নিজস্ব প্রতিবেদক

২৫ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:৩৪

হাওরের ধানে এবার ব্লাস্টের ছোবল

আগাম বন্যায় পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়েছিল গত বছরের বোরো মৌসুমের ফসল। সে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এ মৌসুমে নতুন উদ্যমে বোরো ধান আবাদ করেছিলেন হাওরাঞ্চলের কৃষকরা। কিন্তু এবারো দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়েনি তাদের। মৌসুমের শেষ দিকে এসে দেখা দিয়েছে ধানের ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাব। ফলে এবারো বোরো ধানের ফলন নিয়ে শঙ্কায় দিন পার করছেন হাওরাঞ্চলের কৃষকরা।

কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, ব্লাস্টের প্রাদুর্ভাব হাওরাঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে সুনামগঞ্জে সবচেয়ে বেশি।

স্থানীয় কৃষকরা জানান, ব্লাস্ট আক্রান্ত ধান গাছের পাতায় প্রথমে ছোট ছোট কালচে বাদামি দাগ দেখা যায়। ধীরে ধীরে দাগগুলো বড় হয়ে মাঝখানে ধূসর বাদামি রঙ ধারণ করে। একাধিক দাগ মিশে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পুরো পাতাটি শুকিয়ে মারা যায়। ব্লাস্ট আক্রান্ত শীষে ধানের বদলে দেখা দেয় চিটা।

কৃষকদের ভাষ্য অনুযায়ী, অন্যান্য বছর হাওড়াঞ্চলে কখনো এ রোগের প্রকোপ দেখা দেয়নি। এবারই প্রথম হাওড়ে ব্লাস্টের আক্রমণ দেখা যাচ্ছে। স্থানীয় কৃষকরা প্রতি বছরই হাওড় থেকে বীজ সংগ্রহ করে পরের বছর তা রোপণ করেন। তবে গত বছর বন্যায় সব তলিয়ে যাওয়ায় বীজ সংগ্রহ করতে পারেননি কৃষকরা। তাই তারা এবার সরকারের দেয়া বিনামূল্যের বীজ দিয়েই আবাদ করেছিলেন। এসব বীজের কারণেই ব্লাস্টের প্রকোপ দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন কৃষকরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্লাস্ট একটি ছত্রাকজনিত রোগ। আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে এটি হয়ে থাকে। নিয়মিত কীটনাশক ব্যবহারে ব্লাস্টের বিস্তার ঠেকানো সম্ভব। এ প্রসঙ্গে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ল্যান্ট প্যাথোলজি অ্যান্ড সিড সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল মুকিত বলেন, মূলত আবহাওয়ার তারতম্যের কারণেই এ রোগ দেখা দেয়। এখন সিলেট অঞ্চলে দিনে গরম, রাতে বৃষ্টি আর সকালে কুয়াশা পড়ে। আবহাওয়ার এ ব্যাপক তারতম্যের কারণেই এ রোগ দেখা দেয়।

তিনি বলেন, এ রোগের বিস্তার ঠেকাতে আক্রান্ত জমিতে কীটনাশক স্প্রে করতে হবে। কিন্তু এটি ব্যয়বহুল হওয়ায় হাওড়ের অনেক কৃষক তা করতে চান না। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল নিয়ে আমি কিছুদিন আগে হাওড়ে গিয়ে দেখেছি, আর্থিক সমস্যার কারণে অনেক কৃষক কীটনাশক ব্যবহার করতে পারছেন না।

সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগর থানার শালদীঘা, বোয়ালা, কাইল্যানি, বাইনছাপড়াসহ বিভিন্ন হাওড়ে গত দুদিনে ২৫ হেক্টর জমির বোরো ফসল ব্লাস্টে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। কৃষি কর্মকর্তারা জানান, ব্লাস্টের প্রকোপ ঠেকাতে কৃষকদের মধ্যে প্রচারপত্র বিলিসহ বালাইনাশক স্প্রে করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে পর্যাপ্ত স্প্রে মেশিন না থাকায় বালাইনাশক ব্যবহারের কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে বলে জানান স্থানীয় কৃষকরা। স্থানীয় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. শোয়েব আহমেদও স্প্রে মেশিনের স্বল্পতার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন।

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার অঙ্গারুলি, তাহিরপুর উপজেলার মাটিয়ান হাওড়, লেদারবন্দ হাওড় ও ধর্মপাশা উপজেলার বোয়ায়া, কাইল্যানি ও আহমদিয়া হাওড়েও ব্লাস্ট রোগে অনেক জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। তাহিরপুরের জামলাবাদ গ্রামের কৃষক রমিজ উদ্দিন বলেন, আমার ৮-১০ একর জমির পুরো ফসলই নষ্ট হয়ে গেছে। এখন গবাদিপশুর জন্য খড় সংগ্রহ করতে ধান কাটছি।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাগ্রোনমি অ্যান্ড হাওড় এগ্রিকালচার বিভাগের অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলামের মতে, মৌসুমের শুরুতে বীজতলা শোধন ও রোপণের পর পটাশিয়াম সার প্রয়োগ করা হলে এ সমস্যা হতো না। আগামী বছরের জন্য কোনোমতেই এ বীজ সংগ্রহ করা উচিত হবে না বলে আরো মত দিয়েছেন তিনি।

সুনামগঞ্জের কৃষি কর্মকর্তারা জানান, কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা বিআর-২৮ প্রজাতির ধানেই এবার ব্লাস্টের আক্রমণের মাত্রা বেশি। এ মৌসুমে সুনামগঞ্জে ২ লাখ ১৯ হাজার ২৯৪ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে উফশী ধান ২৮ ও ২৯ চাষ হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৮৫ হাজার হেক্টর জমিতে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুনামগঞ্জের উপপরিচালক স্বপন কুমার বর্মণ বলেন, মূলত বিআর-২৮ জাতের ধানেই ব্লাস্টের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এটি খুব বেশি চাষ করা হয়নি। আবাদকৃত অন্যান্য জাতের ধানে বাম্পার ফলন হলে এ ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব।

এ বছর সুনামগঞ্জের হাওড় থেকে ৮ লাখ ৭৫ হাজার ৩৫৯ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। তবে ব্লাস্টের প্রকোপের কারণে তা ১০ শতাংশ কমবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জেলাটিতে এবার তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, ধর্মপাশা ও জগন্নাথপুর উপজেলায় ব্লাস্টের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। এছাড়া সিলেটের গোলাপগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জ, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া ও শ্রীমঙ্গল এবং হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়েও ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে বলে জানা গেছে।

সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার শরিফগঞ্জ, বুধবারী বাজার, ঢাকা দক্ষিণ, বাদেপাশা এলাকা ঘুরেও দেখা গেছে ধানে ব্লাস্টের প্রাদুর্ভাব। উপজেলার ঢাকা দক্ষিণ ইউনিয়নের কৃষক শামীম আহমদ বলেন, আমি প্রায় ১০ একর জমিতে বোরো ধান আবাদ করি। কিন্তু ধানের শীষ শুকিয়ে চিটা হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি আমি কৃষি অফিসকে জানালে তারা এসে আমার জমি পরিদর্শন করে গেছে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি।

সুনামগঞ্জের বাইরে সিলেট বিভাগের অন্য তিন জেলায় ব্লাস্টের প্রকোপ খুব বেশি নয় বলে দাবি করেছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেটের অতিরিক্ত পরিচালক আলতাবুর রহমান। তিনি বলেন, সিলেট বিভাগে এবার ৪ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষ করা হয়েছে। ব্লাস্টের কারণে সুনামগঞ্জে ফসল কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বিভাগের অন্য তিন জেলায় বোরোর উৎপাদন খুব ভালো হয়েছে। আমরা এবার বাম্পার ফলনের আশা করছি।

সিলেট বিভাগে এবার বোরো মৌসুমে প্রায় ২০ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্য ধরা হয়েছে বলে জানান তিনি।

প্রসঙ্গত, গত বছরের বোরো মৌসুমে মার্চ-এপ্রিলের অকালবন্যায় বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় হাওড়াঞ্চলের বিস্তীর্ণ ধানি জমি। সরকারি হিসাবমতে, ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে ১৫৪ হাওড়ের ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমির বোরো ফসল তলিয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ লাখ ৬১ হাজার হেক্টর জমির ফসল। তবে কৃষকদের হিসাবে, এ ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় দ্বিগুণ।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত