নিজস্ব প্রতিবেদক

১৭ অক্টোবর, ২০১৭ ০১:৩১

খাবার ঢেকে রেখো, বাসায় এসে খাবো: বোনকে বলেছিলেন মিয়াদ

'আমার ভাইরে আনিয়া দেও', 'আমার ভাইরে আনিয়া দেও'- সিলেট শহরের উপকণ্ঠের বালুচরের বাড়িতে সোমবার বিকেল থেকে এমন আহাজারি। ওখানে থাকতেন ছাত্রলীগ কর্মী ওমর আহমদ মিয়াদ; অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের ধরে যিনি সোমবার বিকেলে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে খুন হন।

৩ ভাই ২ বোনের মধ্যে ২য় ছিলেন মিয়াদ। ভাইদের মধ্যে সবার বড়। সোমবার সন্ধ্যায় মিয়াদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় কান্নার রোল। পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী আর রাজনৈতিক সহকর্মীরা জড়ো হয়েছেন বাড়িটিতে। সকলের চোখেই জল। আর ভাইকে ফিরিয়ে দেওয়ার আকুতি জানিয়ে চলছেন মিয়াদের বোনেরা।

পুরো বাড়িতেই চলছে শোকের মাতম। বোনেরা বিলাপ করছেন। ভাইয়েরা আফসোস। আর শোকে একেবারে পাথর হয়ে আছেন মিয়াদের বাবা আকুল মিয়া। গ্রামের বাড়িতে থাকা মাকে এখনো জানানো হয়নি ছেলের মৃত্যুর খবর।

আকুল মিয়ার গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার রাণীগঞ্জ ইউনিয়নের বালিশ্রি গ্রামে। স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতেই থাকেন তিনি। পড়ালেখার জন্য ছেলেমেয়েদের সিলেটে বাসা ভাড়া করে দিয়েছেন। প্রতিসপ্তাহে বা দুই সপ্তাহে সিলেটে আসেন ছেলে-মেয়েদের দেখতে আর তাদের বাজার খরচ করে দিতে। সোমবারই আকুল মিয়া সিলেটে আসেন ছেলেমেয়েদের বাসায়। সকালে বাড়ি থেকে রওনা দিয়ে দুপুরে বাসায় পৌঁছান তিনি। মিয়াদ তখন বাসায় ছিল না।

আকুল মিয়া বলেন, বিকাল সোয়া তিনটার দিকে মিয়াদ তার বোনের মোবাইলে কল দিয়ে বলে, 'আপু তুমি তো রোজা রেখেছো। বাসায় সবার খাওয়া শেষ হলে আমার খাবার টেবিলে ঢেকে রেখো। আমি বাসায় এসে খাবো।'
এর ঠিক ১৫ মিনিট পর বিকাল সাড়ে ৩টায় মিয়াদের বাবার মোবাইলে গ্রামের বাড়ি থেকে কল করে জানানো হয়- মিয়াদ পায়ে গুলি খেয়েছে। আহতাবস্থায় এখন ওসমানীতে ভর্তি। আপনি হাসপাতালে যান।

খবর পেয়ে মিয়াদের বাবা হাসপাতালে ছুটে যান। সেখানে গিয়ে তাঁর প্রায় পাগলপ্রায় অবস্থা। ছেলেকে খুঁজতে থাকেন এদিক সেদিক।

মিয়াদকে যখন মর্গে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তিনি লাশের পাশে ছুটে যান 'কার লাশ, কার লাশ ' বলে। তখনই তিনি বুঝতে পারেন যে মিয়াদ আর নেই।

সোমবারের হামলায় মিয়াদের সাথে তার আরও ২ বন্ধুও আহত হন। তারা হলেন- নাসিম ও তারেক। এদের মধ্যে তারেকের অবস্থা আশংকাজনক। নাসিমের পায়ে ছুরির আঘাত আর তারেকের পেটে ৫-৬টি উপর্যুপরি ছুরির আঘাত।

মিয়াদের বন্ধু রাহাত আহমেদ সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আমি, মিয়াদ, তারেক ও নাসিম ২টি মোটরসাইকেলে করে টিলাগড় আসছিলাম। কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদের অফিসের সামনে আসার পর আমরা মোটর সাইকেল পার্কিং করার সময় তোফায়েল প্রথমে এসে আমাদের একজনকে ঘুষি মারে তারপর মিয়াদ সাইকেল থেকে নেমে ওকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? এ কথা বলতেই তোফায়েল ছুরি দিয়ে মিয়াদের বুকে আঘাত করে। এ সময় তোফায়েল ও তার সঙ্গীরা তারেক এবং নাসিমকেও ছুরিকাঘাত করে। মিয়াদের বুকে মারার সাথে সাথেই তার মুখ দিয়ে রক্ত বের হওয়া শুরু হয়। পাশেই আরও ২০-২৫ জন কর্মী ছিলো বলে জানান রাহাত।

তিনি বলেন, ছুরিকাঘাত করেই ওরা পালিয়ে যায়। আমরা তখন মিয়াদকে নিয়ে ওসমানী মেডিকেলে নিয়ে আসি। আসার পর ডাক্তাররা বলেন, মিয়াদ নেই।

বাসায় যারাই যাচ্ছেন তাদের সবাইকে মিয়াদের বাবা বলছেন, আমার মিয়াদ যদি তোমার সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করে থাকে বা কোন কষ্ট দিয়ে থাকে তাহলে দয়া করে মিয়াদকে মাফ করে দিয়ো। কোন বদদোয়া দিয়ো না।

মিয়াদের বন্ধুদের দেখে মিয়াদের বাবা বলেন, তোমাদের মধ্যে আমি আমার মিয়াদকে দেখতে পাই।

মিয়াদের বাবা স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমার ছেলেমেয়েরা সিলেট মেসে থেকে লেখাপড়া করতো। দেড় বছর আগে একটি বাসা ভাড়া করি ওদের থাকার জন্য। যাতে সবাই একসাথে থাকতে পারে। ৪ মাস আগে নতুন এই বাসায় ছেলেমেয়েদের তুলে দেই। রোববার রাত ৮টায় মিয়াদের সাথে আমার শেষ কথা হয়।

তিনি আহাজারি করে বলেন, যে আমার ছেলেকে মারলো সেও তো মানুষ। তাকে তো আল্লাহ মানুষ হিসেবেই সৃষ্টি করেছেন। তার দিলে কি একটুও মায়া দয়া নেই। মারলে তো হাতে বা পায়ে ও মারা যাইতো। বুকে মেরে আমার ছেলেকে নির্দয়ভাবেই মারতে হল।

উল্লেখ্য, সোমবার বিকেলে নগরীর টিলাগড়ে প্রতিপক্ষ গ্রুপের কর্মীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন ওমর আহমদ মিয়াদ (২৬) নামের এক ছাত্রলীগ কর্মী। এতে আহত হয়েছেন আরও দুই কর্মী। মিয়াদ লিডিং ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের ছাত্র।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত