মৌলভীবাজার প্রতিনিধি

২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ১৭:২৮

৪২ বছর ধরে বাবার কবর খুঁজে বেড়াচ্ছেন শিপন

১৯৭৬ সনের ৪ এপ্রিল মৌলভীবাজারের জুড়িতে মারা যান কাস্টমস বিভাগের কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল ফররাহ। তাঁর গ্রামের বাড়ি নোয়াখালির কোম্পানিগঞ্জে। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থাও তত ভালো না। এতোদূর লাশ নিয়ে গেলে পচন ধরে যাবে তাই পরিবারের সদস্যদের অনুপস্থিতিতে মৌলভীবাজারের সার্কিট হাউসের পাশেই তাকে সমাহিত করেন সহকর্মীরা।

মোহাম্মদ আবুল ফররাহ যখন মারা যান তখন তার  ছেলে জাহাঙ্গীর আলম শিপনের বয়স মাত্র ৪ বছর। নিজের ৭ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ। সেই শিপন এখন বড় হয়েছেন। পেশায় চিকিৎসক শিপন এখন একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত আছেন।

বাবার করবস্থান খুঁজতে প্রায়ই ছুটে আসেন মৌলভীবাজারে।  ৪২ বছর ধরে চলছে তাঁর এই অনুসন্ধান। তবে এখনো খুঁজে পাননি বাবার কবরস্থান।

নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জের রামপুর ইউনিয়নের রংমালা গ্রামের ডা. জাহাঙ্গীর আলম শিপন চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মকর্ত আছেন।

জাহাঙ্গীর আলম জানান, তিনি বড় হয়ে পরিবারের কাছে শুনেছেন বাবা মারা যাওয়ার পর এত দূর নিয়ে গেলে লাশ পচে যাবে তাই এলাকার ধার্মিক মানুষ এবং বাবা সহকর্মীরা মিলে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কোন এক স্থানে কবর দেয়া হয়। পরিবারের কাউকে না জানিয়ে এভাবে কবর দিতে সহকর্মীরা আপত্তি জানান। মসজিদের ঈমাম  বলেন- এমন ধার্মিক মানুষের লাশকে পচতে দেওয়া যাবে না । প্রয়াতের পরিবারকে বুঝানোর দায়িত্বও নেন ইমাম। তাঁর কথার উপর সবাই বিশ্বাস রেখে মৌলভীবাজারেই কবর দেওয়া হয় শিপনের বাবাকে

বাবার মৃত্যুর ৩দিন পর অফিসের একজন কর্মচারী তাদের গ্রামের বাড়ি গিয়ে মৃত্য সংবাদ দেয় । এই সংবাদ শুনে যখন বাবার বন্ধু খালেদ মমিন এবং খালাত ভাই মৌলভীবাজারে আসলে- সেই ঈমাম তাদের বিস্তারিত জানান।

ডা. জাহাঙ্গীর আলম শিপন জানান, তাঁর বাবা মোহাম্মদ আবুল ফররাহ চাকরী করতে পাকিস্তানের করাচিতে। তাই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কর্মরত অবস্থায় পাকিস্তানে বন্দী হন। পরে আন্তর্জাতিক রেডক্রসের মাধ্যমে আফগানিস্তান হয়ে ১৯৭২ সালে দেশে আসেন তখন শিপন ছিলেন মায়ের গর্বে । দেশে এসে আবুল ফররাহ প্রথমে ঢাকায় এক্সপোর্ট ইমপোর্ট অফিসে চাকরী নেন সেখান থেকে পদোন্নতি পেয়ে পরে সিলেট কাস্টমস অফিসে বদলি হন। পোস্টিং হয় তৎকালীন মৌলভীবাজার মহকুমার বর্তমান জুড়ী উপজেলায় শিলুয়া চা বাগান সন্নিকটে কাস্টম অফিসে।

শিলুয়া স্থলবন্দরে চাকরী করেন কাস্টমস ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ আবুল ফররাহ। সেখানে কর্মরত থাকা অবস্থায় ১৯৭৬ সনের এপ্রিল মাসের ৪ তারিখ রাতে তিনি মারা যান। পরদিন লাশ দেশের বাড়িতে (নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ) নিয়ে যাওয়ার জন্য আনা হয় মৌলভীবাজার সার্কিট হাউসে। এতদূর মরদেহ নিতে চাইলে পচন ধরবে যাবে। সিদ্ধান্ত হয় মৌলভীবাজারে লাশ সমাহিত হবে। পরে সরকারি ব্যবস্থায় সার্কিট হাউস সংলগ্ন একটা কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

এতটুকু তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছেন ছেলে শিপন। তখন তাঁর বয়স চার। মৌলভীবাজার এসে বহুবার বাবার কবর খোঁজেছেন তিনি। কখনো এসেছেন বোনকে সাথে নিয়ে কখনো ভাইকে নিয়ে , এসেছেন নিজে ছেলে মেয়ে নিয়ে। তবে নির্দিষ্ট করে কেউ সনাক্ত করতে পারেননি, কোথায় বাবার কবর। কবরে ফুল দিবেন, দোয়া করবেন। সেই সুযোগটুকু নেই। শোকার্ত পরিবারটি দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সে বেদনা বয়ে বেড়াচ্ছেন।

জাহাঙ্গীর আলম শিপন আরো জানান, এই জীবনে সব পেয়েছি কিন্তু বাবার সমাধীস্থল না পেলে সব কিছুই যেনো অপূর্ণ। বাবার কবরের সন্ধান চাই । আমার সন্তানদের সাথে নিয়ে বাবার কবর জিয়ারত করতে চাই। একবার বাবার কবরে হাত রাখতে চাই। বাবার আদর পাইনি , পারিনি বাবাকে একটু সেবা করতে। বাবার কবরের পাশে একটূ বসে থেকে যদি একটূ শান্তি পাই সেই সুভাগ্য যেন আমার হয়। যদি কেউ আমার বাবার কবরের খবর জেনে থাকেন দয়া করে একটূ জানাবেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত