প্রনীত রঞ্জন দেবনাথ, কমলগঞ্জ

২০ জানুয়ারি, ২০১৯ ১৮:০৬

কমলগঞ্জে ২৭ বছরের নড়বড়ে ঘরে চলছে বিনা বেতনে পাঠদান

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ১নং রহিমপুর ইউনিয়নের জশমতপুর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে ৪ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা বিনাবেতনে পাঠদান করছেন। বেমানান শিক্ষার পরিবেশ, বান্ধবহীন জশমতপুর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা পাঠদান করছেন শিক্ষা প্রসারের মহান ব্রত নিয়ে আর শিক্ষার্থীরা নড়বড় ঘরে পাঠ নিচ্ছেন ভবিষ্যতে আলোকিত মানুষ হওয়ার আশায়। দীর্ঘদিনেও বিদ্যালয়টি রেজিস্টারি ও জাতীয়করণ না হওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন শিক্ষকরা। নড়বড়ে চৌচালা টিনের ঘর, ঢুলি বাঁশের বেড়া, ভাঙা দরজা-জানালা, চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চি। এ যেন ডিজিটাল যুগের বটতলার পাঠশালা।

স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, বিদ্যালয়ের ভবন হবে, শিক্ষার্থীরা সুযোগ পাবে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশে শিক্ষার, শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের আলোকিত মানুষ করার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে এ আশায় বুক বেঁধে বিনা বেতনে দীর্ঘ ২৭ বছর শিক্ষকতা করছেন ৪ জন শিক্ষক। জাতীয়করণ না হওয়ায় বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকরা বেতন পান না দীর্ঘ ২৭ বছর। জাতীয়করণের আশায় পাঠদান চালালেও আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে হতাশ শিক্ষক ও অভিভাবকরা। জীবনযাত্রার ঊর্ধ্বগতিতে বেতন না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

সরেজমিন খোঁজ জানা যায়, কমলগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর ইউনিয়নের জশমতপুর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি এলাকাবাসীর সহযোগিতায় ১৯৯১ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর চারজনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তারা পাঠদান কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে। বর্তমানে ওই বিদ্যালয়ে ১৬০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকে টিনশেডের স্কুল ভবনটি অর্থাভাবে আর সংস্কার করা হয়নি। ঘরটি ভাঙাচোরা। ফলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের পাঠদান কার্যক্রম চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এছাড়া বিদ্যালয়ের আসবাবপত্রের চরম সংকট। চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চগুলো নড়বড়ে। শিক্ষার্থীদের জন্য নেই সুপেয় পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের ব্যবস্থা। এমনকি নেই বিদ্যুৎ সংযোগও। অধিকাংশ শিক্ষার্থী হতদরিদ্র পরিবারের হলেও সরকারি উপবৃত্তি থেকে বঞ্চিত রয়েছে।

বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছামা চৌধুরী, হৃদয় মিয়া, সুমাইয়া বেগম জানায়, ‘বৃষ্টি হলে পানি পড়ে বইপত্র ভিজে যায়। জোরে বাতাস শুরু হলে স্যারেরা আমাদের ছুটি দিয়ে দেন।’

আলাপকালে অভিভাবক ছমরু মিয়া, আব্দুল করিম, স্বপন পাল, সাথী রানী পাল বলেন, ‘পোলাপানরে স্কুলে পাঠিয়ে আমরা চিন্তায় থাকি।’ তারা জানান, ‘আশপাশে কোনো বিদ্যালয় না থাকায় আমাদের ছেলেমেয়েরা এ বিদ্যালয়ে পড়ে। শিক্ষকরা ভালো পড়ান। কিন্তু বিদ্যালয়ের ভাঙাচোরা ঘর এবং টিউবওয়েল ও পায়খানা নেই।’

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুল ওয়াহিদ জানান, ১৯৯১ সালে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় ৩৩ শতক ভূমির উপর বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মান খুবই ভাল। প্রতি বছর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভাল ফলাফলসহ পাসের হার শতভাগ রয়েছে। সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ মো. আব্দুস শহীদ এমপি, সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী প্রয়াত সৈয়দ মহসীন আলী এমপি এই বিদ্যালয়টি জাতীয়করণের জন্য সুপারিশসহ ডিও লেটার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে দিয়েছেন। কিন্তু অদ্যাবধি বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ না হওয়ায় আমরা ৪ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা অর্ধাহারে অনাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছি। দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে সম্পূর্ণ বিনা বেতনে এ বিদ্যালয়ে কোমলমতি শিশুদের পাঠদান করে আসছি। বিদ্যালয়ের নানাবিধ সমস্যার মাঝেও পাঠদান অব্যাহত রেখেছি। দ্রুত বিদ্যালয়টি জাতীয়করণের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছি।

কমলগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মোশারফ হোসেন বলেন, সরকারি নিয়মনীতি অনুসরণ করে এ বিদ্যালয়টি পরিচালিত হয়ে আসছে। বিদ্যালয়ের আশপাশে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় এটি জাতীয়করণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আগামী শিক্ষা কমিটির মাসিক সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে।

কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশেকুল হক বলেন, বিষয়টি অমানবিক। আমি এ উপজেলায় নতুন যোগদান করেছি। বিদ্যালয়ের উন্নয়নে আমি সাধ্যমত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব। জাতীয়করণ দীর্ঘদিনেও কেন হলো না বিষয়টি খতিয়ে দেখবো।

সরকারের নিরক্ষরতা দূরীকরণের অঙ্গীকারকে বাস্তবায়ন করার জন্য জশমতপুর বেসরকারি এ প্রাথমিক বিদ্যালয়কে অবিলম্বে জাতীয়করণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এলাকাবাসী প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর তড়িৎ হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত