এস আলম সুমন, কুলাউড়া

২২ অক্টোবর, ২০১৭ ২৩:১৮

মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে কুলাউড়ার ৩ ইউনিয়ন প্লাবিত

সহস্রাধিক একর ধানক্ষেত নিমজ্জিত

পাহাড়ি ঢল ও দুই দিনের টানা বৃষ্টিতে পানি বেড়ে মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার তিন ইউনিয়নের ২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এতে  এসব এলাকার প্রায় হাজার একর ফসলী জমি নষ্ট হয়েছে এবং সহস্রধিক পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছেন।

রোববার সকাল ৬টার দিকে শরীফপুর ইউনিয়ন ও টিলাগাঁও ইউনিয়নে দুটি স্পটের প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে যায়।

সংশ্লিষ্ট ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত শুক্রবার এবং শনিবার  টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে মনু নদীর পানি বাড়তে থাকে। শনিবার সকালে কুলাউড়া শরীফপুরের চাতলা ব্রিজ এবং টিলাগাঁও ইউনিয়নের আশ্রয়গ্রাম সংলগ্ন এলাকায় মনু নদীর দু’টি প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে যায়।

এ রিপোর্ট  লেখা পর্যন্ত উপজেলার শরীফপুর, হাজীপুর  ও টিলাগাঁও ইউনিয়নের ২৫টি গ্রাম পুরোপুরি প্লাবিত  হয়ে  পড়েছে। এসব গ্রামের প্রায় সহস্রধিক পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছেন তাছাড়া হাজার একরের বেশি রুপা আমনের ক্ষেতসহ অন্যান্য ফসলী ক্ষেত পুরোপুরি তলিয়ে গেছে। দারিদ্র অসহায় মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে নদীর পাড়ে আশ্রয় নিয়েছেন।

উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ৪’শ প্যাকেট ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মো. গোলাম রাব্বী।

এছাড়াও পাউবো মৌলভীবাজার কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্তীসহ কর্মকর্তাগণও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন।

সরেজমিনে টিলাগাঁওয়ে গেলে দেখা যায় বালিয়া, চানপুর, ইছবপুর, লালবাগ ও আশ্রয়গ্রামসহ কয়েকটি গ্রামের কয়েকশতাধিক বাড়িঘর এবং বেশ ধানী ও অন্যান্য ফসলী জমি ভাঙ্গা বাঁধের পানিতে তলিয়ে গেছে। স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন  প্রায় দুই মাস আগে বাঁধে ফাটল দেখা দেয়। কতৃপক্ষ  কোন উদ্যোগ না নেওয়ায় এখন বাঁধ ভেঙ্গে আমাদের ফসলের ক্ষেত ও বাড়িঘর পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

আশ্রয়গ্রামের জুনেল আহমদ বলেন, ৩ বিঘা রূপা আমন ধান চাষ করেছিলেন। ইতোমধ্যে ধান গাছে থোর (কাচা  ধান) এসেছিলো, কিন্তু  বাঁধ ভেঙে মুহূর্তেই চোখের সামনে জমির সব ধান পানিতে তলিয়ে গেছে।

একই গ্রামের তোফায়েল আহমদ তানভীর বলেন, বেলা যত গড়াচ্ছে ততই আশোপশের গ্রামগুলো প্লাবিত হয়ে পড়ছে। এভাবে বাঁধ দিয়ে পানি ঢুকতে থাকলে টিলাগাঁও ইউনিয়নসহ আশেপাশের ইউনিয়নগুলোও পানিতে তলিয়ে যাবে।

 ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধ সংলগ্ন পাড়ে বসে কান্নায় মুর্ছা যাওয়া গৃহীনী সীমা রানী দে ভাঙ্গণ সংলগ্ন পানিতে ডুবে যাওয়া একটি  বাড়ি দেখিয়ে বলেন, সর্বনাশা মনু গাঙ (নদী) আমরার  একমাত্র মাথাগুজার অবলম্বনটুকু কেড়ে নিচ্ছে। ভোর থেকেই হঠাৎ বাঁধ ভেঙ্গে চোখের পলকেই তাঁর বসত ঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। আসবাবপত্রসহ সবকিছুই ঘরের ভিতর রয়ে গেছে, কোনকিছুই ঘর থেকে বের করে আনতে পারিনি। চার মেয়েকে আত্মীয়’র বাড়ি  পাঠিয়ে নদীর পাড়ে আশ্রয় নিয়েছি  আমি আর আমার স্বামী। যত সময় যাচ্ছে বাধ  আরো ভাঙ্গছে। এভাবে বাঁধ ভাঙ্গলে আজকে  রাতের মধ্যেই আমাদের বাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে যাবে।  

নদীর পাড়ে আশ্রয় নেয়া একই গ্রামের ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা রেজিয়া বেগম বলেন, পানি ঢুকে আমার বাড়ির কাঁচা দেয়াল ধসে  পড়েছে। এখন ছেলে, ছেলের বউ ও নাতি-নাতনী নিয়ে কই যাবো? দুই দিন ধরে জ্বর। দুপুর হয়ে গেছে সবাই এখনো না খেয়ে আছি। কেউ এখনো পর্যন্ত সাহায্য নিয়ে আসেনি। নদীর পাড়ে আশ্রয় নেয়া শিরীন বেগম, তালেবুন বেগম, নাজমা বেগম ও মতলিব মিয়া বলেন, পানিতে আমরার মাটির ঘর ভেঙ্গে গেছে। এখন  নদীর পাড়ে খোলা আকাশের নিচে তাকা লাগবো। চেয়ারম্যান আসছিলেন কিন্তু এখনো কেউ সাহায্য নিয়ে আসেনি।

রইছ আলী, মন্নান মিয়া ও নয়ন দেব বলেন, কয়েক বছর ধরে এই বাঁধ এর কাজ করা হয়নি। কিছুদিন  আগে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ সংস্কার করা হয়েছিল।

রইছ আলী ও মন্নান মিয়া আরও বলেন, তাঁরা পনেরো  বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছিলেন। এখন বাঁধ ভেঙ্গে আমরার ঘর আর  ধান  ক্ষেত তলিয়ে গেছে। ক্ষেতের সব ধান পঁচে নষ্ট হয়ে যাবে। আগে যদি  বাঁধের কাজ করা হতো তাহলে আজ এত বড় ঘটনা ঘটত না।

ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জানতে টিলাগঁও ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মালিকের মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।

হাজিপুর ইউপি  চেয়ারম্যান আব্দুল বাছিত বাচ্চু মোবাইল ফোনে বলেন, চাতলাপুর ব্রিজ সংলগ্ন বাঁধ ভেঙ্গে  শরীফপুর দিয়ে হাজীপুরের  নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়ছে। ইতোমধ্যে কেওলার হাওর ডুবে আশপাশের ৭টি গ্রাম চানগাঁও, বিলরপার, কাতাইপার, কচুমূলিরপার, মজমপুর, ভুঁইগাঁওয়ের আংশিক পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব গ্রামের প্রায় দুই হাজার হেক্টর ধানি জমি তলিয়ে গেছে পানিতে।

তিনি আরও বলেন, আমার ইউনিয়নের আরও দশটি গ্রামের মানুষ নদীর বাঁধ ভাঙ্গন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।  

শরীফপুর ইউনিয়নের চাতলাপুর ব্রিজের বাঁধ ভেঙ্গে এই ইউনিয়নের ইটারগাট, পারিয়ারঘাট, কালারায়েরচর, দত্তগ্রাম, নিশ্চিন্তপুর, মানগাও, নসিরগঞ্জ, তিলোকপুর চা বাগান, পালকীছড়া চা বাগান গ্রামসহ  ৮/১০টি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মো. গোলাম রাব্বী।

তিনি বলেন, আমরা ওইসব এলাকা পরিদর্শন করেছি। পাহাড়ী ঢল ও বৃষ্টিতে মনু নদীর পানি বেড়ে উপজেলার টিলাগাঁওয়ের আশ্রয়গ্রাম এলাকায় প্রায় দু’শ ফুট এবং শরীফপুরের  চাতলাপুর ব্রিজের তিন থেকে চার’শ ফুট প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে শরীফপুর, হাজীপুর  ও টিলাগাঁওয়ের অনেক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। আমরা উপজেলা প্রশাসনের ত্রাণ তহবিল থেকে শরীফপুরে  ৩’শ প্যাকেট ও টিলাগাঁওয়ে ১’শ  প্যাকেট ত্রাণ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে লোকদের বিতরণ করেছি। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরুপনের জন্য বিষয়টি সার্বক্ষণিক  মণিটরিং করছি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজার কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী মোবাইলে বলেন, প্রতিরক্ষা বাঁধ ভাঙ্গনের খবর পেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা  পরিদর্শন করেছি। আমি রোববার কর্মস্থলে যোগদান করেছি। মনু নদীর বিভিন্ন স্থানে ৪০টি ঝুঁকিপুর্ণ পয়েন্ট চিহ্নিত করে বরাদ্দের আবেদন করা হয়েছিল। ইতোমধ্যে  ঝুঁকিপুর্ণ পয়েন্ট সংস্কারের জন্য ৩  কোটি টাকা বরাদ্দও এসেছে। এখন টেন্ডার ও ওয়ার্কঅর্ডার মাধ্যমে কাজ শুরু করা হবে। পরিবেশ অনুকুলে থাকলে আগামী  নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে কাজ শুরু হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত