কমলগঞ্জ প্রতিনিধি

১৮ জুন, ২০১৮ ২৩:২৬

কমলগঞ্জে ৩ ইউনিয়নে বন্যার অবনতি, ৫ জনের লাশ উদ্ধার

গত বৃহস্পতিবার (১৪ জুন) থেকে সৃষ্ট বন্যায় গত দুইদিনে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের বিভিন্ন স্থান থেকে বন্যার পানির স্রোতে ভেসে যাওয়া শিশু, বাবা-ছেলেসহ ৫ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া এক নারীসহ আরো বেশ কয়েকজন নিখোঁজ রয়েছেন।

কমলগঞ্জ উপজেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও তিনটি ইউনিয়নের প্রায় অর্ধলক্ষ লোক এখনও পানিবন্দি রয়েছে। পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধার কার্যক্রমে রোববার থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা তৎপরতা শুরু করেছেন।

বন্যাক্রান্ত এলাকায় বিশুদ্ধ পানীয় জল, স্যানিটেশন এর যখেষ্ট অভাব রয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিসহ সরকারি-বেসরকারিভাবে ত্রাণ কার্যক্রম চলছে। গত দুইদিনে পানির স্রোতে ভেসে যাওয়া নিহতরা হচ্ছেন- আলীনগর ইউনিয়নের বস্তির পরিবহন শ্রমিক সেলিম মিয়া (৩৮), শমশেরনগর ইউনিয়নের ভাদাইরদেউল গ্রামের মানসিক প্রতিবন্ধী রমজান আলী (৪০), ইসলামপুর ইউনিয়নের কাঠালকান্দি গ্রামের পিতা সাত্তার মিয়া (৫৫) ও তার ছেলে করিম মিয়া (২০) এবং রহিমপুর ইউনিয়নের প্রতাপী গ্রামের মিছির মিয়ার ১৮ মাসের শিশুপুত্র ছাদির মিয়া।
গত ২৪ ঘন্টায় উজানে ভারতীয় অঞ্চলে তেমন বৃষ্টিপাত না হওয়ায় মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ধলাই নদী ও কুলাউড়ার শরীফপুরে মনু নদীর পানি কমতে শুরু করে।

ফলে কমলগঞ্জে বন্যা বিভিন্ন সড়ক থেকে ও বাড়ি ঘর থেকে বন্যার পানি নেমে যেতে শুরু করায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। একইভাবে কুলাউড়ার সীমান্তবর্তী শরীফপুরেও পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। কমলগঞ্জের নিম্নাঞ্চল পতনউষার ইউনিয়ন, মুন্সীবাজার ও শমশেরনগর ইউনিয়নের আংশিক এবং কুলাউড়ার শরীফপুরে আটকা পড়া পানিবন্দি মানুষজনদের উদ্ধারে সেনা বাহিনীর বিশেষ তৎপরতা শুরু হয়েছে।

এদিকে শরীফপুরে শমশেরনগর-চাতলাপুর চেকপোষ্ট সড়কের ধেবে ভেঙ্গে পড়া কালভার্টটি আরও কিছুটা ধেবে যাওয়ায় শরীফপুরের মানুষজনের চলাচলের জন্য সড়ক জনপথ বিভাগ বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। মুন্সীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আওয়ামীলীগ নেতা জুনেল আহমদ তরফদারের উদ্যোগে বেশ কয়েকটি নৌকা পতনঊষার ইউনিয়নের বন্যাক্রান্ত লোকদের নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে আনতে কাজ করছে।

এছাড়া মুন্সীবাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মো: সালাউদ্দিনের ব্যক্তিগত অর্থায়নে পতনঊষার, রহিমপুর ও মুন্সীবাজার ইউনিয়নের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে রোববার দিনভর প্রায় তিন সহস্রাধিক লোকের মধ্যে খিঁচুড়ি বিতরণ করা হয়।

রোববার সকালে কমলগঞ্জের শমশেরনগর-কমলগঞ্জ ও মুন্সীবাজার-কমলগঞ্জ সড়ক থেকে বন্যার পানি নেমে গেলেও শমশেরনগর-মৌলভীবাজার এবং শমশেরনগর-কুলাউড়া সড়কের বিভিন্ন স্থানে এখনও পানি থাকায় সরাসরি যানবাহন চলাচল বিঘিœত হচ্ছে। অন্যদিকে কমলগঞ্জের নিম্নাঞ্চল শমশেরনগরের সতিঝিরগাঁও, মরাজানের পার, রাধানগর, কেছুলুটি, রঘুনাথপুর, মুন্সীবাজার ইউনিয়নের রুপশপুর, বনবিষ্ণপুর ও পতনউষার ইউনিয়নের নোয়াগাঁও, কোনাগাঁও, গোপীনগর, রাধাগোবিন্দপুর, সোনারগাঁও, শ্রীরামপুর, শ্রীমতপুর, রসুলপুর, বৃন্দাবনপুর, পতনঊষার, হালাবাদী, ধূপাটিলা, দর্গাহপুর, মাইজগাঁও, পালপুর, পালিতকোনা, জগন্নাথপুর, রামেশ্বরপুর, রসিদপুর, রাজদিঘীরপারসহ বিভিন্ন গ্রামের বসতবাড়িতে এখনও প্রায় অর্ধলক্ষ লোক পানিবন্দি রয়েছেন। কমলগঞ্জের অন্যান্য ইউনিয়ন থেকে বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় পানিবন্দি মানুষজন হাপ ছেড়ে বেঁচেছেন।

রোববার সকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল দুটি স্পীডবোট নিয়ে কমলগঞ্জের পতনউষার ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম থেকে পানিবন্দি মানুষজনদের উদ্ধার করতে শুরু করে। এদিকে গত শনিবার সন্ধ্যা থেকে সেনাবাহিনীর ২টি দল স্পীডবোট নিয়ে কুলাউড়ার শরীফপুরও হাজীপুর ইউনিয়নে পানিবন্দি মানুষজনদের উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে।

এদিকে গত শনিবার বিকাল থেকে কমলগঞ্জ উপজেলার পতনঊষার, মুন্সীবাজার, রহিমপুর, ইসলামপুর, কমলগঞ্জ পৌরসভা, শমশেরনগরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি উপাধ্যক্ষ ড. মো: আব্দুস শহীদ বন্যা দূর্গতদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করেন। কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ মাহমুদুল হকের নেতৃত্বে গত শনিবার রাত সাড়ে ১১টায় নৌকাযোগে পতনঊষার ইউনিয়নের আহমদনগর দাখিল মাদ্রাসায় আশ্রয় নেওয়া বন্যাক্রান্ত তিনশত লোকের মধ্যে শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়। এ সময় উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, মুন্সীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জুনেল আহমদ তরফদার, সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান, সাংবাদিক প্রনীত রঞ্জন দেবনাথ, সমাজসেবক হামিদুল হক চৌধুরী বাবর, স্থানীয় ইউপি সদস্য এখলাছুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে স্থানীয় সংসদ সদস্য, সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ ড. মো: আব্দুস শহীদ এমপি’র উদ্যোগে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়। কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহমুদুল হক ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান কমলগঞ্জে বিভিন্ন বন্যা দুর্গত এলাকায় শুকনো খাদ্য সামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রাখছেন। এছাড়া কমলগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মো: জুয়েল আহমদ ও ৯টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা দুর্গতদের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেন। ঢাকার ব্যবসায়ী মুহিবুর রহমান, জেলা পরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ হেলাল উদ্দীন, মুন্সীবাজার-রহিমপুর দরিদ্র কল্যাণ ট্রাষ্টসহ ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকেই পানিবন্দি গ্রামে গিয়ে ও আশ্রয় কেন্দ্রে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেন।

কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, বন্যায় যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি বিপর্যস্ত হওয়ায় সঠিকভাবে খাদ্য সামগ্রী পৌছানো যাচ্ছিল না। তবে শনিবার বিকাল থেকে দুর্গতদের মাঝে খাদ্য সামগ্রী পৌছে দেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, ত্রাণের কোন সমস্যা নেই। প্রশাসনের পাশাপশি ব্যক্তি উদ্যোগে পানিবন্দিদের ও আশ্রয়ে কেন্দ্রে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, রোববার বেলা ২টা পর্যন্ত কমলগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। উজানে ভারতীয় অংশে তেমন বৃষ্টি না হলে আগামী ২৪ ঘন্টায় আরও উন্নতি হবে।

এদিকে কুলাউড়ার শরীফুর ইউনিয়নের মনু সেতু সংলগ্ন এলাকার প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে কাছাকাছি একটি বড় কালভার্ট ধেবে গেলে গত ১৩ জুন থেকে এ ইউনিয়নের মানুষজনের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছিল। গত শনিবার (১৬ জুন)  বিকালে আবারও এ কালভার্ট আরও কিছু ধেবে মারত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। রোববার সকালে সড়ক জনপথ বিভাগের সিলেট বিভাগের অতিরিক্ত নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা ও সেনাবাহিনীর ল্যা: কর্ণেল শাহাব উদ্দীন ভেঙ্গে পড়া কালভার্ট পরিদর্শন করেন। এখানে একটি বেইলী সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বেইলী সেতু নির্মাণ করতে ২/১ দিন সময় লাগবে বলে মানুষজনের ও হালকা যান চলাচলে এ কালভার্টের উপর বালির বস্তা ফেলে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহন করা হয়।

সড়ক জনপথ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় অতিরিক্ত নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা জানান, এখানে একটি বেইলী সেতু নির্মাণ করা হবে। এতে সময় লাগবে ২/১ দিন। তার আগে ধেবে যাওয়া কালবভর্টে বালির বস্তা ফেলে সড়কের সমান্তরাল করে দিলে কার, পিকআপ, সিএনজি অটো ও মোটরসাইকেল যাতায়াত করলে আপাতত মানুষজন হাটবাজারে যেতে পারবে। তিনি আরও বলেন দ্রুত সময়ে এ কালভার্টের উপর একটি বেইলী সেতু নির্মিত করার পাশাপাশি আমতলা বাজার থেকে চাতলাপুর চেকপোষ্ট পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক সংস্কার করা হবে। তাহলে বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশে যাতায়াতকারী ভিসাধারী যাত্রীরা আটকা পড়বে না।

কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহমুদুল হক গত দুইদিনে কমলগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে বন্যান পানির স্রোতে ভেসে আসা ৫ জনের লাশ উদ্ধার ও বেশ কয়েকজন নিখোঁজের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

তিনি আরো জানান, বন্যাক্রান্ত কমলগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের রোববার থেকে মেডিক্যাল টিম পাঠানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন উজানে ভারতীয় অংশে বৃষ্টিপাত না হলে বন্যা পরিস্থিতির পর্যায়ক্রমে উন্নতি হবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত