তপন কুমার দাস, বড়লেখা

১২ নভেম্বর, ২০১৮ ২৩:০৭

আত্মহত্যা নয়, পরিকল্পিত ভাবে হত্যা হয় কলেজ ছাত্র প্রান্তকে

মৌলভীবাজারের বড়লেখায় নিখোঁজের দুইদিন পর ৩১ অক্টোবর নিজের পিসির (ফুপু) বাড়ীর পরিত্যক্ত রান্নাঘরের জানালার গ্রিলের সাথে মুখ বাঁধা ও দাঁড়ানো অবস্থায় প্রান্ত দাস (১৮) নামের এক কলেজ ছাত্রের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তখন থেকেই তার এ মৃত্যুকে নিয়ে শুরু হয় রহস্যের। তবে ঘটনার প্রায় ১২ দিন পর কলেজ ছাত্র প্রান্ত দাসের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, প্রান্ত দাস আত্মহত্যা করেননি। তাকে পরিকল্পিত ভাবে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর লুঙি দিয়ে মুখ বেঁধে জানালার গ্রিলের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল তারই আপন পিসাতো (ফুফাতো) ভাই সুমন দাস (৩৫)। প্রান্ত হত্যায় জড়িত সন্দেহে বর্ণী ইউনিয়নের মিহারী নয়াগ্রামের মৃত করুণাময় দাসের ছেলে সুমন দাসকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানান সুমন।

সুমনকে গ্রেপ্তারের পর সে তার মামাতো ভাইকে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। নারী-সংক্রান্ত ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। এই ঘটনায় পুলিশ আরও চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সুমন জানান, গত ২৯ অক্টোবর (সোমবার) রাতে পিসাতো ভাই সুমন দাস বাজার থেকে বাড়ি ফিরলে পরিবারের এক নারী সদস্যের সাথে আপত্তিকর অবস্থায় প্রান্ত দাসকে দেখতে পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। সুমন প্রান্তকে ধাওয়া দিয়ে এক পর্যায়ে বাড়ির রাস্তায় গিয়ে ধরে ফেলেন। এরপর মুখ চেপে ধরলে প্রান্ত অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তখন প্রান্তর হাত-পা ও মুখ বেঁধে পরিত্যক্ত রান্না ঘরের খাটের নিচে রেখে দেন। পরে প্রান্তের বড় ভাই শুভ দাসকে ফোন দিয়ে জানান, প্রান্তকে পাওয়া যাচ্ছে না। খবর পেয়ে শুভ সুমনদের বাড়িতে আসেন। তাঁরা একসাথে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেন। এর পরদিন ৩০ অক্টোবর (মঙ্গলবার) রাত পর্যন্ত প্রান্তকে না পেয়ে শুভ তাঁর মামার বাড়ি একই উপজেলার (বড়লেখা) গাজী টেকা চলে যান।

জিজ্ঞাসাবাদে তিনি আরো জানান, ৩০ অক্টোবর (মঙ্গলবার) রাতে প্রান্তকে না পেয়ে বড়ভাই শুভ যখন মামার বাড়ি চলে যায় সেই রাতে পরিত্যক্ত রান্না ঘরের খাটের নিচ থেকে প্রান্তকে বের করে আনা হয়। তখনও প্রান্ত জীবিত ছিলেন। মুখ বাঁধা থাকায় কথা বলতে পারেননি। পরে রাত আনুমানিক তিনটার দিকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। এরপর লুঙি দিয়ে মুখ ও গলা বেঁধে সুমনের কাকাতো ভাই নিকেশের পরিত্যক্ত রান্নাঘরের জানালার গ্রিলের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে রেখে দেন।

এর আগে সুমন ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে প্রান্তের মুঠোফোন থেকে কয়েকটি ক্ষুদে বার্তা প্রান্তের সহপাঠী, স্বজন ও ভাইয়ের কাছে পাঠানো হয়। হত্যার আগে ও পরে ওই ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়। হত্যার ঘটনাটি সন্দেহের বাইরে রাখতে লাশের প্যান্টের পকেটে মুঠোফোন রেখে দেওয়া হয়।

প্রসঙ্গত, ৩১ অক্টোবর (বুধবার) বর্ণী ইউনিয়নের মিহারী নয়াগ্রামের পিসির বাড়ির পরিত্যক্ত একটি রান্নাঘর থেকে প্রান্ত দাসের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ময়নাতদন্তের জন্য মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে প্রেরণ করে। এই ঘটনায় লাশ উদ্ধারের দিনই একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছিল।

প্রান্ত বড়লেখা উপজেলার সুজানগর ইউনিয়নের বাঘমারা গ্রামের সনত দাসের ছেলে। তিনি পিসির বাড়িতে থেকে উপজেলার বর্ণী ইউনিয়নের এম মন্তাজিম আলী কলেজে লেখাপড়া করতেন।

পুলিশের কাছে সুমনের স্বীকারের ঘটনার পর সোমবার (১২ নভেম্বর) থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন প্রান্তের বড়ভাই শুভ দাস।

এ ব্যাপারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কুলাউড়া সার্কেল) মো. আবু ইউসুফ বলেন, ‘সুমন দাসকে গ্রেপ্তারের পর হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। সে একাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে জানিয়েছেন। কিভাবে হত্যা করা হয়েছে তারও বিবরণ দিয়েছেন সুমন। আসামি নিজেই প্রান্ত দাসের মোবাইল থেকে বিভিন্নজনকে ম্যাসেজ দেওয়ার কথা বলেছে। ময়না তদন্তের রিপোর্টে শ্বাসরোধে হত্যার কথা বলা হয়েছে। তবে হত্যা করা, মেসেজ পাঠানোসহ অনেকগুলো কার্যক্রম ঘটেছে। যা একজনের পক্ষে করা সম্ভব কিনা সেটাও সন্দেহজনক। তাই এর সাথে অন্য কেউ জড়িত আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এই ঘটনায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে।'

নিহত প্রান্তের বড় ভাই শুভ বলেন, ‘সুমন যে বক্তব্য দিয়েছে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সে নিজে বানিয়ে এসব কথা বলছে। আমরা যাদের আসামি করেছি মামলায়, তাঁরা প্রত্যেকেই মিলিতভাবে আমার ভাইকে হত্যা করেছে। এটা একা ঘটানো হয়নি। যে, হঠাৎ করে হত্যা করা হয়েছে। তিন দিন সময় নেওয়া হয়েছে। ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে করা হয়েছে। একজনের পরিকল্পনায় হয়নি। অনেকের পরিকল্পনা অবশ্যই ছিলো। ওই বাড়ির দুই পরিবারের সবাই জানতো। সুমন দাস পুলিশের কাছে যা বলেছেন, আমরা তা মানতে পারছি না। যারা আমার ভাইকে হত্যা করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত