সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি

১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ১৬:১৪

বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের ৯ম মৃত্যুবার্ষিকী দিবস আজ।

দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগে ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তিনি সিলেটের নুরজাহান জেনারেল হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।

শাহ আব্দুল করিমের ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁকে উজান ধল গ্রামে তার স্ত্রী সরলার কবরের পাশে সমাহিত করা হয়।

তিনি তাঁর গানে জীবন এবং মৃত্যু সম্পর্কে এভাবে বলেন-
বাউল আব্দুল করিম বলে
জীবন লীলা সাঙ্গ হলে
শুয়ে থাকব মায়ের কোলে
তাপ অনুতাপ ভুলে।

শাহ আব্দুল করিমের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর পরিবার এবং বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এ উপলক্ষে শাহ আব্দুল করিম পরিবারের পক্ষ থেকে ওই দিন জোহরের নামাজের পর মিলাদ মাহফিল, বিকেল ৩টায় আলোচনা সভা। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক আব্দুল আহাদ।

সন্ধ্যার পর থেকে পরদিন ফজর পর্যন্ত করিম ভক্তদের উদ্যোগে সাড়া রাত করিম গীতির আসর চলবে। ভাটির জনপদ দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নের ধল আশ্রম গ্রামে ১৯১৬ ইংরেজির ১৫ ফেব্রুয়ারি শাহ আব্দুল করিম জন্মগ্রহণ করেন।

শাহ আব্দুল করিমের জন্মের সময় তখনকার সমাজ, পরিবেশ, পরিস্থিতি ইংরেজদের আনুকূল্যে বেড়ে উঠেছেন। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন মারা যান মখন শাহ আব্দুল করিমের বয়স ২৫। সে সময়টায় বেঁচে ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। শাহ আব্দুল করিম বেড়ে ওঠার সময় লোকসাহিত্যের একটি উজ্জ্বল পরিবেশ ছিল।

শাহ আব্দুল করিমের জন্ম এক দিনমজুর পরিবারে। পিতা ইব্রাহীম আলী মা নাইওরজান বিবি। জন্মের পর থেকে অভাবের মধ্যেই তিনি বেড়ে উঠা। অভাবের কারণে শিক্ষা লাভের সুযোগ আসেনি তার জীবনে। তাই গ্রামের সকলের বাড়িতে গরু রাখালের চাকরী নিলেন তিনি। সাড়া দিন মাঠে গরু ছড়াতেন আর গান গাইতেন। এ গানই রাখাল বালককে বাউল সম্রাটে পরিণত করেছে।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে মৌলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বৃহত্তর সিলেটে গণসংযোগে আসতেন তখন তাদের সফরসঙ্গী হতেন বাউল আব্দুল করিম। ১৯৬৭ সালে শেখ মুজিব পাকিস্তানের দুর্নীতিদমন মন্ত্রী থাকাবস্থায় সুনামগঞ্জে প্রথম সরকারি সফরে আসেন। কোন এক কারণে সেদিন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর জনসভা বর্জন করেছিলেন। তখন শাহ আব্দুল করিম জনসভাস্থলে এসে গান ধরেন তখন জনসভাস্থল লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে।

১৯৬৯ সালে সুনামগঞ্জের জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ে মাঠে করিমের গণসংগীত শুনে আবেগে আপ্লুত হয়ে শেখ মুজিব মাইকে দাড়িয়ে বলেছিলে, শেখ মুজিব বেচে থাকলে করিম ভাইও বেচে থাকবেন, করিম ভাই যেখানে শেখ মুজিব সেখানে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবের ভাটি অঞ্চল নির্বাচনী প্রচারাভিযানে একমাত্র মধ্যমণি ছিলেন শাহ আব্দুল করিম। ১৯৮৬ সালে শেখ হাসিনা যখন এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান চালাতে ভাটি অঞ্চলে আসেন তখন তার সফর সঙ্গী ছিলেন শাহ আব্দুল করিম।

১৯৯৫ সালে শেখ হাসিনা দিরাই বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের জনসভায় শাহ আব্দুল করিমকে বলেছিলেন, আমার বাবা যার গানের ভক্ত ছিলেন, আমি তাকে উপযুক্ত সম্মান দেব।

২০০১ সালে তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ সুনামগঞ্জ সার্কিট হাউসে এক কর্মীসভায় বলেছিলেন, সুনামগঞ্জে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠায় শাহ আব্দুল করিমের ভূমিকা অন্যতম। শাহ আব্দুল করিম ৫৪ এর নির্বাচন, ৬৯ এর গণআন্দোলন, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি পর্যায়ে স্বরচিত গণসংগীত পরিবেশন করে জনতাকে দেশ মাতৃকার টানে উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করেছেন।

তাঁর গণসংগীতে মুগ্ধ হয়ে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তাঁর পিঠে হাত রেখে বলেছিলেন- 'বেটা, গানের একাগ্রতা ছাড়িও না, তুমি একদিন গণ মানুষের শিল্পী হবে।'

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গণসংগীত শুনে আব্দুল করিমকে ১৮৫ টাকা দেন। শেখ মুজিব ১১ টাকা দিয়ে বলেন, 'তোমার মতো শিল্পীকে উপযুক্ত মর্যাদা দেয়া হবে।'

শাহ আব্দুল করিমের গানের বিভিন্ন বই প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় আফতাব সঙ্গীত, ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত হয় গণসংগীত, ১৯৮১ সালে কালনীর ঢেউ, ১৯৯০ সালে ধলমেলা, ১৯৯৮ সালে ভাটির চিঠি, ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয় শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্র।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত