নিজস্ব প্রতিবেদক

২০ ফেব্রুয়ারি , ২০১৯ ০১:২২

আটকে আছে সড়ক ও রেলপথ সরানোর উদ্যোগ

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান

ঢাকা-সিলেট রেলপথের পাঁচ কিলোমিটার এবং শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কের সাড়ে ছয় কিলোমিটার অংশ গেছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে। প্রাণিবৈচিত্র্যের আধার এ সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে চলাচল করা ট্রেন ও গাড়িতে চাপা পড়ে প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে বন্যপ্রাণী। এসব প্রাণী রক্ষায় জাতীয় উদ্যান থেকে সড়ক ও রেলপথ অপসারণের জন্য বছর তিনেক আগে বন বিভাগের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হলেও আন্তঃমন্ত্রণালয়ে আটকে আছে এ উদ্যোগ।

লাউয়াছড়ার বন্যপ্রাণী রক্ষায় বনের ভেতর থেকে সড়ক ও রেলপথ স্থানান্তরের দাবি দীর্ঘদিনের। পরিবেশবাদীদের দাবির মুখে ২০১৫ সালে লাউয়াছড়ার ভেতর থেকে সড়ক ও রেলপথ সরানোর একটি প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠায় বন বিভাগ। এরপর ২০১৬ সালের ২ আগস্ট ‘লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং রাতারগুল জলারবন’ সুরক্ষায় করণীয় নির্ধারণে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় লাউয়াছড়া উদ্যানের প্রাণী রক্ষায় বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া সড়ক সরিয়ে বিকল্প সড়ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া বনের ভেতর থেকে কালাছড়া ও চাউতলি খাসিয়াপুঞ্জি সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, চা বাগান কর্তৃপক্ষ ও বন বিভাগ এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে বিকল্প সড়ক বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয় ওই সভায়।

এর আগে একই বছরের এপ্রিলে রেলের নিরাপত্তার স্বার্থে রেললাইনের পার্শ্ববর্তী লাউয়াছড়ার ২৫ হাজার গাছ কেটে ফেলতে বন বিভাগকে চিঠি দেন রেলপথ কর্মকর্তারা। যদিও পরে সমালোচনার মুখে গাছ কাটার আবদার থেকে সরে আসেন তারা। তবে রেললাইন স্থানান্তরে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে ফাইল চালাচালিতে আটকে আছে এ উদ্যোগ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ-বিষয়ক বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) আবু মোছা শামসুল মোহিত চৌধুরী বলেন, সড়ক ও রেলপথ স্থানান্তরে আমরা ২০১৫ সালে একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলাম। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সভায়ও সড়কপথ স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়। এ নিয়ে একাধিকবার আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকও হয়েছে। মাস ছয়েক আগেও বৈঠক হয়। এতে সড়কপথ সরানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। নুরজাহান চা বাগানের ভেতর দিয়ে সড়কটি যাবে। নতুন পরিবেশ ও বনমন্ত্রীর সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে রেলপথ সরাতে আরো কিছুটা সময় লাগবে।

এদিকে লাউয়াছড়া থেকে সড়ক ও রেলপথ অপসারণ না হওয়ায় প্রায় প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে জাতীয় এ উদ্যানের বন্যপ্রাণী। গত জানুয়ারিতেই ট্রেনের ধাক্কায় মারা গেছে একটি মায়া হরিণ। বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া সড়কপথে গাড়ির ধাক্কায় মারা যায় বিলুপ্ত প্রজাতির দুটি চিতা বিড়াল। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের হিসাবমতে, শুধু সড়কপথে গাড়ির চাকায় চাপা পড়ে লাউয়াছড়ায় প্রতি বছর মারা যায় প্রায় ৪৫টি বন্যপ্রাণী। আর রেলপথে মারা যাওয়া বন্যপ্রাণীর হিসাব নেই কারো কাছে।

বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া সড়ক ও রেলপথ স্থানান্তর করা হলে প্রাণীর মৃত্যু বহুলাংশে কমিয়ে আনা যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ সড়ক ও রেলপথকেই বন্যপ্রাণীর মরণফাঁদ বলে মনে করেন লাউয়াছড়া বন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক জলি পাল। তিনি বলেন, ‘ব্রিটিশরা মূলত বনের কাঠ সহজে পরিবহনের জন্য সংরক্ষিত এসব বনের ভেতর দিয়ে সড়ক ও রেলপথ যোগাযোগ তৈরি করেছিল। এটি এখন আমাদের বন্যপ্রাণীর মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে বনের ভেতর থেকে সড়ক ও রেলপথ স্থানান্তরের দাবি জানিয়ে আসছি। পথগুলো স্থানান্তর করা না হলে কোনোভাবেই বন্যপ্রাণী রক্ষা করা যাবে না।’

১ হাজার ২৫০ হেক্টর জমি নিয়ে লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চল। ১৯৯৬ সালে এটিকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। উদ্ভিদ আর প্রাণিবৈচিত্র্যের আধার এ বন বিভিন্ন বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। বন বিভাগের হিসাবমতে, এ বনে ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৫৯ প্রজাতির সরীসৃপ (৩৯ প্রজাতির সাপ, ১৮ প্রজাতির লিজার্ড, ২ প্রজাতির কচ্ছপ), ২২ প্রজাতির উভচর, ২৪৬ প্রজাতির পাখি ও অসংখ্য কীটপতঙ্গ রয়েছে। এ বনে বিরল প্রজাতির উল্লুক, মুখপোড়া হনুমান, চশমাপরা হনুমানও দেখতে পাওয়া যায়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত