সিলেটটুডে ডেস্ক

১৫ নভেম্বর, ২০১৮ ১৩:২৮

ঐতিহাসিক লাউড় রাজ্যে দুর্গ খনন শুরু

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর সীমান্তে অবস্থিত প্রাচীন লাউড় রাজ্যের ঐতিহাসিক হলহলিয়া (হাউলি) দুর্গ খনন শুরু হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের প্রথম দিনেই গতকাল বুধবার মিলেছে ৫০০ বছরের পুরনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রত্ন নিদর্শন।

খননদলের প্রধান ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রাম-সিলেট অঞ্চলের পরিচালক ড. মো. আতাউর রহমান প্রথম দিনের খনন শেষে জানান, দুর্গের নিচে সারি সারি পুরনো ইট পাওয়া গেছে। এটা থেকে ধারণা করা হচ্ছে, লাউড় সভ্যতার আগেও এখানে অন্য সভ্যতা ছিল। মেঘালয়ের পাদদেশের এই স্থানে এক সভ্যতার ওপর আরেক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। খননকাজ শেষ হলে কয়েকটি সভ্যতার নির্দশন এখান থেকে পাওয়া সম্ভব।

ড. আতাউর বলেন, ‘একাধিকবার জরিপ শেষে এখানে খননকাজের শুরুতেই কয়েকটি যুগের অস্তিত্ব পেয়েছি আমরা। ধারণা করা যায়, মেঘালয় পাহাড় ও সীমান্ত নদী যাদুকাটাকে কেন্দ্র করে এখানে কয়েকটি সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।’

আনুষ্ঠানিকভাবে গতকাল সকালে ঐতিহাসিক এই স্থানটিতে খননকাজ শুরু হয়। প্রথমে হলহলিয়া দুর্গ ও প্রাচীর এলাকায় খনন শুরু হয়েছে। সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার বরকতুল্লাহ খান এর উদ্বোধন করেন।

পরবর্তী সময়ে পাশের ব্রাহ্মণগাঁও রাজবাড়িতেও খনন হবে। রাজবাড়ির দৃষ্টিনন্দন ধ্বংসাবশেষ এখনো সভ্যতার চিহ্ন বহন করছে। উত্খনন কাজে অংশ নিয়েছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মাহবুব আলম, ময়নামতি জাদুঘরের কাস্টডিয়ান ড. আহমেদ আবদুল্লাহ্ ও সহকারী কাস্টডিয়ান হাফিজুর রহমান, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগীয় আঞ্চলিক পরিচালক অফিসের সিনিয়র ড্রাফটসম্যান সিরাজুল ইসলাম, সার্ভেয়ার জালাল আহমেদ, আলোকচিত্রী নুরুজ্জামান মিয়া, পটারি রেকর্ডার ওমর ফারুক ও লক্ষ্মণ দাস। তাঁরা দুই মাস তাহিরপুরের হলহলিয়া গ্রামে অবস্থান করবেন।

খননকারী দল জানিয়েছে, প্রথম দিন হলহলিয়া দুর্গের প্রধান ফটকের পূর্ব দিকে প্রাচীরের দক্ষিণ অংশ থেকে খনন শুরু হয়েছে। প্রধান ফটক থেকে দুর্গটি উত্তর-দক্ষিণে গেছে। প্রাচীরের ওপরের অংশ পাথর দিয়ে মোড়ানো। আপাতদৃষ্টিতে ধারণা করা মুশকিল যে এর নিচে কিছু থাকতে পারে। কিন্তু খননকারীরা সেখান থেকে শুরু করে নিচের দিকে কিছুদূর যেতেই বেরিয়ে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ন নিদর্শন। পাওয়া গেছে ৫০০ বছর আগের রঙিন অক্ষত অনেক ইট, যা থরে থরে সাজানো।

স্থানীয় গবেষক ও সুধীজনদের ধারণা, প্রায় ৭০০ বছরের পুরনো এই পুরাকীর্তি স্থাপনা খননের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের অজানা অধ্যায়ের উন্মোচন হবে। নতুন করে রচিত হতে পারে প্রাচীন লাউড় রাজ্যের ইতিহাস। বেরিয়ে আসতে পারে লাউড় সভ্যতার আগের কোনো সভ্যতার ইতিহাসও।

ঐতিহাসিক ও স্থানীয় গবেষকদের সূত্রে জানা গেছে, লাউড় রাজ্য পৌরাণিক যুগের রাজ্য। এর স্থপতি রাজা ভগদত্ত। ভগদত্তের ১৯ জন বংশধর সিলেটের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে রাজ্য স্থাপন করে। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন লাউড় রাজ্য কামরূপ রাজ্য থেকে আলাদা হয়। দশম শতক থেকে স্বাধীনভাবে রাজ্য শাসন শুরু হয়।

ঐতিহাসিকদের মতে—বর্তমানের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ময়মনসিংহ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল লাউড় রাজ্য। মহাভারতের যুদ্ধে অর্জুনের পক্ষে লড়তে গিয়ে নিহত হন রাজা ভগদত্ত। দ্বাদশ শতাব্দীতে রাজা বিজয় মাণিক্য লাউড় রাজ্য শাসন করেন। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষে তিনি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরেও রাজ্য স্থাপন করেন। এ সময় বঙ্গের ব্রাহ্মণরা বল্লাল সেনের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে রাজা বিজয় মাণিক্যের রাজ্যে এসে আশ্রয় নেন। বিজয় মাণিক্যের পর কারা লাউড় শাসন করে তা এখনো অজানা। প্রাচীন ইতিহাসে লাউড় রাজ্য সব সময় স্বাধীন ছিল বলে জানা যায়। এই খননের মধ্য দিয়ে লাউড় রাজ্যের ব্যাপারে নতুন অনেক কিছু উন্মোচন হতে পারে।

জানা গেছে, সুনামগঞ্জের কৃতী সন্তান বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ সাদিক ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে সুনামগঞ্জের এই ঐতিহাসিক স্থাপনা ও ইতিহাস সংরক্ষণের স্বার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের লিখিত আবেদন জানান। তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে খননকাজ শুরু হয়েছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত