বিন্দু তালুকদার, সুনামগঞ্জ

২২ জানুয়ারি, ২০১৯ ১৫:২০

পাগনার হাওরের পানি সেচে চলছে বোরো চাষ

সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জের কানাইখালী নদীতে খনন কাজ সময়মত শুরু না হওয়ায় জলাবদ্ধতা নিরসন হয়নি বৃহত্তর পাগনার হাওরের বোরো জমির। সারা জেলায় বোরো চাষাবাদ প্রায় শেষ পর্যায়ে হলেও বৃহত্তর পাগনার হাওরের মধ্যবর্তী বিভিন্ন গ্রামের কৃষকদের জমি এখনও পানির নিচেই রয়ে গেছে।

এদিকে প্রকৃতিগত ভাবে জমি থেকে হাওরের পানি নিষ্কাশিত না হওয়ায় প্রতি বছরের ন্যায় এবারও মেশিন দিয়ে পানি সেচে ধান রোপণের উদ্যোগ নিয়েছেন বেশ কয়েক গ্রামের কৃষকেরা।

গত ১৬ দিন ধরে চারটি ডিজেল চালিত পাওয়ার পাম্প দিয়ে ফেনারবাঁক ইউনিয়নের গঙ্গাধরপুর গ্রামের সামনের হাওরের পানি নিষ্কাশন করছেন গ্রামের শতাধিক কৃষক। এই হাওরে প্রায় শতাধিক একর জমি রয়েছে। কৃষকেরা নিজ উদ্যোগে প্রতি কেদার (৩০ শতক) জমির পানি নিষ্কাশনের জন্য ২০০ টাকা করে প্রদান করেছেন। হাওরের পানি নিষ্কাশন করতে প্রতিদিন চারটি ইঞ্জিনের জন্য প্রায় ৯ হাজার টাকা ডিজেল কিনতে হচ্ছে তাদের। অন্তত ৭/৮ দিন পানি সেচ করলেও হাওরের ধান চাষের উপযোগী হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন গঙ্গাধরপুর গ্রামের কৃষকরা।

তবে উপজেলা কৃষি অফিস বা অন্য কোন সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ সহায়তা পাওয়া যায়নি। এভাবে পানি সেচে ধান রোপণ করলেও ধান গোলায় তোলতে পারবেন কিনা তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে তাদের। কারণ ধান পাকার সময় অতিবৃষ্টি হলে হাওরে আবারো জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে পারে।

তবে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড এর পওর-১ শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বকর সিদ্দিক ভূঁইয়া বলেছেন,‘গজারিয়া খাল খননের পর চলতি বোরো মওসুমে পাগনার হাওরের পানি অন্য বছরের চেয়ে সময় নিষ্কাশিত হয়েছে। গজারিয়া খাল খনন কাজ অনেকদূর এগিয়েছে। কানাইখালী খনন কাজও চলমান রয়েছে। এখনও হাওরের পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে তাই পানি প্রবাহ বন্ধ করে কাজ না করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। দুইটি প্রকল্পের প্রকল্পের মেয়াদ আগামী জুন মাসের ২৫ তারিখ পর্যন্ত। তবে আমরা এর আগেই দুইটি প্রকল্পের কাজ শেষ করব।’

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, পলি মাটিতে ভরাটকৃত কানাইখালী নদীর ৪.২৫ কিলোমিটার খননে ৮৭ লাখ টাকা ও হাওরের পানি প্রবাহের জন্য গজারিয়ার ভরাটকৃত খালের ৩.৮০ কিলোমিটার খনন করতে ২ কোটি টাকা বরাদ্দ অনুমোদন হয়েছে। ৫ ফুট বা কমবেশি গভীর করে, তলদেশে ৩৩ ফুট ও উপরে ৪০ থেকে ৫০ ফুট প্রশস্ত করে খাল ও নদী খননের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গজারিয়া খালের খনন কাজ চললেও কানাইখালী নদী খননের কাজ এখনও শুরু হয়নি।

যার ফলে চলতি বোরো মওসুমে পাগনার হাওরের মধ্যবর্তী এলাকার জলাবদ্ধতা দূর হয়নি। এখনও অন্তত দেড় হাজার একর বোরো জমি পানির নিচে রয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে জলাবদ্ধতার শিকার কৃষকেরা নিজ খরচেই পাম্প বসিয়ে পানি সেচে ধান রোপণের উদ্যোগ নিয়েছেন।

গঙ্গাধরপুর গ্রামের কৃষকদের ন্যায় পার্শ্ববর্তী ছয়হারা ও ভাটি দৌলতপুর গ্রামের ঢালার হাওরের পানি নিষ্কাশন করে ধান রোপণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। রোববার তিনটি পাওয়ার পাম্প বসানো হয়েছে ঢালার হাওরের পানি নিষ্কাশনের জন্য। একইভাবে ১০ দিন আগে ভীমখালী ইউনিয়নের রাজাবাজ, ভান্ডা ও মল্লিকপুর গ্রামের হাওরের পানি নিষ্কাশনের জন্য ৬টি পাম্প বসানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

জামালগঞ্জ উপজেলার অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কৃষি অফিসার কে.এম বদরুল হক জানিয়েছেন, গত বছরের চেয়ে এবার জলাবদ্ধতার পরিমাণ কিছুটা কমেছে। হাজার-দেড় হাজার একর জমিতে পানি রয়েছে। তবে পানি এখনও পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে। কোথাও কোথাও কৃষকরা নিজেরা পানি নিষ্কাশন করছেন।

ফেনারবাঁক ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শান্তিপুর গ্রামের বাসিন্দা ইয়াসিন চৌধুরী বলেন,‘ এবার অন্য বছরের চেয়ে একটু বেশি জমি ভেসেছে। তবে অনেক জমি এখনও পানির নিচে আছে। কানাইখালী খনন কাজ শুরু হয়নি, নদী দিয়ে ধীর গতিতে কিছু পানি কমছে।’

গঙ্গাধরপুর গ্রামের গৃহস্থ জগদীশ তালুকদার বলেন,‘কানাই নদী ভরাট হওয়ায় আমাদের বোরো জমি অন্তত ২০-২৫ বছর ধরে জলাবদ্ধতা দেখা  দিয়েছে। হাওরের পানি সময়মত নিষ্কাশন না হওয়ায় আমরা বাধ্য হয়ে পাম্প দিয়ে পানি সেচে ধান রোপণ করি। এতে আমাদের অনেক টাকা খরচ হয়। গত বছর হাওরে বেশী পানি থাকায় পানি সেচা হয়নি। এবার প্রতি কেদার ২০০ টাকা করে পানি সেচা হচ্ছে। ৭৫০ টাকা করে চারটি মেশিন ভাড়া আনা হয়েছে। এছাড়া ৫-৬ জন শ্রমিক রয়েছে এসব কাজে।’

ভীমখালী ইউনিয়নের ভান্ডা গ্রামের বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য মোস্তফা আলম বলেন,‘ আমরাদের হাওরের বোরো জমিতে গত ১৫ বছর ধরে পানি জমে থাকে। কানাইখালী নদীর কারণে আমরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এবারও জমিতে হাঁটু পানি ছিল। সামান্য কিছু জমিতে ধান রোপণ করা হয়েছিল। মেশিন না বসালে এত পানি কোনভাবেই নিষ্কাশন করা সম্ভব হত না। আলোচনা করে কেদার প্রতি ২৫০ টাকা করে উত্তোলন করে ৬টি পাম্প লাগানো হয়েছে। আমরা আশা করছি সপ্তাহ খানেক পর পুরো হাওরে ধান রোপণ করা সম্ভব হবে।’

এলাকার বাসিন্দা গণমাধ্যমকর্মী দিল আহমেদ বলেন,‘ শুধু গঙ্গাধরপুর গ্রামই নয় এই পরিস্থিতির শিকার ফেনারবাঁক ও ভীমখালী ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম।’

তিনি জানান, এভাবেই পাম্প দিয়ে পানি সেচে জমিতে বোরো ধান করেন কয়েকটি গ্রামের কৃষকেরা। এখনও হাওরে পানি রয়েছে ছয়হারা, রাজাপুর, উজান দৌলতপুর, ভাটি দৌলতপুর, রাজাবাজ, ভান্ডা, মল্লিকপুর, মাতারগাঁওসহ আরও কয়েকটি গ্রামের কৃষকের জমিতে।

জামালগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ইউসুফ আল আজাদ বলেন,‘ ভরাটকৃত কানাইখালী কৃষকদের জন্য মরণখালীতে পরিণত হয়েছে। বারবার খনন প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও কৃষকের দুর্ভোগ লাগব হচ্ছে না। পানি সেচে ধান চাষ করলেও কৃষকদের উপকার হয় না। পানি নিষ্কাশনের কোন রাস্তা না থাকায় ধান পাকার সময় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। দ্রুত কানাইখালী খনন করে হাওরের জলাবদ্ধতা দূরীকরণে স্থায়ী সমাধান করতে হবে।’

জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শামীম আল ইমরান বলেন,‘ কানাইখালী ও গজারিয়া খাল ভরাটের ফলে পাগনার হাওরে দীর্ঘদিন ধরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে বলে কৃষকরা জানিয়েছেন। এই দুইটি খাল খনন কাজ কিভাবে করা হচ্ছে, কতটুকু করা হচ্ছে তা আমাকে কেউ অবগত করেনি।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত