম করে আগামীতেও ব্যাডমিন্টনের জগতে টিকে থাকতে চান ২৬ বয়সী এই শাটলার। খেলার পাশাপাশি তাইতো কোচিং কোর্সও করে যাচ্ছেন, “যতদিন পারবো খেলে যাবো। যদিও ফিটনেসের ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। খেলার পাশাপাশি কোচিং কোর্সও করে যাচ্ছি। লেভেল-ওয়ান কোর্স করেছি। সামনে কোচ হিসেবে কাজ করার ইচ্ছা। ব্যাডমিন্টন আমার রক্তে মিশে আছে। এখান থেকে এখন দূরে থাকার কথা চিন্তাই করতে পারি না।”

ঘরোয়া পর্যায়ে দেশের শাটলাররা ভালো করলেও আন্তর্জাতিক মঞ্চে সাফল্য খুব একটা নেই। দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে সর্বোচ্চ ব্রোঞ্জ জিতে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। সুযোগ সুবিধা কম বলেই এমনটা হচ্ছে মনে করেন শাপলা, “আমাদের এখানে প্রতিভার কোনও অভাব নেই। কিন্তু সমস্যা হলো, নিবিড় অনুশীলন আর পর্যাপ্ত সুবিধার অভাব আছে। যে কারণে একটা পর্যায়ে গিয়ে থেমে যেতে হচ্ছে। ফেডারেশন যদি আরও সক্রিয় থাকতো, যদি নিয়মিত লিগ আয়োজনের পাশাপাশি খেলোয়াড়রা উচ্চতর প্রশিক্ষণ পেতো, আর বেশি বেশি আন্তর্জাতিক আসরে খেলতে পারলে হয়তো ব্যাডমিন্টনে সাফল্য পাওয়ার সুযোগ তৈরি হতো।”

ব্যাডমিন্টনে মেয়েরা প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না, সংখ্যাও খুব কম। এনিয়ে হতাশ শাপলা, “ব্যাডমিন্টনে নতুন করে উঠে আসা মেয়েদের সংখ্যা কম।” তার কারণ বললেন শাপলা, “কেননা ব্যাডিমিন্টন খেলে একটি মেয়ের পক্ষে ক্যারিয়ার গড়া কঠিন। এছাড়া খেলাটি ব্যয়বহুল। লিগ হয় না ঠিকমতো। ছেলেদের মতো মেয়েদের দেশের আনাচে-কানাচে খেলার সুযোগ নেই, যেখান থেকে পারিশ্রমিক পাওয়ার সুযোগ আছে। এছাড়া ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের পরিবেশও ততটা সহায়ক না। আমি অনেক আগে থেকে শুরু করেছি। তাই এর মায়ায় পড়ে গেছি বলতে পারেন। এজন্য এখন ছেড়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করি না।”

আপনার মন্তব্য

আলোচিত