নিজস্ব প্রতিবেদক

২৩ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:২৫

বৃষ্টি আসে, বিদ্যুৎ যায়

চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ-দ্বিগুণ উৎপাদন, তবু সিলেটে বিদ্যুৎ বিভ্রাট

শুক্রবার রাত সাড়ে ১০ টা থেকে বৃষ্টি শুরু হয় সিলেটে। বৃষ্টির শুরুর সাথেসাথেই নগরজুড়ে অন্ধকার নেমে আসে। বিদ্যুৎ চলে যায়। এরপর রাতভর নগরীর অনেক এলাকা ছিলো বিদ্যুৎবিহীন। নগরীতে তবু শনিবার সকালে বিদ্যুৎ এসেছে। তবে গ্রামাঞ্চলের অবস্থা আরও করুণ। গত বুধবার রাতে ঝড়ের পর বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলা সহ অনেক উপজেলা। শনিবার দুপুর পর্যন্ত এসব এলাকায় বিদ্যুৎ আসেনি।

সিলেটে এমন ঘটনা প্রতিদিনই। ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলেই বিদ্যুৎ চলে যায়। দীর্ঘসময় অন্ধকারে থাকে সিলেট। অনেক এলাকায় দুইতিনদিন পরও বিদ্যুতের দেখা মেলে না।

অথচ সিলেটে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় চাহিদার থেকে দিগুণের চাইতেও বেশি। সরবরাহও মিলে চাহিদার অধিক। তবু কেনো এতো বিদ্যুৎবিভ্রাট?

সংশ্লিষ্টরা বলছেন- জরাজীর্ণ সরবরাহ ব্যবস্থা, সঞ্চালন লাইনে ত্রুটি, পুরনো যন্ত্রপাতি আর ঝড়বৃষ্টির কারণে এমন বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনা ঘটছে।

সিলেটে বিদ্যুতের সঞ্চালন ব্যবস্থায় উন্নয়নে ‘বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্প, সিলেট বিভাগ’ নামে ১৮৯১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও এখন পর্যন্ত এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি। ফলে দুর্ভোগ থেকে রেহাই পাচ্ছে না সিলেটবাসী।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেট কার্যালয়ের হিসেব মতে, সিলেট বিভাগের সরকারী ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র মিলিয়ে প্রতিদিন গড়ে উৎপাদন হয় প্রায় ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। আর সিলেটে প্রতিদিন চাহিদা রয়েছে গড়ে ৫শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুতের। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহও রয়েছে। তবু বিদ্যুৎযন্ত্রণা থেকে রেহাই পাচ্ছে না সিলেটবাসী।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেট অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী রতন কুমার বিশ্বাস বলেন, মঙ্গলবার সিলেটে বিদ্যুতের চাহিদা ছিলো ৩১০ মেগাওয়াট। চাহিদার সমপরিমাণ সরবরাহ পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি। অনেক সময় সরবরাহকৃত বিদ্যুৎ ব্যবহার করা যায় না জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক সময় চাহিদা কমে যায়। তখন চাহিদার চেয়ে বেশি সরবরাহ পাই। সরবরাহ অনুযায়ী ব্যবহার করতে না পারার কারণে জবাবদিহি করতে হয়। এতে সিস্টেমে ব্যাঘাত ঘটে।

তবু বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎবিভ্রাট প্রসঙ্গে রতন কুমার বিশ্বাস বলেন, বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় আমাদের কিছুটা সমস্যা রয়েছে। আমাদের অনেক লাইন ও ট্রান্সমিটার পুরনো। ঝড়ে অনেক জায়গায় লাইন ছিড়ে যায় বা ট্রান্সমিটার নষ্ট হয়ে যায়। গ্রিড লাইনেও অনেক সময় সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়া বজ্রপাতে বিদ্যুতের ইন্সুলেটর ফেটে যায়। বাইরে থেকে এই সমস্যা দেখা যায় না। কিন্তু বৃষ্টি হলেই পানি ঢুকে তার ছিঁড়ে যায়। এসব কারণে ঝড়-বৃষ্টির মৌসুমে বিদ্যুতের সমস্যা দেখা দেয়। একে লোডশেডিং বলা যাবে না। সরবরাহ কম থাকলে আমরা লোডশেডিং বলতাম। এই সমস্যাকে বিদ্যুতের বিচ্যুতি বা বিভ্রাট বলা যেতে পারে।

তিনি বলেন, অন্যান্য দেশে বিদ্যুতের তার মাটির নিচ দিয়ে টানা হয়। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের সমস্যা হয় না। কিন্তু আমাদের তো ঝড় হলেই তার ছিড়ে যায়, খুঁটি উপড়ে পড়ে।

তিনি বলেন, সিলেটে বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়নে ১৮৯১ কোটি টাকার যে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে তার কাজ চলছে। ইতোমধ্যে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। তারা বিদেশ থেকে সরঞ্জামাদি নিয়ে আসছে। তবে যেহেতু বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি বাইরে থেকে আনা হচ্ছে তাই এ প্রকল্পের কাজ শেষ হতে কিছুটা সময় লাগবে। আরও বছর তিনেক লাগতে পারে।

বৃষ্টিপ্রধান অঞ্চল সিলেট। মার্চ থেকেই এ অঞ্চলে বৃষ্টি শুরু হয়। যা অব্যাহত থাকে প্রায় নভেম্বর পর্যন্ত। সাম্প্রতিক সময়ে ঝড়-বৃষ্টির পরিমাণ বেড়েছে। আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে বজ্রপাতের ঘটনাও। ফলে বিদ্যুতের বিভ্রাটও বেড়েছে। গত একমাসে সিলেটে বিদ্যুৎবিভ্রাট অসহনীয় রূপ নিয়েছে। বিদ্যুতের দাবিতে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো স্থানে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভের ঘটনা ঘটছে।

সিলেটের গোলাপগঞ্জের ঘোষগাঁও এলাকার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলেন, একটু বাতাস দিলেই আমাদের বিদ্যুৎ চলে যায়। এরপর দীর্ঘসময় থাকে না। এই মাসের শুরুর দিকে টানা তিনদিন বিদ্যুৎ ছিলো না। এলাকাবাসীর বিক্ষোভের কারণে তিনদিন পর বিদ্যুৎ আসে।

নগরীর বাগবাড়ি এলাকার বাসিন্দা অশোক রায় বলেন, এখনো বর্ষা মৌসুম শুরু হয়নি। বৈশাখের শুরুতেই বিদ্যুতের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হওয়ায় উপক্রম। সামান্য বৃষ্টিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন থাকার নজির সিলেট ছাড়া আর কোথাও নেই।

জানা যায়, সিলেটে বিদ্যুৎ যন্ত্রণায় অতিষ্ট হয়ে ২০১১ সালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সিলেটের বিদ্যুৎ সমস্যার কারণগুলো চিহ্নিত করার নির্দেশ দেন। এই নির্দেশনা অনুযায়ী সিলেটে ঘনঘন বিভ্রাটের পেছনে ১০ টি সমস্যা চিহ্নিত করে অর্থমন্ত্রী বরাবরে ৬ টি সুপারিশ করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড।

বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করা ১০ টি সমস্যার মধ্যে ছিলো- পুরাতন ও জরাজীর্ণ বিতরণ (সঞ্চালন) লাইন, কিছু সংখ্যক সঞ্চালন ট্রান্সফরমার ওভারলোড, সিলেট সিটি করপোরেশনের বর্ধিত এলাকায় নতুন সঞ্চালন লাইন স্থাপন না করা, ১১ কেভি লাইনে স্থাপিত সঞ্চালন ট্রান্সফরমার চুরি, অতি পুরাতন/মেরামতকৃত ট্রান্সফরমার বিকল, সিলেট নগরীর জন্য বিকল্প গ্রিড উপকেন্দ্র না থাকা, নগরীর উপশহর এলাকায় ৩৩ ও ১১ কেভি উপকেন্দ্র ওভারলোড থাকা, ৩৩ কেভি ও ১১ কেভি সঞ্চালন লাইন ওভারলোড থাকা, উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৩৩ ও ১১ কেভি দুটি উপকেন্দ্র নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ সম্ভব না হওয়া এবং নগরীর আম্বরখানার আঞ্চলিক মেরামত কারখানায় আধুনিক যন্ত্রপাতি স্বল্পতার কারণে বিকল ট্রান্সফরমার প্রত্যাশিত সময়ের মধ্যে মেরামত করতে না পারা।

এই সমস্যাগুলো সমাধানে সেসময় ৬ টি সুপারিশ করেছিলেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী।

সুপারিশগুলো হচ্ছে- বিকল ও ওভারলোডেড ট্রান্সফরমারের বিপরীতে নতুন ট্রান্সফরমার প্রতিস্থাপনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ট্রান্সফরমার মজুদ, এ অঞ্চলের আওতাধীন ৩৩ কেভি, ১১ কেভি ও শূন্য দশমিক ৪ কেভি সঞ্চালন লাইনের সংস্কার/ক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ, নগরীর দক্ষিণ সুরমা এলাকায় নতুন গ্রিড উপকেন্দ্র নির্মাণ, উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৩৩ ও ১১ কেভি দুটি নতুন উপকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের কাজ তরান্বিত এবং আঞ্চলিক (ট্রান্সফরমারসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি) মেরামত কারখানা আধুনিকায়ন ও ট্রান্সফরমার চুরির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

সিলেটে বিদ্যুতের ১০ সমস্যা ও ৬ সুপারিশের প্রতিবেদন পেয়ে নিয়ে সমন্বিত একটি প্রকল্প গ্রহণের নির্দেশ দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলীকে প্রধান করে এ জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়। এই কমিটি তৈরি করে সিলেট বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা উন্নয়নের প্রকল্প।

প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্র নির্মাণ ও সংস্কার, ১১/০.৪ কেভি উপকেন্দ্র নির্মাণ ও সংস্কার, পর্যাপ্ত পরিমাণ ট্রান্সফরমার মজুদ, এ অঞ্চলের আওতাধীন ৩৩ কেভি, ১১ কেভি ও শূন্য দশমিক ৪ কেভি সঞ্চালন লাইনের সংস্কার ও ক্ষমতা বৃদ্ধি। এই প্রকল্পের আওতাভুক্ত হিসেবে সিলেট বিভাগের ৪ টি জেলা ও সিটি করপোরেশন এলাকাকে দেখানো হয়েছে।

এই প্রকল্পটি আরও ২০ বছর আগে নেওয়া উচিত ছিলো জানিয়ে রতন কুমার বিশ্বাস বলেন, সব বড় শহরেই এরকম প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্প অনুযায়ী কাজ করা গেলে লো-ভেল্টেজ ও অহেতুক বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত