শাকিলা ববি

২৬ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:২১

‘অরে বাবা মহিলা সার্জেন্ট!’

২৪ এপ্রিল, ঘড়িতে বাজে ১টা । জাফলংয়ের আসকর আলী নামে এক ব্যক্তি ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন। নগরীর নাইওরপুল এলাকায় তাকে থামালেন ট্রাফিক পুলিশের এক সার্জেন্ট। ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় তিনি মামলা করে দিলেন চালকের বিরুদ্ধে। চালক আসকর আলী মামলা না দেয়ার জন্য অনেক অনুনয় করলেন। নিজের আত্মীয় এক আইনজীবীকেও আনলেন সার্জেন্টকে বুঝিয়ে মামলা প্রত্যাহার করানোর জন্য। কিন্তু কিছুতেই কাজ হলো না। মামলা খেতেই হলো আসকর আলীকে।

যে ট্রাফিক পুলিশ সার্জেন্ট সব অনুরোধ-তদবির উপেক্ষা করে দায়িত্ব পালনে অবিচল থাকলেন তিনি একজন নারী। এই সাহসী নারীর নাম হৈমন্তী সরকার।

প্রথম নারী সার্জেন্ট হিসেবে সিলেট নগরীর ট্রাফিক কন্ট্রোলের দায়িত্ব নিয়েছেন হৈমন্তী। গত দুদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হৈমন্তীকে নিয়ে। ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালনে তাঁর সাহসিকতার প্রশংসা করছেন সবাই।

মঙ্গলবার দুপুরে নাইওরপুল পয়েন্টেই কথা হয় হৈমন্তী সরকারের সাথে। এই পেশায় আসার গল্প শোনান তিনি।


বাবা সাফল্য সরকার আর মা অনিতা সরকারের তিন মেয়ের মধ্যে হৈমন্তী মেজো। নেত্রকোনার দুর্গাপুর থানার বিরিশিরিতে তাঁর জন্ম। ছোটবেলা থেকেই খুব ডানপিটে ছিলেন হৈমন্তী । তাদের কোন ভাই নেই তাই বাবার সাথে ঘরের সব তিনিই করতেন।নেত্রকোনা বিরিশিরি মিশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০৫ এসএসসি ও দূর্গাপুর মহিলা কলেজ থেকে ২০০৭ সালে এইচএসসি পাশ করেন। ঢাকার বেগম বদরুননেছা সরকারী মহিলা কলেজ থেকে সমাজ বিজ্ঞানে মাস্টার্স শেষ করার পর পুলিশে ট্রাফিক সার্জেন্ট নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে আগ্রহী হন।

হৈমন্তী বলেন, ছোটবেলা থেকেই চ্যালেঞ্জিং কাজ পছন্দ করতাম। আমার কোন ভাই নেই তাই পরিবারে ছেলেরা যে কাজ করে সেগুলো বাবার সাথে আমি করতাম। তবে এই ডিপার্টমেন্ট কাজ করবো তা কখনো ভাবিনি। পুলিশের সার্জেন্ট নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে খুব আগ্রহী হই। নিয়োগ দেখার পর মনে হয়েছে যে বাংলাদেশে কোন নারী সার্জেন্ট নেই। এই চাকরি হলে আমি প্রথম নারী সার্জেন্ট হবো। এটা একটা ইতিহাস হবে এ বিষয়টা চিন্তা করেই রোমাঞ্চিত হই।

বলতে থাকেন হৈমন্তী- পুলিশের সার্জেন্ট পোস্টে আবেদন করার প্রবল ইচ্ছা জাগে। বাবাকে বলি আমি আবেদন করতে চাই। উনি সাফ না করে দিলেন। আমার বাবা অনেক সহজ সরল মানুষ। আমার ডানপিটেপনায় তিনি সবসময়ই ভয় পেতেন। তাই পুলিশ সার্জেন্ট হয়ে রাস্তায় কাজ করার কথা ভেবে তিনি আরও ভয় পেয়ে যান। তবে আমার মা অনেক সাহসী। আমার সব কাজেই তিনি সাপোর্ট করতেন।

হৈমন্তী বলেন, ‘এ চাকরির জন্য প্রথমে আমার মা বাবা কেউই রাজি ছিলেন না। তবে আমার আগ্রহ দেখে পরে মা সমর্থন দিয়েছেন আমাকে। বাবা এখনো ভয় পান। উনি বলেন যে গাড়ি চাপা পরে কোনদিন মরে যাবো। বাবা মনে করেন রাস্তায় গাড়ি সামলানো এটা ছেলেদের কাজ। আমি পারবো কিনা। কখন না পেছন থেকে গাড়ি চাপা দেয় এ ধরনের ভয় তার মনে এখনো কাজ করে। তবে মা সব সময় সমর্থন ও সাহস দিয়েছে আমাকে। তাই এই চাকরিতে আবেদনের জন্য মা বাবাকে রাজি করিয়েছেন। সব ধরনের মানসিক সাপোর্ট আমি মার কাছ থেকে বেশি পেয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘যেহেতু বাংলাদেশে তখন পর্যন্ত কোন নারী সার্জেন্ট রাস্তায় কাজ করেনি তাই বাবা আবারো আমাকে এই কাজে কি ধরনের ঝুঁকি থাকতে পারে তা বুঝিয়ে বলেন। মনে সাহস নিয়ে আবেদন করে ফেললাম। ৪৬ জন পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তার মধ্যে থেকে আমরা ২৯জন বর্তমানে কর্মরত আছি। ২০১৫ সালের মে মাসে এই পেশায় যোগদান করি এবং ২০১৭ সালে ফেব্রুয়ারিতে সিলেট বদলী হয় আমার।’

চাকরি হওয়ার পর সিলেটে আসার আগে ব্যাংকার যীশু দেবনাথের সাথে বিয়ে হয় হৈমন্তী সরকারের। সিলেটে আসার পর গর্ভকালীন ছুটি শেষ করে গত ২৪ এপ্রিল পুরোদমে কাজে যোগ দেন তিনি। বর্তমানে সংসার ও চাকরিতে দুটোই সামলাচ্ছেন সমানভাবে। ৭ মাসের ছেলে রিশভকে ঘুমে রেখে সকাল সাড়ে ছয়টায় স্কুটি নিয়ে চলে আসেন ডিউটিতে। ৮ ঘণ্টার ডিউটি শেষ করে বাসায় ফিরে রিশভকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

তিনি জানান, তাঁর এই পেশার প্রতি শুরু থেকেই স্বামীর সমর্থন এবং অনুপ্রেরণা ছিল।

হৈমন্তী বলেন, ‘ও সব সময়ই আমকে সাপোর্ট করে। এখনো মাঝে মাঝে ও গর্ব করে বলে, সাহসী মেয়ে বিয়ে করেছি। সার্জেন্ট বউ বিয়ে করেছি তাই আমার সাহসও বেশি থাকে।’

দায়িত্ব পালনে ঝুঁকি নিয়ে তিনি বলেন, ‘সমস্যা ও ঝুঁকি তো আছেই। কারণ এই পেশায় বিভিন্ন ক্যাটাগরির লোকের সাথে আমকে কথা বলতে হয়। অনেক জায়গা থেকে ফোন আসে, অনেকে মামলা নিতে রাজি হয় না, কেউ আবার জোর করেই বলে না আমি মামলা নেব না। মোট কথা সমস্যা আর ঝুঁকি নিয়েই কাজ করতে হবে এবং এসবের মধ্যেই কাজ করতে হবে এই মনোভাব নিয়েই আমি এই পেশায় যোগ দিয়েছি। শুধু মেয়ে সার্জেন্ট বলে নয়, কিছু সমস্যা আছে যেগুলো মেয়ে ছেলে সব সার্জেন্টরাই ফেইস করেন।

নারী হওয়ায় কিছু বাড়তি সুবিধা পান জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক সমস্যা মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে মেয়ে সার্জেন্ট হিসেবে আমি সুবিধা পাই। যেমন ধরেন আমি যখন লাইসেন্সবিহীন গাড়িগুলোতে মামলা দেই, গাড়ির মালিকরা বাকবিতণ্ডা করবেন দূরের কথা অনেকেই লজ্জায় কোন কথা বলেন না। কিন্তু একই কাজটা একজন পুরুষ সার্জেন্ট করতে তাকে অনেক সমস্যা ফেইস করতে হয়। ’

সড়কের চালক ও যাত্রীদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা নারী সার্জেন্টরা প্রায় তিন বছর ধরে কাজ করছি। প্রথমদিকে ট্রেনিংকালীন সময়ে সবাই শুধু তাকিয়ে থাকতো। অনেকে অবহেলার চোখেও দেখেছে। অনেকেরই প্রশ্ন ছিল নারীরা কি রাস্তায় কাজ করতে পারবে? তবে এখনকার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখন যখন আমরা কাজ শিখে রাজপথে কাজ করছি তখন সবার ধারণাও পাল্টে গেছে। পুরুষ ও নারী সার্জেন্টের সমানভাবে কাজ করা দেখে বেশিরভাগ চালক ও যাত্রীরা অবাক হচ্ছেন। তবে আগের অবাক দৃষ্টি আর এখনকার অবাক দৃষ্টির অনেক পার্থক্যও লক্ষ্য করেছি। এখনকার কমেন্টগুলো ছিল এমন, ‌'অরে বাবা মহিলা সার্জেন্ট ! আবার মামলাও দিচ্ছে। তবে অনেকে উৎসাহিতও করেছেন।’

তিনি বলেন, ‘এখানে কর্মক্ষেত্রে পুরুষ সহকর্মীরা সবাই খুবই হ্যাল্পফুল। তাদের আন্তরিকতা ও সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবে কাজ করতে আরও  উৎসাহী হই।’


সার্জেন্ট হৈমন্তী সরকারের সাথে আরও ১০জন নারী কনস্টেবল যোগ দিয়েছেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগে। তার সাথেও আছেন দুই নারী কনস্টেবল সেহেনা বেগম ও তাহমিনা আক্তার।

কনস্টেবল সেহেনা বেগম ও তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘স্যার আসাতে খুব খুশি আমরা মেয়েরা। কারণ তার জন্য আমরা মেয়েরা সুযোগ পেয়েছি নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের। তারা বলেন, পুলিশের চাকরি নিয়েছি চ্যালেঞ্জিং কিছু করার জন্য। দুই বছর ধরে চাকরি করছি কিন্তু নিজেদের যোগ্যতা দেখানোর মত কোন সুযোগ পাচ্ছিলাম না। সব সময়ই স্কুল কলেজে পরীক্ষার ডিউটিতে পাঠানো হত। এখন স্যার আসাতে আমাদেরকে ট্রাফিকে কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। তাই আনন্দের সাথে কাজ করছি এখন।’

সার্জেন্ট হৈমন্তী সরকার বলেন, আমরা মেয়েরা সব জায়গাতেই কাজ করতে পারি। এরকম একটা চ্যালেঞ্জিং জায়গায় মেয়েদের কাজ করা ও কাজ করার পরিবেশ তৈরি করাটাও অনেক কিছু। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মেয়েদের কর্মক্ষেত্রের ব্যাপ্তি বেড়েছে বলে মনে করি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত