মতিউর রহমান মুন্না, নবীগঞ্জ

৩১ জুলাই, ২০১৬ ১৮:৫৩

নবীগঞ্জে প্রাথমিক বিদ্যালয় নিয়ে দুই জেলার মধ্যে টানাপোড়ন

অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ, শিক্ষকরা আসেন ছুটি দেওয়ার জন্য

নবীগঞ্জ উপজেলার লোগাঁও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নিয়ে দুই জেলার টানাপোড়েনে শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। শিক্ষকদের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অহেতুক আইনি জটিলতায় ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ।

শিক্ষকদের অনুপস্থিতি, ঠিক সময়ে না আসা, নির্দিষ্ট সময়ের আগে ছুটি দিয়ে চলে যাওয়া এমনকি উপবৃত্তির টাকা বিতরণেও নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে শিক্ষার্থীসহ অভিভাবক মহলে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হলেও সমস্যাটির কোনো সমাধান হচ্ছে না। এর দায় কেউই নিতে রাজি নন। নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকবেন এবং ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি দায়িত্বশীল হবেন এমন আদর্শবান শিক্ষক চান এলাকাবাসী।

জানা যায়, ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়টি হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার গজনাইপুর ইউনিয়নের লোগাঁও গ্রামের বিয়ানীবাজারে অবস্থিত। ছাত্র-ছাত্রী সবাই এ গ্রামেরই। তবে এ বিদ্যালয়ের দাপ্তরিক সকল কার্যক্রম মৌলভীবাজার শিক্ষা অফিসের আওতাধীন। কিন্তু এর অবস্থান হবিগঞ্জ জেলায় হওয়ায় মৌলভীবাজার জেলার শিক্ষকেরা এখানে আসতে চান না। আবার মৌলভীবাজার অফিসের আওতাধীন হওয়ায় হবিগঞ্জ জেলার শিক্ষকদের এখানে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে এই টানাপোড়েনে বিদ্যালয়টি চলছে।

মৌলভীবাজার থেকে শিক্ষকরা কোন কোন দিন সকাল ১১টায় আবার কোন কোন দিন দুপুর ১২টায় আসেন। দেরী করে আসলেও শিক্ষকরা আবার দুপুর ২টা বা আড়াইটায় ছুটি দিয়ে চলে যান এমন অভিযোগ স্থানীয়দের। এই বিদ্যালয়ে তিন জন শিক্ষক নিয়োগ থাকলেও এক সাথে কোন দিন তিন জন আসেননি। তারা তাদের রুটিন অনুযায়ী পালাক্রমে আসেন।

এসব অভিযোগের প্রমাণ মিলে রবিবার (৩১ জুলাই) সরেজমিনে উক্ত বিদ্যালয়ে গিয়ে। সকাল ১০টা ২০ মিনিটে বিদ্যালয়ে গেলে দেখা যায় ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাসে হাজির কিন্তু কোন শিক্ষকের খবর নেই। এ সময় ৫ম শ্রেণির ছাত্র ইমন আহমেদকে পতাকা টানানোসহ বিভিন্ন কাজ করতে দেখা যায়। ইমনের সাথে আলাপকালে সে বলে, “স্যাররা আমারে (আমাকে) স্কুলের চাবি দিয়া গেছইন (দিয়ে গেছেন)। স্যার কইছই (বলেছেন) তারা আওয়ার (আসার) আগ পর্যন্ত আমি ওয়ান-টু‘র ছাত্র ছাত্রীরে ক্লাস করাইতাম।”। ৫ম শ্রেণীর ছাত্র ইমনের কথা মতো বুঝা গেল শিক্ষকরা বিদ্যালয়ের দায়িত্ব তাকে দিয়ে গেছেন। শিক্ষকরা আসার আগ পর্যন্ত ইমনই যেন শিক্ষক!

বেলা যখন ১০টা বেজে ৪৫ মিনিট, তখন আসেন বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রিপন চন্দ্র পাল। বাড়ী দূরে, রাস্তা খারাপ তাই ঠিক সময়ে হাজির হতে পারেননি বলে জানান তিনি। এর ১৫ মিনিট পর অর্থাৎ ঠিক ১১ টায় বিদ্যালয়ে এসে হাজির হন প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) সাচ্ছু মিয়া। এ ভাবেই চলছে লোগাঁও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। আবার, ১১টার সময় অফিস কক্ষ খোলার পরে চোখে পড়েনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোন ছবি যা সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে থাকা বাধ্যতামূলক।

এছাড়াও উপবৃত্তির টাকা বিতরণেও নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে, ঐ গ্রামের বাসিন্দা জালাল মিয়া ও রাখাল বৈদ্য ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ছাত্র-ছাত্রীরা নিয়মিত উপস্থিত হয়, উপবৃত্তির কোন কার্ডে ২৪ শত টাকা ও কোন কার্ডে ১২ শত লেখা ছিল। কিন্তু উক্ত কার্ডে স্বাক্ষর নেন শিক্ষকরা তাও নিজ স্কুলেই। কিন্তু ৩ শত টাকা করে শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দিয়েছেন শিক্ষককরা। এর কারণ হিসেবে তারা দেখান অনুপস্থিতি। এদিকে বিদ্যালয় মেরামতের জন্য ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ হলেও এর কোন হদিস নেই। এ ব্যাপারে প্রধান শিক্ষক বললেন, স্লিপ জমা দেওয়া হয়েছে। খুব শীঘ্রই কাজ হবে।

ওই গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রূপ নামের এক অভিভাবক বলেন- “আমার ছেলে ও মেয়েরে আমরার লোগাঁও প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করার লাগি (জন্য) গত বছর স্কুলে নিয়া গেছলাম (যাই), তখন স্যাররা কইলা (বলেন) তারার বয়স অইছেনা (হয়নি) তারারে আগামী বছর নিয়া আইয়ো (আসবেন) তে ভর্তি করমু (করবো)। স্যারদের কথা মতো এ বছর স্কুলে আমার ছেলে মেয়েরে লইয়া (নিয়ে) গেলাম কিন্তু স্যার অখলতে কইন (স্যাররা বলেন) আমার ছেলে মেয়ের বুঝি (নাকি) বয়স বেশি অইগেছে (হয়ে গেছে) তাই তারারে আর ভর্তি করা যাইতো নায়।”

লোগাঁও গ্রামের আনু মিয়া (৮৫) বলেন, “মৌলভীবাজার থেকে শিক্ষকরা আইতে (আসতে) চাইন (চান) না। তারা আমরার গ্রামের ছাত্র-ছাত্রীরে ঠিক মতো পড়াইন (পড়ান) না। স্কুলটি নবীগঞ্জ শিক্ষা অফিসের আওতায় আইলে পড়ালেখা ভালো অইবো (হত)।”

লোগাঁও গ্রামের বাসিন্দা ও ইউপি ছাত্রলীগের সভাপতি আবুল হোসেন লাল বলেন, দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়ে গেছে এই বিদ্যালয়টি। নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মধ্যেই দায়সারা ক্লাস চলছে দীর্ঘ দিন ধরেই। শিক্ষকরা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই দিনের যে কোন সময় আসেন, যে কোনো সময় আবার চলেও যান। অনেক সময় স্কুলে তালা ঝুলতেও দেখা যায়। এসব সমস্যায় কোমলমতি শিশুরা লেখা পড়া থেকে অকালে ঝড়ে পরবে। তিনি আরো বলেন, আমরা আদর্শবান শিক্ষক চাই যিনি নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকবেন এবং ছাত্র ছাত্রীদের প্রতি দায়িত্বশীল থাকবেন। বিদ্যালয়টিকে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা অফিসের আওতায় আনাসহ সকল সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি সিলেট বিভাগীয় শিক্ষা অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

বিদ্যালয়ের দাতা সদস্য সোহেল রানা বলেন, বিদ্যালয়ে নানা দুর্নীতি হচ্ছে। শিক্ষকরা প্রতিদিন আসেন না। আসলেও ছুটি দিয়ে চলে যান। তারা মনে হয় স্কুল ছুটি দেওয়ার জন্যই স্কুলে আসেন। সোহেল রানা আরো বলেন, কিছু দিন আগে একটি মিটিং এ তিনি অনুপস্থিত ছিলেন তারপরও তার স্বাক্ষর জাল করে উপস্থিত দেখানো হয়েছে। এ নিয়েও চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।

গজনাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি আবুল খয়ের (গোলাপ) বলেন, বিদ্যালয়টিকে হবিগঞ্জ জেলার আওতায় আনার জন্য বিভিন্ন সময়ে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়েছে। কিন্তু বিষয়টির প্রতি কেউ গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তিনি এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সাচ্ছু মিয়া উপবৃত্তির টাকা বিতরণে অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, এখানে কোন অনিয়ম হয়নি এবং ছাত্র-ছাত্রী অনুপস্থিত থাকার কারণে টাকা কম দেওয়া হয়েছে। এক পর্যায়ে বিষয়টি তিনি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ব্যাংকের লোকজন উপস্থিত থেকে টাকা বিতরণ করেছেন।

শিক্ষক সাচ্ছু মিয়া আরো বলেন, আমাদের বাড়ী অনেক দূরে, যাতায়েতে সমস্যা তাই আসতে সময় লাগে, তাই ঠিক সময়ে আসা সম্ভব হয়না। এসব বিষয় তিনি ‘বস’দের সাথে ‘কম্প্রোমাইজিং’ করেই চালিয়ে আসছেন বলেও জানান। ‘বস’ বলতে তিনি শিক্ষা কর্মকর্তার কথা বোঝান। প্রধানমন্ত্রীর ছবির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছবিটি ছিড়ে গেছে তাই নতুন ছবি আসবে। এ কারণেই ছবিগুলো খোলে রাখা হয়েছে।

এ ব্যাপারে উক্ত বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আবুল খয়ের খায়েদ ও সহ-সভাপতি এবং বর্তমান ইউপি সদস্য তোফাজ্জুল হক বকুল বলেন, বিদ্যালয়টি মৌলভীবাজার জেলা থেকে হবিগঞ্জ জেলার আওতায় আনতে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে তৎকালীন হবিগঞ্জের ডিসি, মৌলভীবাজারের ডিসি এবং দুই জেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা আমাদের বিদ্যালয়ে এসেছেন এবং এ জটিলতা সমাধানের জন্য আশ্বাস দিয়ে তারা মন্ত্রণালয়ে লিখিত চিঠি দিয়েছেন। এ বিষয়টি বর্তমানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন আছে। আমরা আশা করছি খুব শীঘ্রই এর সমাধান হবে।

উল্লেখ্য, দিনারপুর পাহাড়ি অঞ্চলের এ এলাকায় তৎকালীন সময়ে দুটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। একই এলাকায় এভাবেই চলছিল বিদ্যালয় দুটি। কিন্তু যখন সরকারীকরণের প্রশ্ন আসে তখন পাশাপাশি দুটি বিদ্যালয় হবিগঞ্জ জেলার আওতায় সরকারি হবে না বলে লোগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে কৌশলে মৌলভীবাজার জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেই থেকে বিদ্যালয়টি নিয়ে চলছে এই টানাপোড়েন। এতে বিদ্যালয়টিতে শুধু শিক্ষক সংকটই চলছে না। প্রাথমিকের সমাপনী পরীক্ষা দিতে ছাত্রছাত্রীদের প্রায় ২০-২৫ কিলোমিটার দূরবর্তী মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কাগাবলা ইউনিয়নের মিলনপুর উচ্চবিদ্যালয়ে যেতে হয়। একইভাবে উপবৃত্তি নিতে  প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের আথানগিরিতে যেতে হয়। উক্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে সব কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে মৌলভীবাজার জেলা থেকে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত