সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি

১৬ মার্চ, ২০১৯ ১৫:৫১

সুনামগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে ভিটে ছাড়া করার চেষ্টা

ভিটে না ছাড়ায় মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী-সন্তান একঘরে

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কুরবাননগর ইউনিয়নের মাইজবাড়ি বদিপুর গ্রামে এক মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীনের পরিবারকে বসতভিটা থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গ্রাম্য পঞ্চায়তের পক্ষ থেকে এ জন্য প্রয়াত ওই মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী-সন্তানদের চাপ দিয়ে ব্যর্থ হওয়ায় এখন তাদের ‘একঘরে’ ঘোষণা করা হয়েছে।

জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন ও তাঁর স্ত্রী ফাতেমা বেগম ১৯৯৩ সালে মাইজবাড়ি বদিপুর এলাকায় ১০ শতক সরকারি খাস জমি বন্দোবস্ত পেয়েছিলেন। চার বছর আগে জয়নাল আবেদীন মারা যান। এরপর ওই জমিতে একটি টিনের চাপড়া ঘর তুলে বসবাস করে আসছেন ফাতেমা বেগম।

ফাতেমা বেগম জানান, তাঁর দুই মেয়ে আছে। এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। অন্যজন এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। ফাতেমা বেগম এখন স্বামী জয়নাল আবেদীনের মুক্তিযোদ্ধা ভাতার টাকায় সংসার ও মেয়ের লেখাপড়া চালান। তিনি ৫ মার্চ টিনের চাপড়া ঘরে পাকা খুঁটি বসিয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নিলে বদিপুর গ্রামের পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে কাজে বাঁধা দেওয়া হয়।

পঞ্চায়েতের লোকজনের দাবি, এটি মসজিদের জমি। তাঁরা ফাতেমা বেগমকে এখান থেকে ঘর সরিয়ে নিতে চাপ দেন। বিষয়টি পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে পুলিশকে জানালে পুলিশ পরদিন সরেজমিনে গিয়ে দেখে দুই পক্ষকে কাগজপত্র নিয়ে থানায় আসতে বলে। ফাতেমা বেগম থানায় গিয়ে তার বন্দোবস্তের কাজগপত্র দেখান। কিন্তু পঞ্চায়েত পক্ষ থেকে এটি যে মসজিদের জমি এ বিষয়ে কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি তারা। এরপরও তাকে ঘর সরিয়ে নিতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। তিনি তাতে কোনোভাবেই রাজি না হওয়ায় পঞ্চায়েতের লোকজন বৈঠক করে তাকে ‘একঘরে’ হিসেবে ঘোষণা দেন।

ফাতেমা বেগমের ছোট ভাই জিয়াউর রহমান জানান, বদিপুর পাড়ায় তাঁর একটি মুদি দোকান রয়েছে। বোন ফাতেমা বেগমের পরিবারকে একঘরে হিসেবে ঘোষণার পর তার দোকানেও কোনো লোকজন আসছে না। তিনি অনেকের কাছে দোকান বাকির টাকা পান। সেগুলোও তুলতে পারছেন না।

ফাতেমা বেগম বলেন, ‘অসহায় মানুষ হিসেবে আমি পঞ্চায়েতের কাছে জোড়হাতে মিনতি করেছি। কিন্তু তারা আমার কথা শুনেননি। এখনো আমাকে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আমার চলাফেরায় অসুবিধা হচ্ছে।

তিনি জানান, এটি যদি মসজিদের জমি হবে, তাহলে তিন বছর আগে যখন তিনি ছাপড়া ঘর তুলেন তখন কেউ কোনা বাধা দেয়নি কেন?

সরেজমিনে দেখা গেছে, বদিপুর এলাকায় সুনামগঞ্জ-দোয়ারাবাজার সড়ক ঘেঁষে পূর্বপাশে বদিপুর গ্রামের মসজিদ। মসজিদের দক্ষিণে একটি পুকুর। পুকুরের পর রয়েছে খালি জায়গা। ওই খালি জায়গার পরে দক্ষিণে ফাতেমা বেগমের টিনের ছাপড়া ঘর।

ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ফাতেমা বেগম বলেন, ‘এই জমি আর ঘর ছাড়া আমার কিছুই নাই। আমাকে তুলে দেওয়া হলে আমি মেয়েকে নিয়ে রাস্তায় থাকতে হবে।’

বদিপুর জামে মসজিদের মোতাওয়াল্লি ও পঞ্চায়েতের মুরব্বি আহমদ আলী দাবি করেন কোনো কাগজপত্র না থাকলেও এই জমি মসজিদেরই। এখন এক পাশে ফাতেমা বেগম স্থায়ী ঘর করার উদ্যোগ নিলে পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে তাকে নিষেধ করা হয়।

তিনি বলেন, ‘এখানে ফাতেমাকে স্থায়ী ঘর করতে দেওয়া হবে না। যেহেতু ফাতেমা আমাদের কথা মানতে রাজি নয়, তাই আমরা বলেছি তুমি তোমার মতো চলো, আমরা আমাদের মতো চলব। ফাতেমার পরিবার আর পঞ্চায়েতের সঙ্গে নেই।’

সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানার এসআই সোহেল রানা বলেছেন, ‘ফাতেমা বেগমের ঘরটি মসজিদের কাছেই। এখন তিনি নতুনভাবে ঘরের কাজ করতে চাইলে পঞ্চায়েতের লোকজন বাঁধা দেয়। আমরা দুই পক্ষকেই থানায় ডেকে কাগজপত্র দেখেছি। ফাতেমা বেগমের কাছে ৯৯ বছরের বন্দোবস্তের দলিল আছে। পরে আমরা পঞ্চায়েতের লোকজনকে বলেছি, তারা যেন এ নিয়ে ফাতেমা বেগমের সঙ্গে আর কোনো ঝামেলা না করে।’

সুনামগঞ্জ মুক্তিযুদ্ধ চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্রের আহবায়ক মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মজিদ চৌধুরী বলেছেন, ‘ফাতেমা বেগম আমাদের কাছে এসেও এ নিয়ে কান্নাকাটি করেছেন। তাকে যেন নিজ ভিটে থেকে কেউ উচ্ছেদ করতে না পারে এ জন্য প্রশাসন ও পুলিশের জোর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত